ওমরাহ হজ পালন করতে গিয়ে পবিত্র কাবা শরিফের সামনে দাঁড়িয়ে গত ২৮ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার নারায়ণগঞ্জের মাদক, সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজী নির্মূলের শপথ নিয়েছেন নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য একেএম শামীম ওসমান । এরই ধারাবাহিকতায় ৭ জানুয়ারী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের পর মাদক, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, ভূমিদস্যুতা বন্ধ করতে সামাজিক উদ্যোগ নেওয়ার ব্যাপারে তাগিদ দিচ্ছিলেন নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের প্রভাবশালী সংসদ সদস্য একেএম শামীম ওসমান।
ওসমান পরিবারের অনুসারী হিসেবে ব্যাপক পরিচিত রাজনীতিবিদ ছাড়াও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার প্রতিনিধিদের নিয়ে আয়োজিত এ সভায় বিতর্কিত জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক কর্মীদের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত হয় সমাবেশ।
অনুষ্ঠিত সমাবেশে হত্যা, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, জমি দখল, মাদক ব্যবসা, প্রতারণা ও দুদক মামলার আসামীদেরও দেখা গেছে। এতে শুরুতেই প্রশ্নের মুখে পড়েছে তাঁর এই সামাজিক ও অরাজনৈতিক ‘মহতী উদ্যোগ’।
২৭ জানুয়ারী শনিবার বিকেলে অনুষ্ঠিত এই সমাবেশে দেখা গিয়েছে কলাগাছিয়া ইউপি চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেন, বন্দর ইউনিয়ন চেয়ারম্যান এহসান আহাম্মেদ, নাসিকের ১৭ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আব্দুল করিম বাবু, ৬ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মতিউর রহমান মতি, সাবেক কাউন্সিলর সিরাজুল ইসলাম মন্ডল, সাবেক কাউন্সিলর সাইফুদ্দিন আহমেদ দুলাল প্রধান, সাত খুন হত্যা মামলার প্রধান আসামি নূর হোসেনের ভাই নূর উদ্দিন মিয়া ও ভাতিজা শাহজালাল বাদল, কাউন্সিলর সুলতান আহাম্মেদ, গোগনগর ইউপি চেয়ারম্যান ফজর আলী, সাবেক কাউন্সিলর সিরাজুল ইসলাম মন্ডল, সিদ্ধিরগঞ্জের স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা শফিকুল ইসলামসহ কয়েকজনকে। যারা বিভিন্ন সময় হত্যা, চাঁদাবাজি, মাদক ও দুর্নীতিসহ বিভিন্ন বিতর্কিত কর্মকান্ডে জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। কেউ কেউ এসব কর্মকান্ডের কারণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তারও হয়েছেন।
নাসিকের ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও মহানগর আওয়ামী লীগের সদস্য আবদুল করিমের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজিসহ দু’টি মামলা বিচারাধীন। এর আগে ডাকাতির মামলাসহ সাতটি মামলা ছিল তাঁর বিরুদ্ধে, যেসব মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে।
২৩টি মামলা রয়েছে ৬ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও সিদ্ধিরগঞ্জ থানা যুবলীগের সভাপতি মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে । এসব মামলার মধ্যে আছে হত্যা, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, জমি দখল, দাঙ্গা-হাঙ্গামার ঘটনার সাথে জড়িত থাকার অভিযোগ। কাউন্সিলর মতি ও তাঁর স্ত্রীর বিরুদ্ধে সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশন মামলাও করেছে। তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও মানি লন্ডারিং এর অভিযোগে মামলার চার্জশিটও দিয়েছে দুদক।
এই ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর সিরাজুল ইসলাম মন্ডলের বিরুদ্ধেও রয়েছে নানা বিতর্কিত কর্মকান্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে জোড়ালোভাবে।
৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী সিদ্ধিরগঞ্জ থানা ছাত্রলীগের আহ্বায়ক শাহজালাল বাদল সাত খুন মামলার প্রধান আসামি নূর হোসেনের আপন ভাতিজা। তাঁর বিরুদ্ধে সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজির ৮টি মামলা এবং যশোরের কোতোয়ালি থানায় ১টি প্রতারণার মামলা রয়েছে।
নূর হোসেনের ভাই নূরউদ্দিন মিয়া প্রার্থী হয়েছেন ৪ নম্বর ওয়ার্ডে। তাঁর বিরুদ্ধে অস্ত্র, মাদক, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অপরাধের আটটি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে দুটিতে খালাস পেয়েছেন। কাউন্সিলর সুলতানের বিরুদ্ধে বিস্ফোরক ও চাঁদাবাজিসহ চারটি মামলা বিচারাধীন আছে।
স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সাইফুদ্দিন দুলালের বিরুদ্ধে মাদকসহ তিনটি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। তিনি মাদকসহ পুলিশের হাতে গ্রেপ্তারও হয়েছিলেন।
নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা শফিকুল ইসলামের ছেলে রাইসুল ইসলাম সীমান্তকে কিশোর গ্যাং ‘টেনশন গ্রুপ’ পরিচালনার অপরাধে র্যাব গ্রেফতার করে। শফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে সিদ্ধিরগঞ্জে ডিলারসহ টিসিবির পণ্যসামগ্রীর গাড়ি ছিনিয়ে নেয়ার অভিযোগ উঠে। শফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে হত্যা, অস্ত্র, চাঁদাবাজির আটটি মামলা ছিল। সবকটি থেকে তিনি খালাস পেয়েছেন।
এদিকে, ‘রাজাকারপুত্র’ মুছাপুর ইউপি চেয়ারম্যান মাকসুদ হোসেন, তার স্ত্রী নার্গিস বেগমের বিরুদ্ধে অন্যের সম্পত্তি জাল দলিল করে দখলের অভিযোগে ২০১৫ সালে মামলা হয়। এছাড়া তার ছেলে মাহমুদুল হাসান শুভর বিরুদ্ধে পুলিশের উপর হামলা, জমি বিরোধে হামলা, টাকা লুটের মতো অভিযোগ আছে।
গোগনগর ইউপি চেয়ারম্যান ফজর আলীর বিরুদ্ধে তাঁর এলাকায় কিশোর গ্যাং গ্রুপ ‘বিচ্ছু বাহিনী’ পরিচালনা ও ভূমিদস্যুতার অভিযোগ রয়েছে। সাবেক ইউপি মেম্বার দৌলত হোসেন হত্যার ঘটনাতেও ফজর আলীর পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত ‘বিচ্ছু বাহিনী’ জড়িত ছিল বলে অভিযোগ।
মাদক, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে শামীম ওসমানের অবস্থান বিভিন্ন মহলে যেমন প্রশংসা পেয়েছে, তেমনি সমালোচিতও হচ্ছে তাঁর ডাকা সুধী সমাবেশে বিতর্কিত লোকজনের উপস্থিত থাকার বিষয়টি। অনেকে বলছেন, মাদক, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, ভূমিদস্যুতার বিরুদ্ধে শামীম ওসমান আওয়াজ তুলেছেন ঠিকই কিন্তু তাঁর এই উদ্যোগ যাদের নিয়ে বাস্তবায়ন করতে চাচ্ছেন তারা নিজেরাই এইসব কর্মকান্ডের সাথে জড়িত। বিতর্কিতদের পাশে রেখে এমন উদ্যোগ ‘স্ট্যান্টবাজি’ কিনা তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে বিভিন্ন মহলে।
শামীম ওসমানের এমন সমাবেশের পর এই অনুষ্টানে উপস্থিত থাকা ইউনিয়ন পর্যায়ের কয়েকজন নেতা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ওসমান পরিবার রাজনৈতিক পরিবার এতে কোন সন্দেহ নাই । আমরা ভালোবেসেই এই ওসমান পরিবারের সকল সভা সমাবেশে ডাক দিলেই আসি। কিন্তু সকল অনুষ্ঠানে এসেই দেখি ওসমান পরিবারের নেতাদের আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে বিতর্কিতরা। যারা সমজে অত্যান্ত ঘৃণিত। নাসিম ওসমানের নির্বাচনকালীন সময়ে বিদেশে থাকাবস্থায় যে শামীম ওসমান বিতর্কিতদের কেউ কোন মিছিল মিটিং সমাবেশে যাতে না থাকে সেলক্ষ্যে দফায় দফায় দিকনির্দেশনা দিতেন। আর এখন অসংখ্য বিতর্কিতরা শামীম ওসমানকে মধ্যমনি হিসেবে বিবেচনা করে নিজেদের স্বার্থ হাসিলে ব্যস্ত থাকে। যার কারণে ওসমান পরিবারের বিরোধীরা আরো কঠোরভাবে কথা বলার সুযোগ পায়।
Discussion about this post