ফতুল্লার পোশাক কারখানা ফকির এপারেলসে আগুন নেভাতে যাওয়ার পথে গাড়ি চালানো অবস্থায় স্ট্রোক করে মারা যাওয়া ফায়ার সার্ভিসের গাড়িচালক জাহাঙ্গীর হোসেন এর আগেও একবার স্ট্রোক করেছিলেন।
চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে তিনি আবার চাকরিতে যোগ দেন। তবে তার কোনো শারীরিক সমস্যা ছিল না।
জাহাঙ্গীর হোসেনের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে এমনটাই জানা গেছে।
এর আগে সোমবার (২৪ জুলাই) বেলা সাড়ে ১১টায় নারায়ণগঞ্জ শহরের চাষাঢ়ায় শান্তনা মার্কেটের সামনে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি চালানো অবস্থায় স্ট্রোক করে চালক জাহাঙ্গীর হোসেনের মৃত্যু হলে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দুর্ঘটনা ঘটে।
এ সময় ঘটনাস্থলেই সালাউদ্দিন নামের এক পথচারী মারা যান। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সিরাজুল ইসলাম (৫০) নামে আরও একজনের মৃত্যু হয়।
এ ঘটনায় ফায়ার সার্ভিসের চালকসহ তিনজন মারা গেছেন। আহত অবস্থায় চিকিৎসাধীন ছয়জন। তাদের মধ্যে একজনের অবস্থা গুরুতর।
ফায়ার সার্ভিসের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রোববার (২৩ জুলাই) রাতে ফতুল্লা এলাকার একটি ডাইং কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। সেখানেও ফায়ার সার্ভিসের ফায়ারম্যান জাহাঙ্গীর হোসেন গিয়েছিলেন।
আগুন নিভিয়ে এসে তিনিই সবকিছু গোছান।
এরপর সকাল সাড়ে ১০টায় ফতুল্লা বিসিক এলাকায় ফকির অ্যাপারেলসে অগ্নিকাণ্ডের খবর আসে। খবর আসার সঙ্গে সঙ্গে জাহাঙ্গীর হোসেন গাড়ি নিয়ে ছোটেন। তিনি অনেক দ্রুত যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন। দ্রুত গাড়ি চালাতে গিয়ে মাঝখানে কয়েকবার গতিরোধকের সামনে গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করতে হিমশিম খেয়ে যান। এরপর চাষাঢ়া এলাকার মোড়ে যাওয়ার সময়ই জাহাঙ্গীর স্ট্রোক করেন।
এসময় গাড়িটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে যাত্রীবাহী আনন্দ বাসসহ কয়েকটি মিশুক গাড়িকে ধাক্কা দেয়। সবশেষ একটি ট্রাকের সামনে গিয়ে ফায়ার সার্ভিসের গাড়িটি থেমে যায়। সেইসঙ্গে গাড়িতে থাকা অন্য সদস্যরা লাফিয়ে নেমে জাহাঙ্গীরকে উদ্ধার করেন। গাড়ির সিটের মধ্যে জাহাঙ্গীর নিথর হয়ে পড়ে ছিলেন। পরে তাকে সদর জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক নাজমুল হোসেন বিপুল মৃত ঘোষণা করেন।
ঘটনাস্থলে থাকা নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আনিচুর রহমান বলেন, ফতুল্লায় অগ্নিকাণ্ডের খবর পেয়ে নারায়ণগঞ্জের হাজিগঞ্জ ফায়ার সার্ভিসের একটি গাড়ি যাওয়ার পথে শান্তনা মার্কেটের সামনে চালক হঠাৎ অসুস্থ হয়ে মারা যান। এতে গাড়িটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বাস, প্রাইভেটকার ও অটোরিকশাকে চাপা দেয়। এসময় গাড়ির নিচে চাপা পড়ে এক পথচারী ঘটনাস্থলেই মারা যান। হতাহতদের মধ্যে দুজনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে পাঠানো হয়েছে। বাকিরা খানপুর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
জাহাঙ্গীর হোসেন চাঁদপুরের মৃত আব্দুল আজিজের ছেলে। তিনি ১৯৯৪ সালে চাকরিতে যোগদান করেন। তার দুই ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে।
জাহাঙ্গীরের মৃত্যুর খবর পেয়ে পরিবারের সদস্যরা নারায়ণগঞ্জে ছুটে আসেন। হাসপাতালে মরদেহের সামনে আহাজারি করতে থাকেন স্বজনরা।
আহাজারি করতে করতে স্ত্রী রেখা বলেন, ‘আমার ছেলেমেয়েরা এখন কোথায় যাবে ? কে দেখবে তাদের ? আমার স্বামী আমাকে কখনো কষ্ট পেতে দিতেন না। সবসময় পরিবারের খোঁজখবর নিতেন। কখনো দায়িত্ব অবহেলা করতেন না। ছুটি শেষ হওয়ার আগেই চলে আসতেন। আমি আর আমার স্বামীকে পাবো না।’
জাহাঙ্গীর হোসেনের ভাগনে শান্ত বলেন, ‘আমার আংকেল অনেক ভালো ছিলেন। সবসময় আমাদের খোঁজখবর রাখতেন। এর আগে, সম্ভবত ২০১৮ সালে একবার স্ট্রোক করেছিলেন। পরে তিনি সুস্থ হয়ে গিয়েছিলেন। সুস্থ হয়ে আবার ডিউটিতে যোগ দেন। স্ট্রোক করলেও তার শারীরিক কোনো সমস্যা ছিল না।’
তবে স্ট্রোক করার বিষয়ে স্ত্রী রেখার কাছে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি এড়িয়ে গিয়ে বলেন, ‘সকালেই আমার সঙ্গে কথা হয়েছে। তিনি সুস্থই ছিলেন। তার কোনো অসুস্থতা ছিল না। আগে কখনো এরকম হয়নি।’ এসময় পাশ থেকে অপর এক আত্মীয় বলেন, আগেও একবার স্ট্রোক হয়েছিল।
এদিকে চোখের অশ্রুতে সহকর্মীকে বিদায় দিয়েছেন জাহাঙ্গীর হোসেনের সহকর্মীরা। শহরের হাজীগঞ্জ ফায়ার স্টেশনে যেখানে তিনি কর্মরত ছিলেন সেখানে তার জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজা শেষে মোনাজাতে তার সহকর্মীরা কান্নায় ভেঙে পড়েন। জানাজায় উপস্থিত ছিলেন ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের পরিচালক (অপরাশেন) লে. কর্নেল তাজুল ইসলাম চৌধুরী।
নারায়ণগঞ্জ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সিনিয়র স্টেশন অফিসার হামিদুর রহমান বলেন, ‘তিনি সুস্থই ছিলেন। সুস্থ অবস্থায়ই হাজীগঞ্জ থেকে গাড়ি চালিয়ে চাষাঢ়া এলাকা পর্যন্ত এসেছিলেন। সুস্থ না থাকলেতো চাষাঢ়া পর্যন্ত আসা সম্ভব হতো না।’
উপ-সহকারী ফখর উদ্দিন আহাম্মদ বলেন, ‘চাষাঢ়া এলাকায় যাওয়া মাত্রই গাড়ি চালানো অবস্থায় স্ট্রোক করে মারা গিয়েছেন জাহাঙ্গীর হোসেন। পথচারী নিহত ও আহতসহ অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। তবে আমাদের ফায়ার সার্ভিসের কোনো সদস্য আহত হননি।’
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের পরিচালক লে. কর্নেল তাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘উনি স্ট্রোক করেই মারা গেছেন। আমরা এরকম মৃত্যু আশা করি না। তারপরও আল্লাহর কাছে দোয়া করি এটা যেন শহিদি মৃত্যু হয়। উনি কাজ করতে করতে মারা গিয়েছেন। আমরা এ ধরনের মৃত্যুকে শহিদি মর্যাদার মৃত্যু হিসেবে গণ্য করি।’
Discussion about this post