নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের অপরাধ সাম্রাজ্যের সকল ফিরিস্তি এতোদিন পর র্যাবের উপর হামলা, বুয়েট ছাত্র ফারদিন নূর পরশ হত্যাকান্ডের পর । নানাভাবে উঠে আসছে শাসক দলের একজন শীর্ষ নেতার শেল্টারে কতটা ভয়ংকর হয়ে উঠেছে শত শত দূর্ধর্ষ অপরাধী। আর এই অপরাধীদের নিয়ন্ত্রণ করতো ডন বজলু । সেই বজলুর ইতিহাস এখন সকলের মুখে উচ্চারিত হচ্ছে। একই সাথে এই ডন বজলু গ্রেফতারের পর তাকে ছাড়াতে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করার পর ফের র্যাবের হাতে গ্রেফতার হয়েছে বলে চাউর রয়েছে নগরী জুড়ে ।
এক সময় ছিলেন পটি শ্রমিক (তাঁত শ্রমিক) চনপাড়ার আতঙ্ক বজলুর রহমান । এখন চনপাড়ার অপরাধ জগতের ‘রাজা’ তিনি। মাদক কারবার থেকে শুরু করে মলম পার্টি, অজ্ঞান পার্টি, ছিনতাই, প্রতারকচক্রসহ সব অপরাধীর নিয়ন্ত্রক তিনি। এক সময়ে সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরানো অবস্থায় থাকা বজলু গত একযুগে গড়েছেন সম্পদের পাহাড়। হয়েছেন নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের কায়েতপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) ৯ নম্বর ওয়ার্ডের (চনপাড়া এলাকা) মেম্বার।
অবশেষে গতকাল শুক্রবার চনপাড়া থেকে এ মাদক সম্রাটকে গ্রেপ্তার করে র্যাব।
জানা গেছে, রূপগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের কার্যকরী সদস্য বজলুর রহমান তিনজন গানম্যান নিয়ে ‘ফিল্মি স্টাইলে’ চলাফেরা করেন। তাঁর রয়েছে একজন পিএস ও একজন এপিএস।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, গত ২৭ সেপ্টেম্বর র্যাব চনপাড়া বস্তিতে অভিযান চালাতে যায়। সে সময় বজলুরসহ তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গ র্যাবের ওপর হামলা চালায়। হামলায় জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে তাঁকে। এ ছাড়া চনপাড়ায় মাদকসহ বিভিন্ন অপরাধে তাঁর সংশ্নিষ্টতার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখছে র্যাব।
সম্প্রতি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী ফারদিন নূর পরশ হত্যাকাণ্ডের পর আলোচনায় আসে চনপাড়া। এলাকাটির নিয়ন্ত্রক বজলুর রহমানের অপরাধ জগতের বিষয়টিও এখন সামনে চলে এসেছে। তাঁর বিরুদ্ধে হত্যা, অস্ত্র, মাদক, মারামারি ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের ওপর হামলাসহ রূপগঞ্জ থানায় অন্তত একডজন মামলা রয়েছে। এ ছাড়া অন্যান্য থানায় আরও একাধিক মামলা রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। গত ১০ নভেম্বর র্যাবের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত রাশেদুল ইসলাম শাহীন ওরফে সিটি শাহীন ছিলেন তাঁর ঘনিষ্ঠজন।
চনপাড়ার সাধারণ বাসিন্দারা জানিয়েছেন, লক্ষাধিক মানুষের বসবাস চনপাড়া ৯টি ওয়ার্ডে ভাগ করা হয়েছে। ৬ নম্বর ওয়ার্ডে নিজের তিনতলা বাড়িতে পরিবার নিয়ে বসবাস করেন বজলু। তিনি এক সময় রূপগঞ্জ এলাকার তাঁতের শ্রমিক ছিলেন। দিন হাজিরায় কাজ করতেন। যা আয় হতো তা দিয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয় তাকে। জরাজীর্ণ বাঁশের চাটাইয়ের ঘরে ছিল বসবাস। তাঁর বাবা মৃত নাদের বকশের খুচরা চালের দোকান ছিল বস্তিতে। বজলুর রহমান ২০০৫ সালের আগে বিএনপির রাজনীতি করতেন। তখনও চনপাড়ায় মাদক ব্যবসা ছাড়ও চুরি, ছিনতাইসহ ছিচকে অপরাধী কার্যক্রম চালাতেন। মাদকের অভিযোগে ওই বছরের শেষের দিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাঁকে গ্রেপ্তার করে। এ সময় মারধর করা হয় তাঁকে। হাসপাতালে ভর্তি পর্যন্ত হতে হয়েছিল তাঁকে। সে সময় রূপগঞ্জ এলাকার আওয়ামী লীগের এক নেতা তাঁকে কাছে টানতে টাকা-পয়সা দিয়ে সহযোগিতা করেন। কারণ চনপাড়া বস্তির নিয়ন্ত্রক তখনও তিনি। পরে সেই নেতার হাত ধরে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যুক্ত হন। এখন প্রভাবশালী রাজনৈতিক অনেক নেতারই আশীর্বাদপুষ্ট। তবে ওই নেতার ‘ডান হাত’ হিসেবেই চিহ্নিত। এলাকাবাসীর অভিযোগ- বজলুর রহমান প্রকাশ্যে বলতেন, তাঁর মাথার ওপর বড় ছায়া রয়েছে। যত অপরাধ করুক না কেন তাঁর কিছুই হবে না।
চনপাড়ার বিভিন্ন গলিতে প্রকাশ্যে মাদক বেচাকেনা হয়। প্রত্যেকের কাছ থেকে নিয়মিত চাঁদা আদায় করেন এই বজলু। তাঁকে টাকা না দিয়ে কারও ব্যবসা চালানোর উপায় নেই। তাঁর ঘরজামাই রিপনও বড় মাদক কারবারি। বাড়ির পাশে সবজি ক্ষেতে মাটির মধ্যে ফেনসিডিল মজুত করে রাখতেন তাঁর জামাতা। ফেনসিডিল মজুত করার উদ্দেশ্যেই লোক দেখানো সবজি চাষ করা হতো সেখানে। তবে কিছুদিন আগে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অভিযান চালিয়ে মাটির নিচ থেকে ফেনসিডিল জব্দ এবং রিপনকে গ্রেপ্তার করে। স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন, রিপনের স্ত্রীকেও আটক করা হয়েছিল। পরে মেয়েকে ছাড়িয়ে নেন বজলু।
এলাকাবাসী জানিয়েছেন, চনপাড়ায় সন্ত্রাসী ও ক্যাডার বাহিনী তৈরি করেছেন বজলুর রহমান। তাঁদের কেউ কথার বাইরে গেলেই মাদকসহ বিভিন্ন মামলায় গ্রেপ্তার করিয়ে দিতেন। তিনি ও তাঁর বাহিনী মানুষের বাড়িতে লুটপাট চালান। মানুষের দামি আসবাবপত্র থেকে শুরু করে নগদ টাকা ছিনিয়ে নিয়ে নেওয়া হয়। চনপাড়ার নিরীহ মানুষের দোকানপাট ও বাড়ি দখল করার অভিযোগও রয়েছে বজলুর বিরুদ্ধে। ৩০টিরও বেশি দোকান দখল করে ভাড়া দিয়ে রেখেছেন তিনি।
এলাকাবাসী বলছেন, অভাবী বজলু এখন কোটি কোটি টাকার মালিক। চনপাড়ায় বাজার এলাকার একটি তিনতলা, একটি চারতলা, একটি দোতলা এবং আরেকটি গলিতে একটি চারতলা বাড়ির মালিক তিনি। এই বাড়ির চারতলায় একটি ক্লাব বানিয়েছেন। গোপন বৈঠক হয় সেখানে। এ ছাড়া একাধিক টিনের বাড়ি ও প্লট রয়েছে তাঁর। চনপাড়ার ৬ নম্বর ওয়ার্ডের একটি স্কুলের জায়গা দখল করে বাড়ি এবং ৩ নম্বর ওয়ার্ডে সমিতির জায়গা দখল করে বানিয়েছেন অফিস। চাঁদার দাবিতে সেখানে মানুষকে ডেকে মারধর করার অভিযোগ আছে। চনপাড়ার বাইরেও তাঁর সম্পদের তথ্য পাওয়া গেছে। ডেমরার সারুলিয়ার পশ্চিম টেংরার খাল পাড়ে দুটি একতলা এবং একটি তিনতলা ভবনেরও মালিক তিনি। রূপগঞ্জ পূর্ব গ্রাম পশ্চিম গাঁওয়ের বিলেও প্রচুর জমি-জায়গা কিনেছেন বলে জানিয়েছেন এলাকাবাসী।
নানা ধরনের অপরাধীর ঘাঁটি চনপাড়া বস্তিতে অজ্ঞান পার্টি, মলম পার্টি ও ছিনতাই চক্রের বসবাস। এই চক্রের অন্যতম হোতা এলাকার করিম ও তার ভাই ওমর। আরও একাধিক ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণে রয়েছে এসব চক্র। চক্রের সদস্যরা সকালে হোতাদের কাছ থেকে অজ্ঞান করা দ্রব্যাদি কেনার জন্য টাকা-পয়সা নিয়ে বের হয় নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকা এলাকায়। দিন শেষে ফিরে লুট করা অর্থ ও মূল্যবান জিনিসপত্র হোতাদের হাতে তুলে দেয়। এরপর হাজিরা কিংবা কমিশন পায় সদস্যরা। এ হোতাদেরও নিয়ন্ত্রক বজলুর রহমান। লুট করার একটি অংশ দিতে হয় তাঁকে। এত অপকর্মের পরও পুলিশ ও প্রশাসনের সঙ্গে ছিল তাঁর সখ্য। আধিপত্য বিস্তার নিয়ে গত ২০ বছরে চনপাড়া বস্তিতে খুন হয়েছেন পুলিশ কর্মকর্তাসহ অন্তত ১৫ জন।
বজলুর সাঙ্গোপাঙ্গদের মধ্যে রয়েছে জয়নাল, শমসের, স্বপন, শাওন, নাজমা, বজলুর ভাই বোতল মিজু, সাদ্দাম হোসেন স্বপন, রাজু আহমেদ রাজা, রায়হান, ইউসুফ, সায়েম, নাজমা, রিপন, শাওন, রেহান মিয়া, জাকির হোসেন, আনোয়ার হোসেন, হাসান, মিজু, রাজা, রুমা ও শ্যালক জাকির। মাদক কারবারিদের মধ্যে অন্যতম হলো- হোমা, মনির, বিলকিস, চিকা মনিরের ভাই পিচ্চি আনোয়ার, আসলাম, নুর হোসেন, স্বপনের সেলসম্যান রাসেল, আয়নাল, জনি, হাসি, জুয়েল, মোহাম্মদ আলী, কয়লারানী, ফারুক, শামীম, শিল্পী, সাহাবুদ্দিন ওরফে সাবু, কালাম, আবুল, বাবুল, আরিফ, শহিদুল, মুজাহিদ, নুর জামাল, জনি, কদবানু,শামসুন্নাহার, মিল্লাত, মীজান ওরফে বোতল মিজু, সেলিম, কামাল, আলম, চানপুইরা লিটন, জাহাঙ্গীর, রাজিব, মোকলেছ, শাহ আলম, রোশনী, ল্যাংড়া শাহিন, শামীম, অপু ও মাইগ্যা রাজু।
Discussion about this post