“নারায়ণগঞ্জের একজন কুখ্যাত রাজাকার পুত্র সাম্প্রতিক সময়ে একজন শীর্ষ বিচারক কে ব্যবহার করে আদালত থেকে নানা পন্থায় শত শত কোটি টাকার বাণিজ্য করার অভিযোগ উঠেছে। ওই কুখ্যাত রাজাকারের পুত্র তার ভাগ্নিকে দিয়ে তৎসময়ে আদালতের একটি সিন্ডিকেট গড়ে তুলে । যার কাজ হলো আদালত থেকে নানাভাবে ফায়দা লুটপাট করা। এই সিন্ডিকেট টি অত্যান্ত কৌশলে টেন্ডার ও নিলাম বাণিজ্য এককভাবে নিয়ন্ত্রক হিসেবে কাজ করছে । যাদের বলা হচ্ছে মামা ভাগ্নির আদালত। এই সিন্ডিকেট টির নেপথ্যের পরিচালক কুখ্যাত রাজাকার পুত্র । একাধিক সংসদ সদস্যগণের নাম ব্যবহার করে যিনি নেপথ্যে থেকে ফোনে ফোনে কাজ করেন। আর ভাগ্নি কাজ করেন আদালতে আইনজীবী হিসেবে। আদালতের পেসকার, পিয়ন, ওমেদারসহ সংশ্লিষ্টদের ব্যবহার করে এক ধরণের লুটপাটের আখড়ায় পরিণত করা হয়েছে নারায়ণগঞ্জ আদালত কে।
বিচার ব্যবস্থার সুণাম রক্ষায় নারায়ণগঞ্জ আদালতের এমন কর্মকান্ডের অভিযোগ যাচাই করে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবী উঠেছে।
- পিয়ন, পেশকার, পুলিশকে বকশিশ না দিলে মেলে না সেবা
- বকশিশ বাণিজ্য ঠেকানোর কার্যকরী উদ্যোগ নেই
- আদালত সংশ্লিষ্টদের নীরবতার সুযোগ নিচ্ছেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা
- আদালত-পুলিশ ও কর্মচারীদের কাছে জিম্মি আইনজীবীরাও
- বকশিশ বন্ধে কঠোর নির্দেশনা চান বিচারপ্রার্থীরা
থানায় মামলা হওয়ার পরই এজাহার পাঠিয়ে দেয়া হয় আদালতে। আসামি গ্রেপ্তার হলে পুলিশ প্রতিবেদনসহ আসামিকে আদালতে হাজির করা হয়। শুরু হয় আইনি লড়াই। এখানে থেকে শুরু হয় ঘাটে ঘাটে টাকা দেয়ার খেলাও। চলতে থাকে বছরের পর বছর ধরে। মূলত মামলার নথি দেখা, হাজিরা দেয়া, ওকালতনামায় সই করা, জামিননামা দেয়া, মামলা লিস্টে আনা, শুনানির সিরিয়াল এগিয়ে আনা, জামিনের শুনানি করা, মামলার নকল তোলাসহ মামলাসংক্রান্ত যেকোনো সেবায় বকশিশ বা খরচাপাতি ছাড়া এখন চলেই না।
বকশিশের পরিমাণ কখনো ১০০ টাকা, আবার কখনো দুই হাজারও ছাড়িয়ে যায়। এতে নিন্ম আদালতে আসা বিচারপ্রার্থীরা পদে পদে চরম হয়রানি ও ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। যেনো দেখার নেউ নেই। যুগের পর যুগ বকশিশ বাণিজ্যে আটকে আছেন বিচারপ্রার্থীরা। বকশিশ ছাড়া মেলে না সেবা। মামলার ফাইলও নড়ে না। ফলে বাধ্য হয়েও গুনতে হচ্ছে কাড়ি কাড়ি টাকা।
এতে অতিরিক্ত মামলা ব্যয়ে নিঃস্ব অনেকে। কেউ কেউ মামলা চালাতে গিয়ে বিক্রি করছেন স্ত্রীর গয়না পৈত্রিক জমি। তবুও সহসা নিস্তার মিলছে না খরচাপাতি বাণিজ্য থেকে। তবে বিচারপ্রার্থীরা নিঃস্ব হলেও অর্থ-বিত্তে ফুলে-ফেঁপে উঠছে আদালত কেন্দ্রিক পেশাজীবী শ্রেণি। কেউ কেউ গড়ছেন আলিশান অট্টালিকাও। আইন আদালতের বিষয়ে বহুকাল থেকে একটা কথা প্রচলিত রয়েছে – ‘আদালতের ঘাষ (দূর্বা) ঘুষ খায়’। বাস্তবেও তার ব্যতিক্রম নয়।
আদালতে এলেই ঘাটে ঘাটে দিতে হয় বকশিশ। অধিকাংশ সময় আইনজীবীরা এসব বকশিশ বা খরচাপাতি নেন সহকারীদের মাধ্যমে। তবে এত সবের পরও আদালত কেন্দ্রীক দুর্নীতি ঠেকানোর কোনো কার্যকরী উদ্যোগ লক্ষ করা যায়নি কখনোই। এ বিষয়ে নেই কোনো নজরদারিও। সংশ্লিষ্ট সবার সামনেই ঘটছে এসব খরচাপাতি বাণিজ্য। এদিকে আদালতে এসব বকশিশ বা খরচাপাতির ব্যবস্থা চরম দুর্নীতির বহিঃপ্রকাশ বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। এ নীরবতার সুযোগ নিয়ে উৎসাহিত হয় আদালতের এক শ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারী।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, নিন্ম আদালতে অনিয়মের চিহ্নিত স্থানগুলো হলো – ফাইলিং শাখা, সেরেস্তা, জিআর শাখা, আদালতের পেশকার, উমেদার, মামলার জিআরও, আদেশ লিখতে সংশ্লিষ্ট কম্পিউটার অপারেটর, বিচারকদের আরদালি (যিনি বিচারকের চেয়ার ঠিক করে দেন), আদালতের পিয়ন, সমন জারিকারক, আইটি সেকশন ও ডেসপাস শাখা। এসব জায়গায় বেশির ভাগ কর্মচারী অনিয়মের সাথে জড়িত। টাকা না দিলে ফাইল নড়ে না। টাকা দিলে কাজ হয় দ্রুতগতিতে। তাই আদালতাঙ্গনে অনিয়মের এই টাকা দেয়াকে বলা হয় খরচাপাতি। তবে বকশিশ ও খরচাপাতিকে আদালতের
উকিল, মুহুরি, পিয়ন, পেশকার ও পুলিশ কেউই এটাকে ‘ঘুষ’ বলতে নারাজ। তাদের ভাষ্য – নির্বিঘ্নে কাজ শেষ করতে ‘বকশিশ’ দিতে হয় অনেককে।
সরেজমিন দেখা যায়, ওকালতনামায় আসামিপক্ষ থেকে ১০০ থেকে ৫০০ টাকা, জামিন শুনানির পুটআপ নিতে সংশ্লিষ্ট আদালতের কর্মচারী, পিয়ন, উমেদারদের ৫০ থেকে ১০০ টাকা দিতে হয়। এ ছাড়া রিলিজ অর্ডার বা মুক্তিনামা কারাগারে পাঠানোর আগে জামিননামা যাচাই করতে পুলিশের জিআর শাখায় দিতে হয় এক হাজার ৫০০ থেকে দুই হাজার টাকা। কারাগার থেকে বের হতে দ্রুত রিলিজ অর্ডার কারাগারে পাঠাতে দুই হাজার টাকা। আসামির জামিন হওয়ার পর প্রতি মাসে দু-একবার বা আদালতের নির্ধারিত তারিখে আসামিকে হাজির হতে হয়। প্রতি হাজিরা দিতে জিআর শাখায় সংশ্লিষ্ট থানার দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশকে ৫০ থেকে ১০০ টাকা বা তারও বেশি দিতে হয়। আদালতে আসামিকে ৫০০ টাকা জরিমানা করা হলে তার সাথে পিয়ন পেশকার আরো দুইশ টাকা সংযুক্ত করে আদায় করেন। নিজ বসতবাড়ি নিয়ে প্রতিবেশীর সাথে বিরোধে জড়িয়েছিলেন সোনারগায়ের আলেয়া বেগম (ছদ্মনাম)। বেদখল হওয়া জমি ফিরে পেতে নারায়ণগঞ্জ সহকারী জেলা জজ আদালতের শরণাপন্ন হন। বাপ-দাদার বসতভিটা উদ্ধার করতে শুরু হয় আইনি লড়াই।
নারায়ণগঞ্জ আদালতের প্রবীন একজন আইনজীবী তার নাম প্রকাশ না করার অনুরোধে বলেন, “নারায়ণগঞ্জের একজন কুখ্যাত রাজাকার পুত্র বিগত সময়ে একজন শীর্ষ বিচারক কে ব্যবহার করে শত শত কোটি টাকার বাণিজ্য করেছে আদালত থেকে। ওই কুখ্যাত রাজাকার পুত্র তার ভাগ্নিকে দিয়ে তৎ সময়ে আদালতের একটি সিন্ডিকেট গড়ে তুলে । যার কাজ হলো আদালত থেকে নানাভাবে ফায়দা লুটপাট করা। এই সিন্ডিকেট টি অত্যান্ত কৌশলে জমি জমা সংক্রান্ত টেন্ডার ও নিলাম বাণিজ্য এককভাবে নিয়ন্ত্রক হিসেবে কাজ করছে । যাদের বলা হচ্ছে মামা ভাগ্নির আদালত। এই সিন্ডিকেট টির নেপথ্যের পরিচালক ওই কুখ্যাত রাজাকার পুত্র । যিনি নেপথ্যে থেকে ফোনে ফোনে কাজ করেন। আর ভাগ্নি কাজ করেন আদালতে আইনজীবী হিসেবে। আদালতের পেসকার, পিয়ন, ওমেদারসহ সংশ্লিষ্টদের ব্যবহার করে এক ধরণের লুটপাটের আখড়ায় পরিণত করা হয়েছে নারায়ণগঞ্জ আদালত কে। যার অসংখ্য ঘটনার রেকর্ড ইতিমধ্যেই নারায়ণগঞ্জ নিউজ আপডেট এর হাতে রয়েছে।
আওয়ামীলীগ নেতা এই আইনজীবী ক্ষোভ প্রকাশ করে নারায়ণগঞ্জ নিউজ আপডেট কে আরো বলেন, “নোংড়ামী কতটা কি হচ্ছে তা আপনারা দেখলেও এখন আর গণমাধ্যমে প্রকাশ করতে পারে না । ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ভয় দেখিয়ে সাংবাদিকদের আটকে রাখা হয়েছে। কি হচ্ছে নারায়ণগঞ্জে আদালতে তার কোজ কেউ রাখে না।”
এমন অভিযোগের পর টানা দীর্ঘ ১০ দিন নারায়ণগঞ্জ আদালতে ব্যাপক অনুসন্ধ্যানে উঠে এসেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। একজন পেসকারের সাথে ৬০ হাজার টাকায় চুক্তি করে আসামী নিজেই টাকা লেনদেন করে জামিন লাভ করেন । অথচ এই আসামী নভেম্বরে শেষ সপ্তাহে নিম্ন আদালত থেকে জামিন হচ্ছে না বিধায় জেলা ও জজ আদালতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হয় । ডিসেম্বরে জেলা ও দায়রা জজ আদালত বন্ধ থাকার কারণে ফেরারী হয়ে পরাতক থাকে এই আসামী। ওই মামলায় শেষ পর্যন্ত নিম্ন আদালত থেকেই ৬০ হাজার টাকার চুক্তিতে জামিন লাভ করে ওই আসামী।
প্রবীন এই আইনজীবী আরো বলেন, ১৯৯৯ সাল থেকে নিম্ন আদালতে ১০ বছর মামলা চালিয়ে অবশেষে হেরে যান আলেয়া। তবে ১০ বছরে আদালতে পিয়ন, পেশকার, আরদালি, পুলিশ সবাইকে টাকা দিতে দিতে হয়রান হয়েছেন তিনি। তবুও মামলার চূড়ান্ত ফলাফল মেলেনি। জমি ফিরে পেতে আপিল করেন উচ্চ আদালতে। হাইকোর্টে ৫ বছর মামলা চালিয়ে ২০০৪ সালে অপূর্ণ আশা নিয়েই মারা যান তিনি। পরবর্তীতে মামলার হাল ধরেন ছেলে। কিন্তু মামলাটি শুনানির জন্য কার্যতালিকায়ই তুলতে পারেননি। বাদী হওয়ার পর মামলা চালাচ্ছেন ১৭ বছর ধরে। তিনি বলেন, বাবা ধানিজমি বিক্রি করে টাকা খরচ করেছেন। এখন আমিও করে যাচ্ছি। বাবাসহ আমি অন্তত ৬০ বার এ মামলার জন্য আদালতে দাঁড়িয়েছি। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে এক ডজনেরও বেশি বার এ মামলার কার্যক্রম স্থগিত কিংবা পাল্টা স্থগিত হয়েছে। এতে প্রচুর টাকা খরচ হয়েছে। টাকার পরিমাণ ৩০ লাখের অধিক। খরচ বহন করতে করতে এখন নিঃস্ব হয়ে গেছি।’
নারায়ণগঞ্জ আদালতের একাধিক আইনজীবী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘মামলার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত চলে অবৈধ বকশিশ বাণিজ্য, যার সবটাই বহন করতে হয় বিচার প্রার্থীকে। পুলিশ, পেশকার, পিয়ন, আরদালিসহ আদালত সংশ্লিষ্ট সবাই অবৈধভাবে এসব পয়সা বিচারপ্রার্থীদের কাছ থেকে নিয়ে থাকেন। এটা চরম দুর্নীতি।’
এ ব্যাপারে ঢাকা আইনজীবী সমিতির সাবেক একজন নেতা বলেন, “কোনো আইনজীবী যেনো আদালত সংশ্লিষ্ট কাউকে বকশিশের নামে ঘুষ না দেন। যে কোনো ভাবেই হোক আদালতের ভাবমূর্তি নষ্ট করা যাবে না। এরপরেও কি হচ্ছে আদালত প্রাঙ্গণে । কে না জানেন । কিন্তু বিড়ালের গলায় ঘন্টা পড়াবে কে ?
এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে জজ কোর্টের একজন সিনিয়র আইনজীবী বলেন, ‘আসলে বকশিশ প্রক্রিয়াটি পুরোপুরি অবৈধ। আদালতে আসামী কিংবা মামলার বাদী হাজিরা দিতে এলে তাকেও কোর্ট পুলিশকে বকশিশ নামক উৎকোচ দিতে হয়। বকশিশ না দিলে আসামী কিংবা বাদীর সাথে অশোভন আচরণ এমনভাবে করেন যা কোন অবস্থাতেই বিচারের আওতায় আনা যায় না। কখনো কখনো এই বকশিশ ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত ঠেকায় একজন কন্সষ্টেবল। একই সাথে আদালত চলাকালীন সময়ে পেসকার নিজেই ফাইলের ভিতরে ঘুষ নেয়ার দৃশ্য প্রতিনিয়তঃ সকলে চোখে পরে । বকশিশ দেয়া-নেয়ার কোনো বিধান নেই। কিন্তু তবুও এ বিষয়টি আদালতপাড়ায় অঘোষিত নিয়মে পরিণত হয়েছে। আসলে দ্রুত ও বাড়তী সেবা পেতে বিচারপ্রার্থীদের বকশিশ না দিয়েও উপায় থাকে না। সাধারণ প্রক্রিয়ায় একটি মামলার শুনানি বা জামিনাদেশ পেতে অনেক সময় লেগে যায়। তখনই বিষয়টি দ্রুত করতে বকশিশ বা কিছু খরচাপাতি দিতে হয়। এখন প্রতিটি ধাপে একটি নির্ধারিত সীমা বেঁধে দিয়েছে কর্মচারী ও আদালত-পুলিশ। ওই সীমার নিচে বকশিশ দেয়া যায় না। কম দিলে পরবর্তী সময়ে ওই আইনজীবী অন্য কোনো মামলা নিয়ে গেলে তাকে সংশ্লিষ্ট কর্মচারী বা পুলিশ সহযোগিতা করেন না। এক কথায়, আদালত-পুলিশ ও কর্মচারীদের হাতে অনেকটা জিম্মি আইনজীবীরা।
তবে অভিযোগ অস্বীকার করে নাম প্রকাশ না করার অনুরোধে পুলিশের একজন জিআরও বলেন, ‘কি বলবেন বলেন ? কি হচ্ছে তা কে না জানে। খোজ নেন মামলা আর আসামীদের বিষয়ে কতটা ঘৃন্য কর্মকান্ড ঘটছে । সরাসরি চুক্তি করে কোন কোন পেসকার বিচারক গণের নাম ব্যবহার করে মামলার সুবিধা আদায় করে দিচ্ছে । অতি সম্প্রতি এমন কয়েকটি ঘটনার পূর্ণাঙ্গ প্রমাণ গণমাধ্যমের হাতে থাকার পরও কেউ আদালতের বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশের সাহস করে নাই ।
নারায়ণগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ আদালতের একজন পেশকারও বকশিশের বিনিময়ে কাজ করার বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, ‘এই কোর্টে বকশিশের বিনিময়ে কোনো কাজ হয় না। অন্য কোর্টের কথা আমি জানি না।’
Discussion about this post