লোমহর্ষক ও চাঞ্চল্যকর নারায়ণগঞ্জের সাত খুন ঘটনার পেরিয়ে গেছে নয় বছর। এখনো হয়নি চূড়ান্ত নিষ্পত্তি। মামলাটি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে ঝুলে থাকায় কার্যকর করা যাচ্ছে না আসামিদের ফাঁসির রায়। মামলায় কাউন্সিলর নূর হোসেন ও সাবেক র্যাব অধিনায়ক তারেক সাঈদসহ ১৫ জনের মৃত্যুদণ্ড দিয়ে রায় ঘোষণা করেছিলেন উচ্চ আদালত।
জানা যায়, ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোড থেকে অপহৃত হন নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম, আইনজীবী চন্দন সরকারসহ সাতজন। এর তিনদিন পর (৩০ এপ্রিল) শীতলক্ষ্যা নদীতে একে একে ভেসে ওঠে ছয়টি মরদেহ। পরদিন মেলে আরেকটি। এ ঘটনায় দুটি মামলা হয়। ২০১৭ সালের ১৬ জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জের বিচারিক আদালত রায় ঘোষণা করেন। এতে ২৬ জনের মৃত্যুদণ্ড দেন আদালত।
পরবর্তীসময়ে ২০১৭ সালের ২২ আগস্ট মামলায় কাউন্সিলর নূর হোসেন, র্যাব-১১ এর সাবেক অধিনায়ক তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, সাবেক র্যাবের কর্মকর্তা আরিফ হোসেন, মাসুদ রানাসহ ১৫ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন হাইকোর্ট। ২০১৮ সালের ১৯ নভেম্বর এ মামলার রায়ের প্রায় ৭০০ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ করা হয়। এরপর হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আসামিরা সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আবেদন করেন। সেই আপিল এখনো নিষ্পত্তি হয়নি। চূড়ান্ত নিষ্পত্তির জন্য শুরু হয়নি শুনানি।
এ বিষয়ে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এস এম মুনীর গণমাধ্যমকে বলেন, ‘সাত খুনের মামলাসহ চাঞ্চল্যকর মামলাগুলো অগ্রাধিকারভিত্তিতে নিষ্পত্তির জন্য এরই মধ্যে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আশা করি দ্রুত শুনানি শুরু হবে।’
আসামি পক্ষের আইনজীবী সিনিয়র অ্যাডভোকেট এস এম শাহজাহান বলেন, ‘আলোচিত এ মামলায় আমিও একজন আসামির আইনজীবী। মামলাটিতে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে দায়ের করা আপিল আবেদন পেন্ডিং। আমরা মামলায় সারসংক্ষেপ এখনো জমা দেইনি। তবে শুনানির জন্য এলে সব প্রস্তুতি রয়েছে।’
আসামিপক্ষের আইনজীবী এফ আর এম লুৎফর রহমান আকন্দ বলেন, ‘এটা তো অনেক বড় মামলা। আপিল শুনানির অংশ হিসেবে আমরা মামলার সারসংক্ষেপ তৈরি করে সেকশনে জমা দিয়েছি। আমরা আসামির মৃত্যুদণ্ড থেকে খালাস চেয়ে আপিল করার যুক্তিগুলো তুলে ধরেছি। আপিল শুনানি শুরুর জন্য আদালতের কাছে প্রার্থনা করবো।’
ঘটনা, বিচারিক আদালত ও হাইকোর্টের রায়
২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোড থেকে অপহৃত হন নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম, আইনজীবী চন্দন সরকারসহ সাতজন। এর তিনদিন পর (৩০ এপ্রিল) শীতলক্ষ্যা নদীতে একে একে ভেসে ওঠে ছয়টি মরদেহ। পরের দিন মেলে আরেকটি। নিহত অন্যরা হলেন—নজরুলের বন্ধু মনিরুজ্জামান স্বপন, তাজুল ইসলাম, লিটন, গাড়িচালক জাহাঙ্গীর আলম ও চন্দন সরকারের গাড়িচালক মো. ইব্রাহিম।
সাত খুনের ঘটনায় প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম ও তার চার সহকর্মী হত্যার ঘটনায় তার স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি বাদী হয়ে ফতুল্লা থানায় একটি এবং সিনিয়র আইনজীবী চন্দন সরকার ও তার গাড়িরচালক ইব্রাহিম হত্যার ঘটনায় তার জামাতা বিজয় কুমার পাল বাদী হয়ে একই থানায় আরেকটি মামলা করেন।
পরে এসব মামলায় ২০১৭ সালের ২২ আগস্ট নারায়ণগঞ্জের বিচারিক আদালত রায় ঘোষণা করেন। এতে ২৬ জনের মৃত্যুদণ্ড দেন আদালত। এদের মধ্যে ১৫ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে বাকি ১১ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন হাইকোর্ট। তাদের ২০ হাজার টাকা করে জরিমানাও করা হয়। অনাদায়ে আরও দুই বছরের সাজা ভোগ করতে হবে। এছাড়া নয়জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেন হাইকোর্ট।
এরপর ২০১৭ সালের ২২ আগস্ট হাইকোর্ট এ মামলার রায় ঘোষণা করেন, যার পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি ২০১৮ সালের ১৯ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। হাইকোর্টের ওই রায়ে বিচারিক আদালতের মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাওয়া ২৬ আসামির মধ্যে বাকি ১১ জনের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। আর মামলার মোট ৩৫ আসামির মধ্যে বাকি ৯ জনের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড বহাল রাখেন হাইকোর্ট।
রায়ে মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকা আসামিরা হলেন- নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের (নাসিক) সাবেক কাউন্সিলর নূর হোসেন, র্যাব-১১ এর চাকরিচ্যুত তিন কর্মকর্তা লে. কর্নেল (অব.) তারেক সাঈদ মুহাম্মদ, মেজর (অব.) আরিফ হোসেন ও লে. কমান্ডার (অব.) মাসুদ রানা।
অন্য যে ১১ জনের ফাঁসির আদেশ বহাল রাখা হয় তারা হলেন- র্যাবের চাকরিচ্যুত সাবেক হাবিলদার মো. এমদাদুল হক, ল্যান্সনায়েক হীরা মিয়া, আরওজি-১ এ বি মো. আরিফ হোসেন, ল্যান্সনায়েক বেলাল হোসেন, সিপাহী আবু তৈয়্যব আলী, কনস্টেবল শিহাব উদ্দিন, এসআই পূর্ণেন্দু বালা, সৈনিক আবদুল আলীম, সৈনিক মহিউদ্দিন মুন্সী, সৈনিক আলামিন শরীফ ও সৈনিক তাজুল ইসলাম। এর মধ্যে মহিউদ্দিন মুন্সী, আলামিন শরীফ ও তাজুল ইসলাম পলাতক।
সাজা কমে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত ১১ আসামি হচ্ছেন- র্যাবের চাকরিচ্যুত সাবেক সিপাহী আসাদুজ্জামান নূর ও সার্জেন্ট এনামুল কবির এবং নূর হোসেনের ৯ সহযোগী মূর্তজা জামান চার্চিল, আলী মোহাম্মদ, মিজানুর রহমান দিপু, আবুল বাশার, রহম আলী, জামাল উদ্দিন সরদার, ভারতে গ্রেফতার সেলিম, সানাউল্লাহ সানা ও শাহজাহান। এদের মধ্যে সেলিম, সানাউল্লাহ সানা ও শাহজাহান পলাতক।
বিচারিক আদালতে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড পাওয়া ৯ জনও র্যাবের বরখাস্ত কর্মকর্তা ও সদস্য। তাদের মধ্যে কনস্টেবল (পরে এএসআই পদে পদোন্নতি পান) হাবিবুর রহমানের ১৭ বছর, এএসআই আবুল কালাম আজাদ, এএসআই কামাল হোসেন, কনস্টেবল বাবুল হাসান, কর্পোরাল মোখলেসুর রহমান, ল্যান্স কর্পোরাল রুহুল আমিন ও সিপাহী নুরুজ্জামানের ১০ বছর করে এবং এএসআই বজলুর রহমান ও হাবিলদার নাসির উদ্দিনের ৭ বছর করে কারাদণ্ডাদেশ বহাল রয়েছে উচ্চ আদালতে। মোখলেসুর রহমান ও কামাল হোসেন পলাতক।
Discussion about this post