’৭৫ এর ১৫ আগষ্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানসহ তার পরিবারের সদস্যদের নির্মম হত্যাকন্ডের পর সারাদেশ যখন নিস্তব্ধ সেই সময় নানা অঘটনের পর কলংকময় জেল হত্যার মতো ঘটনা ঘটায় বিপদগামী কিছু সেনা কর্মকর্তারা। এই ঘটনায় নারায়ণগঞ্জ শহরের ডনচেম্বার এলাকার সেনা কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন (বরখাস্ত) কিশমত হাশেমের নাম উঠে আসে ঘৃন্য এই অপরাধের তালিকায়। জেল হত্যা মামলায় সেই যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামী ক্যাপ্টেন (বরখাস্ত) কিশমত হাশেম কানাডায় পলাতক থাকাবস্থায় মৃত্যুবরনের খবর প্রকাশিত হলেও এখনো সেই কলংকময় তিলক রয়ে গেছে নাারয়ণগঞ্জবাসীর কপালে।
এমন ঘটনায় নারায়ণগঞ্জের অনেক আওয়ামীলীগ নেতা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, ২০১৫ সালের ২৬ মার্চ কানাডার মন্ট্রিলে কুখ্যাত এই অপরাধী যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত বরখাস্তকৃত ক্যাপ্টেন কিসমত হাশেম মৃত্যুবরণ করলেও এখনো সকলের মুখে ঘৃন্যর সাথে উচ্চারিত হয় এই কলংকের কথা । ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী অবস্থায় হত্যা করা হয় তাজউদ্দীন আহমেদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, কামরুজ্জামান এবং মনসুর আলীকে। জাতীয় চার নেতাকে হত্যায় যাবজ্জীবন কারাদন্ডপ্রাপ্ত আসামি সেনাবাহিনীর বরখাস্তকৃত ক্যাপ্টেন কিসমত হাশেম ছিলেন নারায়ণগঞ্জ শহরের ডনচেম্বার এলাকার বাসিন্দা। কিসমত হাশেম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যা মামলারও খালাসপ্রাপ্ত আসামি। কিসমত হাসেমের কারণে আওয়ামীলীগ তথা নিহত চার নেতার পরিবারের সদস্যদের কাছে কলঙ্কিত নারায়ণগঞ্জ এলাকা।
এমন ঘটনায় সেই বরখাস্তকৃত ক্যাপ্টেন কিসমত হাশেমসহ সকল অপরাধীদের নিয়ে প্রথম আলো প্রতিবেদন প্রকাশ করেছেন
জাতীয় চার নেতাকে নৃশংসভাবে হত্যার ৪৭ বছর। যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় পলাতক দুই আসামিকে ফিরিয়ে আনা যায়নি
জাতীয় চার নেতাকে নৃশংসভাবে হত্যার ঘটনায় সাজাপ্রাপ্ত ১১ আসামির মধ্যে ১০ জনই এখনো পলাতক। এ মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত তিন আসামি কোথায় আছেন, সে বিষয়ে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত দুজন বিদেশে রয়েছেন। তাঁদের এখনো ফিরিয়ে আনা যায়নি।
রাতের আঁধারে কারাগারে বন্দী অবস্থায় ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর জাতীয় চার নেতা মুক্তিযুদ্ধের সময় গঠিত মুজিবনগর সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, মন্ত্রিসভার সদস্য ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী এবং এ এইচ এম কামারুজ্জামানকে হত্যা করা হয়। এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় করা মামলাটি জেলহত্যা মামলা নামে পরিচিত। এ ঘটনার আড়াই মাস আগে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নৃশংসভাবে সপরিবার হত্যা করা হয়।
জাতীয় চার নেতাকে হত্যার ঘটনায় ১৯৭৫ সালের ৪ নভেম্বর তৎকালীন কারা উপমহাপরিদর্শক কাজী আবদুল আউয়াল লালবাগ থানায় হত্যা মামলা করেন। মামলায় বলা হয়, রিসালদার মোসলেহ উদ্দিনের নেতৃত্বে চার-পাঁচজন সেনাসদস্য কারাগারে ঢুকে চার নেতাকে গুলি করেন এবং বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে তাঁদের মৃত্যু নিশ্চিত করেন।
এ মামলার তদন্ত থেমে ছিল ২১ বছর। ১৯৯৬ সালের জুন মাসে আবার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর মামলার কার্যক্রম শুরু হয়। ২৯ বছর পর ২০০৪ সালের ২০ অক্টোবর ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালত মামলার রায় ঘোষণা করেন। রায়ে তিন আসামি রিসালদার মোসলেহ উদ্দিন, দফাদার মারফত আলী শাহ ও দফাদার মো. আবুল হাশেম মৃধাকে মৃত্যুদণ্ড এবং ১২ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত ১২ আসামি হলেন লে. কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান, লে. কর্নেল সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, মেজর (অব.) বজলুল হুদা, মেজর (অব.) এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদ, কর্নেল (অব.) খন্দকার আবদুর রশিদ, লে. কর্নেল (অব.) শরীফুল হক ডালিম, কর্নেল (অব.) এম বি নূর চৌধুরী, লে. কর্নেল (অব.) এ এম রাশেদ চৌধুরী, মেজর (অব.) আহম্মদ শরিফুল হোসেন, ক্যাপ্টেন (অব.) আবদুল মাজেদ, ক্যাপ্টেন (অব.) কিশমত হাশেম এবং ক্যাপ্টেন (অব.) নাজমুল হোসেন আনসার।
পরে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত চার আসামি সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, বজলুল হুদা এবং এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদ (ল্যান্সার) বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করেন। ২০০৮ সালের ২৮ আগস্ট হাইকোর্ট রায় দেন। রায়ে তাঁরা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড থেকে খালাস পান। অপর আট আসামির যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বহাল থাকে। দফাদার মারফত আলী শাহ ও দফাদার মো. আবুল হাশেম মৃধাকে হাইকোর্টের রায়ে খালাস দেওয়া হয়েছিল। তবে আপিল বিভাগ বিচারিক আদালতের দেওয়া মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন।
অবশ্য জেলহত্যা মামলায় অব্যাহতি পেলেও ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি দিবাগত রাতে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, বজলুল হুদা এবং এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদের (ল্যান্সার) ফাঁসি কার্যকর হয়। সর্বশেষ ২০২০ সালের ১১ এপ্রিল দিবাগত রাতে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ক্যাপ্টেন (বরখাস্ত) আবদুল মাজেদের ফাঁসি কার্যকর হয়, যিনি জেলহত্যা মামলায়ও যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত।
জেলহত্যা মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত কর্নেল (অব.) এম বি নূর চৌধুরী কানাডা এবং লে. কর্নেল (অব.) এ এম রাশেদ চৌধুরী আছেন যুক্তরাষ্ট্রে। তাঁদের ফিরিয়ে আনতে সরকারের পক্ষ থেকে অনেক দিন ধরে চেষ্টা চলছে।
বাসস জানাচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত সেপ্টেম্বরে যুক্তরাষ্ট্র সফরকালে এক অনুষ্ঠানে বলেন, খুনি রাশেদ চৌধুরীকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্রের কাছে অনুরোধ করা হয়েছে।
এদিকে কানাডার হাইকমিশনার লিলি নিকোলস গত মঙ্গলবার সচিবালয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। সাক্ষাতে নূর চৌধুরীকে ফেরত পাঠানোর জন্য বিকল্প পথ খুঁজতে কানাডার প্রতি অনুরোধ জানান আইনমন্ত্রী।
বৈঠক শেষে আইনমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার আসামি নূর চৌধুরীকে ফেরত পাঠানোর বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। কানাডার আইনে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিকে ফেরত দেওয়া সম্ভব নয় বলে হাইকমিশনার জানিয়েছেন। তাঁদের অনুরোধ করেছি, বিকল্প পন্থা বের করা যায় কি না। তাঁকে বলেছি, একজন খুনিকে আশ্রয় দেওয়া মানবাধিকার লঙ্ঘন। হাইকমিশনার বলেছেন, কানাডা সরকারকে বিষয়টি তিনি জানাবেন।’
জাতীয় চার নেতার একজন এ এইচ এম কামারুজ্জামানের ছেলে রাজশাহীর মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামান। গত মঙ্গলবার তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘চার নেতার পরিবারের অন্য সদস্যদের মতো আমারও দাবি, আসামিদের দেশের বাইরে থেকে ফিরিয়ে এনে দণ্ড কার্যকর করা হোক।
আশায় আশায় দিন পার করছি।’ তিনি বলেন, ‘দণ্ড কার্যকর না হওয়া পর্যন্ত বলা যাবে না যে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সরকার চেষ্টা করছে তাদের ফিরিয়ে এনে দণ্ড কার্যকরের জন্য। সরকার সফল হবে বলে আশা করছি।’
Discussion about this post