আবারো আলোচনায় উঠে এসছে রূপগঞ্জের ‘হাসেম ফুডস অ্যান্ড বেভারেজ। ভয়াবহ আগুনের ও্ই ঘটনায় নতুন করে এখন দেশজুড়ে চলছে নানা গুঞ্জন।
২০২১ সালের ৮ জুলাই রূপগঞ্জের হাসেম ফুড কারখানায় আগুনে পুড়ে কর্মকর্তা-শ্রমিকসহ ৫৪ জনের মৃত্যুর ঘটনায় ভুলতা পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক নাজিম উদ্দিন বাদী হয়ে কারখানার মালিক আবুল হাসেম ও তার চার ছেলেসহ ৮ জনকে আসামি করে হত্যা মামলা করেন।
এর এক দিনের মধ্যে ৯ জুলাই দেশের করিতকর্মা আইনশৃংখলা বাহিনীর সদসরা হত্যা ও হত্যার অভিযোগে ৩০২, ৩২৬, ৩২৫, ৩২৩, ৩২৪, ৩০৭ ধারায় সজীব গ্রুপের চেয়ারম্যান মো. আবুল হাসেমসহ আটজনকে গ্রেফতার করা হয়েছিলো। গ্রেফতার আটজন হলেন- সজীব গ্রুপের চেয়ারম্যান মো. আবুল হাসেম (৭০), তার ছেলে হাসীব বিন হাসেম ওরফে সজীব (৩৯), তারেক ইব্রাহীম (৩৫), তাওসীব ইব্রাহীম (৩৩), তানজীম ইব্রাহীম (২১), শাহান শান আজাদ (৪৩), মামুনুর রশিদ (৫৩) ও মো. সালাউদ্দিন (৩০)।
এমন ঘটনায় ২০২১ সালের ১০ জুলাই গ্রেফতার ৮ জনকে সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ফাহমিদা খাতুনের আদালতে ৩০২, ৩২৬, ৩২৫, ৩২৩, ৩২৪, ৩০৭ ধারায় হত্যা এবং হত্যা প্রচেষ্টার অভিযোগে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১০ দিন করে পুলিশ রিমান্ড আবেদন করলে আদালত প্রত্যেককে চার দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
রিমান্ডে শেষে আদালতে উপস্থাপনের পর ১৯ জুলাই চাঞ্চল্যকর এবং রোমহর্ষক এমন ৫৪ জন হত্যা মামলার আসামী সজীব গ্রুপের চেয়ারম্যান মো. আবুল হাসেম (৭০), তার ছেলে হাসীব বিন হাসেম ওরফে সজীব (৩৯), তারেক ইব্রাহীম (৩৫)। এর আগে জামিন পান তাওসীব ইব্রাহীম (৩৩), তানজীম ইব্রাহীম (২১) কে নারায়ণগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ আনিসুর রহমান জামিন মঞ্জুর করেন ।
পরবর্তীতে ২০২৩ সালের ৩ সেপ্টেম্বর (রোববার) দুপুরে সিআইডির নারায়ণগঞ্জ অফিসের পরিদর্শক মোকছেদুর রহমান ১৩ পৃষ্ঠার এই অভিযোগপত্র দাখিল করেন। সোমবার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন কোর্ট পুলিশের পরিদর্শক আসাদুজ্জামান। অভিযোগপত্রভুক্ত আসামিরা হলেন-কারখানার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শাহেন শাহ আজাদ (৪৩), উপ-মহাব্যবস্থাপক মামুনুর রশিদ (৫৪), সিভিল ইঞ্জিনিয়ার কাম প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. সালাউদ্দিন (২৬) ও প্রধান প্রকৌশলী (মেকানিক্যাল ও ইলেকট্রিক) ওমর ফারুক (৩৮), কল কারখানা প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর নারায়ণগঞ্জ অফিসের পরিদর্শক নেছার উদ্দিন (৪০) ও সৈকত মাহমুদ (৩৭)।
এমন চাঞ্চল্যকর ও লোকহর্ষক ৫৪ জন নিরীহ শিশু ও নারী শ্রমিক হত্যা মামলায় দ্রুত জামিন ও মামলা থেকে অব্যাহতির ঘটনায় ব্যাপক সমালোচনা এখনো চলছে সর্বত্র ।
এতো সমালোচনার পর (এপ্রিল ফুল পহেলা এপ্রিলের পর দিন) অর্থাৎ মঙ্গলবার (২ এপ্রিল) দুপুরে শ্রম আদালতের বিচারক কিরণ শঙ্কর হালদার এই পরোয়ানা জারি করেন সজীব গ্রুপের চেয়ারম্যান ও এমডি মোহাম্মদ আবুল হাসেম । যার কারণে এবার ব্যাপক গুঞ্জনের ঝড় উঠেছে ।
কে এই এতো ক্ষমতাধর হাসেম ?
প্রতিষ্ঠানটির মালিক সজীব গ্রুপের চেয়ারম্যান ও এমডি মোহাম্মদ আবুল হাসেম। তার বাড়ি লক্ষ্মীপুরে। গত বৃহস্পতিবারের এই অগ্নিকাণ্ডকে ব্যবসায়িক জীবনের বড় ধাক্কা হিসেবে দাবি করে হতাহত শ্রমিকদের পরিবারের পাশে থাকার কথা বলেছিলেন এই শিল্পপতি। তবে শেষ রক্ষা হয়নি। অর্ধশতাধিক মানুষের প্রাণহানির ঘটনায় চার ছেলেসহ তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ইতিমধ্যে পুলিশ তাদের চার দিনের রিমান্ডে পেয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০০৮ সালে লক্ষ্মীপুর-৩ (সদর) আসনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ থেকে সংসদ নির্বাচনে নৌকা প্রতীকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন এই শিল্পপতি। সেই নির্বাচনে হেরে যান বিএনপি প্রার্থীর কাছে। পরে আর রাজনীতির মাঠে তাকে দেখা যায়নি। দলে কোনো পদ-পদবিও নেই। সাবেক আলোচিত সেনাপ্রধান মঈন ইউ আহমেদের সঙ্গে আত্মীয়তার সূত্রে তিনি মনোনয়ন পেয়েছিলেন বলে গুঞ্জন আছে রাজনৈতিক মহলে। এই শিল্পপতি মঈন ইউ আহমেদের মেয়ের ভাসুর বলে জানা গেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার চন্দ্রগঞ্জে মোহাম্মদ আবুল হাসেমের জন্ম। শুরুর দিকে তার ব্যবসা ছিল চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জকেন্দ্রিক। আবুল হাসেমের ব্যবসা বড় হওয়া শুরু হয় মূলত আলোচিত এক-এগারোর পর থেকে। নিজের ছেলের নামে গড়েন ‘সজীব গ্রুপ’। প্রতিষ্ঠানটির অঙ্গপ্রতিষ্ঠান হাসেম ফুড অ্যান্ড বেভারেজের ‘সেজান জুস’ ব্যবসায়িকভাবে বেশ ভালো অবস্থানে রয়েছে।
স্থানীয়রা জানান, আবুল হাসেম আলোচিত এক-এগারোর পর ব্যবসায়িকভাবে অনেকটা ফুলে-ফেঁপে উঠতে থাকেন। শুধু তাই নয়, সাবেক সেনাপ্রধান মঈন ইউ আহমেদের সঙ্গে আত্মীয়তার সুবাদে আওয়ামী লীগ থেকে সংসদ নির্বাচনে মনোনয়নও বাগিয়ে নেন এই শিল্পপতি।
২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে লক্ষ্মীপুর-৩ আসনে বিএনপির প্রার্থী শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানীর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন আবুল হাসেম। সারাদেশে ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট বিপুল জয় পেলেও হেরে যান নৌকার এই প্রার্থী। পরে আর নির্বাচন বা রাজনৈতিক কোনো কর্মকাণ্ডে আবুল হাসেমকে জড়াতে দেখা যায়নি।
ওই নির্বাচনে শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানী পেয়েছিলেন এক লাখ নয় হাজার ৬৩১ ভোট। আর আওয়ামী লীগ থেকে মোহাম্মদ আবুল হাসেম পেয়েছিলেন ৮২ হাজার ৫০ ভোট।
জানা যায়, দলের কোনো পদ-পদবি না থাকলেও ওই সময় ওয়ান ইলেভেনের প্রভাবশালী ব্যক্তি মঈন ইউ আহমদের আত্মীয় হিসেবেই তাকে মনোনয়ন দেয় আওয়ামী লীগ। দলটির স্থানীয় নেতাকর্মীরা বিষয়টি স্বাভাবিকভাবে নিতে না চাইলেও দলীয় সিদ্ধান্ত মানতে বাধ্য হন।
স্থানীয় সূত্র বলছে, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে না থাকার পরও হঠাৎ করে দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার ঘটনা এলাকায় তখন বেশ চমক সৃষ্টি করে। তবে হেরে যাওয়ার পর আর তেমন কোনো সক্রিয়তা ছিল না বিশিষ্ট এই ব্যবসায়ীর। এছাড়া স্থানীয়ভাবে জনকল্যাণমূলক কাজেও খুব বেশি সম্পৃক্ততা নেই বলে জানা গেছে। কালেভাদ্রে গ্রামের বাড়িতে যান সজীব গ্রুপের চেয়ারম্যান ও এমডি।
জানা যায়, দেশজুড়ে বাজারজাত হওয়ায় সেজান জুসের মূল প্রতিষ্ঠান পাকিস্তানে। লাহোরে অবস্থিত সেজান ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড দেশটির পানীয় প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান। এটি দেশটির বৃহত্তম খাদ্য ও পানীয় উৎপাদনকারীদের একটি। জুস নিয়ে দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা ও যোগাযোগের ফলে আবুল হাসেম এক ধরনের ফ্রাঞ্চাইজি নিয়ে দেশে সেজান জুস উৎপাদন করেন।
‘সজীব গ্রুপ’ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ফুডস অ্যান্ড বেভারেজ ছাড়াও তাদের বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ব্যবসায়িক এই গ্রুপটি ১৯৮২ সালে তাদের কার্যক্রম শুরু করে।
তাদের সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলো হলো- সজীব করপোরেশন, হাশেম ফুডস লিমিটেড, হাশেম অটো রাইস মিলস, সজীব ফুডস অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেড, হাসেম এগ্রো প্রসেসিং লিমিটেড, তাকফুল ইসলামী বীমা লিমিটেড, হাসেম ফ্লাওয়ার মিলস লিমিটেড, সজীব হোমস লিমিটেড, মারস ইন্টারন্যাশনাল, সজীব লজিস্টিকস ও স্যাভি ফুডস।
সজীব গ্রুপের দাবি, তাদের সব ধরনের পণ্য উৎপাদন প্রক্রিয়া মানের নিয়ন্ত্রণ (পিকিউসি) করা হয়। আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখতে উৎপাদন প্রক্রিয়ার প্রতিটি স্তরে সর্বোত্তম গুণমান নিশ্চিত করায় সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার দেয়া হয়।
গত বৃহস্পতিবার আবুল হাসেমের প্রতিষ্ঠানে লাগা আগুনে ৫২ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন অর্ধশতাধিক শ্রমিক। এই ঘটনায় দায়ের করা মামলায় আবুল হাসেম ও তার চার ছেলেসহ আটজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
এই ধরনের ঘটনাগুলোতে এর আগে অবহেলাজনিত মৃত্যুর অভিযোগ আনতে দেখা গেলেও রূপগঞ্জের ভুলতা পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক নাজিম উদ্দিন মজুমদারের করা এই মামলায় ৩০২ ধারায় সরাসরি হত্যার অভিযোগ আনা হয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল আগুনের পোড়া কারখানা পরিদর্শনকালেও বলেছেন, এটি সরাসরি হত্যাকাণ্ড।
গ্রেপ্তার আসামিদের মধ্যে হাসেমের চার ছেলে রয়েছেন, যারা কোম্পানির পরিচালক। তারা হলেন- হাসীব বিন হাসেম, তারেক ইব্রাহীম, তাওসীব ইব্রাহীম, তানজিম ইব্রাহীম।
এছাড়া সজীব গ্রুপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শাহানশাহ আজাদের সঙ্গে আসামি হিসেবে গ্রেপ্তার হয়েছেন হাসেম ফুডসের উপমহাব্যবস্থাপক মামনুর রশীদ এবং প্রতিষ্ঠানটির প্রশাসনিক কর্মকর্তা প্রকৌশলী মো. সালাউদ্দিন। নারায়ণগঞ্জের একটি আদালত শনিবার তাদের প্রত্যেককে চার দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেছে।
Discussion about this post