শহরের নিতাইগঞ্জ এলাকার আরকে দাস রোডের ইলিয়াস দেওয়ানের দোতালা ভবনে এই দুর্ঘটনা ঘটে। প্রাথমিকভাবে বিস্ফোরণের জন্য গ্যাস লিকেজকে দায়ী করছেন দমকল কর্মীরা। পাশাপাশি ভবন ধ্বসের পেছনে দুর্বল স্থাপনাকে দায়ী করা হয়। প্রায় চার বছর আগে ভবনটি বসবাসের অযোগ্য হিসেবে চিহ্নিত করা হলেও রাজউক এর উদাসীনতার কারনে ভেতরে চলছিলো একাধিক প্রতিষ্ঠানের কাজ ।
পৃথকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা তৈরি করেছে সিটি কর্পোরেশন, রাজউক এবং ফায়ার সার্ভিস। তিনটি প্রতিষ্ঠান থেকে বিভিন্ন সময়ে মোট ২৯১টি ঝুঁকিপূর্ণ ভবন শনাক্ত করলেও নেয়া হয়নি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা। তা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে সচেতন মহলে। উদ্বেগের পাশাপাশি রহস্যের দানা বেধেছে জনমনেও।খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জেলাজুড়ে ১১৪টি ঝুঁকিপূর্ণ ভবন শনাক্ত করেছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। এর আগে ২০১৮ সালের এক জরিপে অধীনস্থ অঞ্চলে ৪২টি ঝুঁকিপূর্ণ ভবন সনাক্ত করে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন। অন্য দিকে তল্লায় মসজিদ বিস্ফোরণ ও রূপগঞ্জে হাসেম ফুডের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড প্রাণহানির পর জেলাজুড়ে ১৩৫টি অগ্নি-ঝুঁকিপূর্ণ ভবন বা স্থাপনা শনাক্ত করেছিল নারায়ণগঞ্জ ফায়ার সার্ভিসের তৎকালীন উপ সহকারী পরিচালক আব্দুল্লাহ আল আরেফিন।এই তালিকায় উঠে এসেছিল বেশকিছু রপ্তানিমুখি শিল্প প্রতিষ্ঠান এবং মসজিদও। যা নথি আকারে প্রেরণ করা হয়েছিল মন্ত্রণালয়ে। যদিও সেই তালিকা বা নথির বিষয়ে অবগত নন নারায়ণগঞ্জ ফায়ার সার্ভিসের বর্তমান উপ সহকারী পরিচালক ফখর উদ্দিন আহাম্মদ।
তথ্য বলছে- পৃথক তিনটি প্রতিষ্ঠানের জরিপে শনাক্ত হওয়া একটি স্থাপনার বিরুদ্ধেও কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে। যদিও ব্যবস্থা নেয়া না নেয়ার বিষয়ে তিনটি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারাই তাদের পক্ষ থেকে ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়েছেন। এক প্রতিষ্ঠান অন্য প্রতিষ্ঠানের দিকে দায়ও চাপাচ্ছেন সুন্দর ভাবে। তবে সচেতন মহলের অভিযোগ, তালিকাভুক্ত ভবন বা স্থাপনা থেকে বিশেষ সুবিধা গ্রহণের কারণেই হয়তো নেয়া হয় না প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা।
এ দিকে ভয়াবহ কোনো দুর্ঘটনা কিংবা প্রাণহানি ছাড়া ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে। গত ১৮ মার্চ নিতাইগঞ্জে ঘটে যাওয়া ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে বিস্ফোরণ-ই এর জ্বলন্ত উদাহরণ হিসেবে দেখছেন নগরবাসী।
জানা গেছে, নিতাইগঞ্জে বিস্ফোরণে ধ্বসে পড়া ওই ভবনটি ২০১৮ সালেই ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে সনাক্ত করেছিল সিটি কর্পোরেশন। পরবর্তী পাঁচ বছরেও ওই ভবনসহ সনাক্ত হওয়া মোট ৪২টি ভবনের মধ্যে একটির বিরুদ্ধেও দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি সিটি কর্পোরেশনকে।
এর মধ্যে গত ১৮ মার্চ নিতাইগঞ্জে অবস্থিত তালিকাভুক্ত ওই ঝুঁকিপূর্ণ ভবন বিস্ফোরণে বিধ্বস্ত হলে দুজন প্রাণ হারান। তবে, জরিপের দীর্ঘ পাঁচ বছর পরেও যেই ভবন অপসারণ হয়নি, প্রাণহানির মাত্র দুদিন পর বিধ্বস্ত সেই ভবন গুড়িয়ে দেয় সিটি কর্পোরেশনের দায়িত্বশীলরা। এতে ৪২টির মধ্যে একটি অপসারণ হলেও এখনো দণ্ডায়মান রয়েছে ৪১টি ঝুঁকিপূর্ণ ভবন। প্রশ্ন উঠেছে, নতুন কোনো প্রাণের বিসর্জন ছাড়া তালিকাভুক্ত অবশিষ্ট ভবনগুলোর বিরুদ্ধে আদৌ কোনো ব্যবস্থা নেবে কী সিটি কর্পোরেশন?
জানতে চাইলে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের নগর পরিকল্পনাবিদ মো. মঈনুল বলেন, ২০১৮ সালে ভবনগুলো শনাক্ত করার পর এগুলো অপসারণের জন্য মালিক পক্ষকে চিঠি দেই। কিন্তু তারা হাইকোর্টে মামলা করে। সেই মামলাকে ঢাল বানিয়ে তারা ভবনের কার্যক্রম চালিয়ে যায়। ফলে আদালতের বিষয় হওয়ায় আমরা কোনো অ্যাকশনেও যেতে পারি না। যেমন হাকিম প্লাজাকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে শনাক্ত করেছি। কিন্তু হাকিম প্লাজার ৯৩ জন উত্তরাধিকার রয়েছে! এ রকম বেশকিছু অভ্যন্তরীণ সমস্যার কারণে বিলম্ব হয়ে থাকে। ভবনগুলোর মালিক পক্ষ মামলা সংক্রান্তের জটিলতা সৃষ্টি করে সুযোগ নেয়।
এ দিকে নারায়ণগঞ্জ জেলাজুড়ে মোট ১১৪টি ঝুঁকিপূর্ণ ভবন সনাক্ত করা রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ রাজউকও অদৃশ্য কারণে তাদের হাত গুটিয়ে নিয়েছে। রাজউকের পক্ষ থেকে তালিকাভুক্ত ভবনগুলোর বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কোন ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। প্রশ্ন উঠেছে, রাজউকও কী তবে নতুন কোনো প্রাণহানির অপেক্ষায় আছেন ?
জানতে চাইলে রাজউকের ৮নং জোনের পরিচালক মোহাম্মদ ইয়াহ্ ইয়া খান বলেন, আমরা নারায়ণগঞ্জে ১১৪টি ঝুঁকিপূর্ণ ভবন শনাক্ত তরে তালিকাভুক্ত করেছি। ভবনগুলোর বয়স, ঝুঁকিপূর্ণ ব্যবহার, অবস্থান, নকশাসহ আনুষঙ্গিক বিষয় পর্যালোচনা করে সাম্প্রতিক সময়ে ওই ঝুঁকিপূর্ণের তালিকা করা হয়েছে। এসকল ভবনগুলোর বিরুদ্ধে পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য তালিকাগুলো কেন্দ্রীয় অফিসে পাঠিয়েছি। সেখান থেকে পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়া হবে। হেড অফিস থেকে আইনি প্রক্রিয়ার বিষয়ে এখনো কোন নির্দেশনা পাইনি। তবে মিটিং হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে যে, অতি ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলোর বিরুদ্ধে দ্রুতই ব্যবস্থা নেয়া হবে।
সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে শনাক্ত হওয়া অবশিষ্ট ৪১টি ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের বিষয়ে জানতে চাইলে ইয়াহ্ ইয়া খান বলেন, সিটি কর্পোরেশন যেহেতু সনাক্ত করেছে, সেহেতু প্রথমত তারা ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। আর যদি রাজউকের কোন সহযোগিতা প্রয়োজন মনে করে, সেক্ষেত্রে রাজউককে অনুরোধ করলে রাজউক সেটা দেখবে।
নারায়ণগঞ্জ ফায়ার সার্ভিসের বর্তমান উপ সহকারী পরিচালক মো. ফখরউদ্দিন আহাম্মদ বলেন, ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে কোনো ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা করা হয়েছে কিনা তা আমার জানা নেই। ১৩৫টি ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা করা হয়েছে কিনা- সেই বিষয়েও আমার কাছে কোনো তথ্য নেই। তবে আমরা মানুষকে সচেতন করার জন্য প্রতি শনিবার রুটিন ওয়ার্ক করি।
এ দিকে তল্লায় মসজিদ বিস্ফোরণ এবং রূপগঞ্জে হাসেম ফুডের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর অগ্নি-ঝুঁকিপূর্ণ ভবন বা অন্যান্য স্থাপনার একটি তালিকা তৈরি করেছিলেন নারায়ণগঞ্জ ফায়ার সার্ভিসের তৎকালীন উপ সহকারী পরিচালক আব্দুল্লাহ আল আরেফিন। তা তিনি প্রেরণ করেছিলেন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোতেও। তবে তিনি নারায়ণগঞ্জ থেকে বদলি হওয়ার পর সেই তালিকার এখন আর হদিস নেই।
Discussion about this post