গ্রেপ্তারকৃত তপু চন্দ্র ঘোষ সোনারগাঁ থানার ছোট অজুর্নদী এলাকার সাধব চন্দ্র ঘোষের ছেলে। তার বাকি সহযোগীরা হলেন সোনারগাঁ থানার বড়নগর এলাকার শুবংকর চন্দ্র রাজ বংশী ছেলে কৃষ্ন চন্দ্র রাজ বংশী (৩২), বগুড়া জেলার শেরপুর থানার খাজা আশ্রমপাড়া এলাকার চাঁন শেখ মিয়ার ছেলে এরশাদ (২৪), ছোট অজুর্নদী এলাকার জাকির হোসেন মিয়ার ছেলে রোহান (২১)।
৪ এপ্রিল দুপুর পৌনে ২টায় বন্দর উপজেলার হাজী সাহেবের মোড় এলাকায় ওই ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। ঘটনার ২ দিন পর প্রবাসী উজ্জল হোসেন বাদী হয়ে অজ্ঞাত নামা আসামী করে বন্দর থানায় এ মামলা দায়ের করেন। মামলা নং-১২(৪)২৩। ১৩ মে গভীর রাতে সোনারগাঁ থানার মোগড়াপাড়া এলাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে এদেরকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারকৃতরা বিজ্ঞ আদালতে ছিনতাইয়ের ঘটনায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে জবানবন্দী প্রদান করেছে।
এমন ঘটনায় ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে নারায়ণগঞ্জ জুড়ে। এরই মধ্যে এইকটি প্রভাবশালী চক্র এই ঘটনা ধামাচাপা দিতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। নারায়ণগঞ্জ জেলার আইনশৃংখলা বাহিনীর অসাধু একাধিক চক্র ‘দিনকে রাত, আর রাতকে দিন বানাতে মহাপটু‘ হলেও এই ক্ষেত্রে একেবারেই স্বচ্ছতার পরিচয় দেয়ায় সাধুবাদের ঝড় উঠেছে এই মামলার তদন্ত কর্মকর্তাদের প্রতি।
জানা যায়, নারায়ণগঞ্জ জেলা আওয়ামীলীগের প্রভাবশালীদের শেল্টারে থাকা ছাত্রলীগের তপু চন্দ্র ঘোষ দীর্ঘদিন যাবৎ নানা অপরাধ চালিয়ে আসছিলো ৷ অসংখ্য অপরাধের হোতা ২৯ বছর বয়সী এ তরুণের বাড়ি সোনারগাঁ উপজেলার মোগরাপাড়া ইউনিয়নের অর্জুনদির নিজ গ্রাম ছাড়াও পুরো জেলায় চালাতো অপরাধ কর্মকান্ড ৷ গত ১৩ মে তপু চন্দ্র ঘোষ তার আরও তিন সহযোগীর সাথে গ্রেপ্তার হন ৷
ডিবি পুলিশ সেজে ছিনতাইয়ের মূল হোতা ছাত্রলীগের তপু চন্দ্র ঘোষের সকল অপরাধের ফিরিস্তি তদন্ত পূর্বক উদঘাটনের দাবী করেছে ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা । যারা এখনই তাদের নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করেছেন। কেউ কেউ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ছাত্রলীগ এমন একটা স্বণামধণ্য সংগঠন । আর এই সংগঠনের সুণাম নষ্ট করতে এমন তপু চন্দ্র ঘোষের মতো কয়েকজন ই যথেষ্ঠ । এই তপু চন্দ্র ঘোষ দের খুজে বের করে কঠোর শাস্তি জরুরী। একই সাথে এই তপু চন্দ্র ঘোষদের কাছ থেকে উপহার হিসেবে মিষ্টি মুখ করে পদপদবী দিয়ে আস্কারা দেয় তাদেরও শাস্তির আওতায় আনা দরকার।
পুলিশ বলছে, তপু তার সহযোগীদের নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) পুলিশের পরিচয় দিয়ে এক সৌদ প্রবাসীর ১৭ লাখ টাকা লুট করেছেন ৷
গ্রেপ্তার হবার পর রোববার আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছেন আসামিরা ৷
মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা বন্দর পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ পরিদর্শক রেজাউল করিম বলেন, ‘তপু চন্দ্র ঘোষের নেতৃত্বে ডিবি পরিচয়ে আসামিরা ছিনতাই করে ৷ এর আগেও তারা এই কাজ করেছেন বলে জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছেন ৷ নেতৃত্ব দেবার কারণে টাকা ভাগাভাগির সময় তপু বেশি ভাগ নিতেন বলে অপর আসামিরা জানিয়েছেন ৷’
মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, গত ৪ এপ্রিল বন্দর উপজেলার বন্দর ইউনিয়নের হাজী সাহেবের মোড় এলাকায় ছিনতাইয়ের শিকার হন সৌদি প্রবাসী উজ্জ্বল হোসেন ৷ ডিবি পুলিশ পরিচয় দিয়ে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে আসামিরা । তাঁর কাছ থেকে ১৭ লাখ টাকা ও মোবাইল ছিনিয়ে নেয়৷ দুইদিন পর বন্দর থানায় ছিনতাইয়ের অভিযোগে অজ্ঞাত আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা করেন ভুক্তভোগী ওই সৌদি প্রবাসী ৷
মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব পান পুলিশ পরিদর্শক রেজাউল করিম ৷
তিনি জানান, তদন্তে তপু চন্দ্র ঘোষসহ তার সহযোগীদের সম্পৃক্ততা পায় পুলিশ ৷ অধিকতর তদন্তের পর আসামিদের ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে গত শনিবার রাতে সোনারগাঁয়ের মোগরাপাড়া এলাকাসহ বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে ছিনতাইকারী চক্রের মূলহোতা তপু ও তার তিন সহযোগীকে গ্রেপ্তার করা হয় ৷ গ্রেপ্তার চারজন সরাসরি এ ছিনতাইয়ের ঘটনার সাথে জড়িত৷ তারা দিনের বেলা ডিবি পুলিশ পরিচয় দিয়ে সৌদি প্রবাসীর টাকা ও মোবাইল লুট করে বলে আদালতে ১৬৪ ধারায় দেওয়া জবানবন্দিতে স্বীকার করেছেন ৷
গ্রেপ্তার অন্য তিন আসামিরা হলেন- সোনারগাঁ উপজেলার ছোট অর্জুনদি গ্রামের এলাকার জাকির হোসেনের ছেলে রোহান (২১), একই উপজেলার বড়নগর এলাকার শুভঙ্কর চন্দ্র রাজবংশীর ছেলে কৃষ্ণচন্দ্র রাজবংশী (৩২), বগুড়া জেলার শেরপুরের খাজা আশ্রমপাড়া এলাকার চাঁন শেখ মিয়ার ছেলে এরশাদ (২৪) ৷
তপুর অপর সহযোগী গ্রেপ্তার রোহান সোনারগাঁয়ে ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মী বলে পরিচিত বলে জানান স্থানীয় লোকজন ৷
পুলিশ জানায়, ছিনতাইকারী এ চক্রটির নেতা তপু চন্দ্র ঘোষেরও বাড়ি সোনাগাঁয়ের মোগরাপাড়া ইউনিয়নের অর্জুনদি গ্রামে ৷ সে ওই গ্রামের সাধন চন্দ্র ঘোষের ছেলে ৷
সোনারগাঁয়ের স্থানীয় লোকজন ও ছাত্রলীগ নেতাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, তপু চন্দ্র ঘোষের বাবা সাধন চন্দ্র ঘোষের মিষ্টির দোকান ছিল ৷ স্থানীয়ভাবে তপু সোনারগাঁ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মাহফুজুর রহমান কালামের হাত ধরে রাজনীতিতে আসেন ৷ পরে জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সহ সভাপতি সোহাগ রনির সাথে ঘনিষ্ঠতা তৈরি করেন ৷ এক পর্যায়ে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য একেএম শামীম ওসমানের ছেলে ইমতিনান ওসমান অয়নের ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন ৷ নারায়ণগঞ্জ জেলা ও মহানগর ছাত্রলীগের কোন পদে না থাকলেও সংগঠনের দু’টো কমিটির নেতাদের নিয়ন্ত্রণ করেন অয়ন ওসমান ৷ অয়ন ওসমানের ঘনিষ্ঠ হওয়ায় ২০১৯ সালের জুলাইতে জেলা ছাত্রলীগের কমিটি পূর্ণাঙ্গ করা হলে ওই কমিটিতে ছাত্রলীগের সহসভাপতির মতো গুরুত্বপূর্ণ পদ পেয়ে যান তপু চন্দ্র ঘোষ ৷
স্থানীয়রা জানান, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে মোগড়াপাড়ায় ‘লন্ডন জুস বার অ্যান্ড ক্যাফ’ নামে তপুর একটি ফাস্টফুডের দোকান রয়েছে ৷ গতমাসে দোকানটির কার্যক্রম শুরু করেন তপু ৷
নাম প্রকাশ না করার শর্তে জেলা ছাত্রলীগের এক নেতা বলেন, ‘তপুর গ্রেপ্তারের বিষয়টি নিয়ে ছাত্রলীগ বিব্রত ৷ তপুর শক্ত কোন রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ড নেই ৷ এমপি সাহেবের ছেলের সাথে ঘনিষ্ঠতা থাকায় আগে-পরে ছাত্রলীগে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা না থাকলেও সহসভাপতির পদ বাগিয়ে নেয়৷ পদ দেবার সময় ব্যাকরাউন্ড চেক করে নিলে দলের এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হয় না ৷’
জানতে চাইলে জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি আজিজুর রহমান আজিজ বলেন, ‘আমরা তপু চন্দ্র ঘোষের গ্রেপ্তার হবার বিষয়টি শুনেছি ৷ সে জেলা ছাত্রলীগের সহসভাপতি পদে আছেন ৷ তবে এ বিষয়ে এখন কোন মন্তব্য করতে পারছি না ৷ বিষয়টি নিয়ে সংগঠন সিদ্ধান্ত নেবে ৷’
Discussion about this post