পবিত্র আশুরা আজ। বিশ্বের মুসলিম সম্প্রদায়ের কাছে দিনটি ঘটনাবহুল ও শোকাবহ হিসেবে স্মরণীয়। ইসলামি চিন্তাবিদদের মতে, বিশ্বের সৃষ্টি এবং লয় এই দিনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এছাড়া ইসলামের অনেক ঘটনাও এই দিনে সংঘটিত হয়। তবে সব ছাড়িয়ে কারবালার শোকাবহ দিনকেই বেশি স্মরণ করা হয়। এ কারণে ত্যাগ-শোকের প্রতীক ছাড়াও বিশেষ পবিত্র হিসেবে যথাযথ মর্যাদার সঙ্গে পালিত হবে এদিনটি।
আরবী হিজরীর (সাল) প্রথম মাস হলো মহরম। আর এই মাসের ১০ তারিখকে আশুরা হিসেবে অভিহিত করা হয়। ইসলামি চিন্তাবিদদের মতে, মহান আল্লাহ্তায়ালা এই দিনে বিশ্বব্রহ্মান্ড সৃষ্টি করেছেন। এই দিনে তা ধ্বংস বা কিয়ামত সংঘটিত হবে। এছাড়া এই দিনেই আল্লাহ নবী হযরত মুসা (আ.) জালিম বাদশা ফেরাউনের হাত থেকে রক্ষা পেতে তাঁর অনুসারীদের নিয়ে সাগর পাড়ি দিয়েছিলেন। বাদশা ফেরাউন তাকে অনুসরণ করতে গিয়ে দলবলসহ সাগরে ডুবে মরেছিল। এ বিষয়ে প্রায় একমত পোষণ করেন। ভিন্ন মত থাকলেও অনেকেরই অভিমত, আশুরার দিনে হজরত নুহের (আ.) সময় বিশ্বে মহাপ্লাবন সৃষ্টি হয়েছিল। এই ধরনের অনেক ঘটনা এই দিনেই সৃষ্টি হয়েছিল বলে তারা উল্লেখ করেছেন।
বোখারী ও মুসলিম হাদিসের বর্ণনা অনুযায়ী মক্কার কুরাইশদের নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা পেতে মহানবী (সা.) এবং তাঁর অনুসারীদেও নিয়ে মদিনায় হিজরত করেন। এ সময় মদিনায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ইয়াহুদীর বসবাস ছিল। নবদীক্ষিত মুসলিম উম্মাহ মদিনায় এসে দেখলেন আশুরার দিনে ইয়াহুদীরা রোজাব্রত পালন করছেন। ইয়াহুদীদের কাছে এই বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তারা জানায়, তাদের নবী মুসা (আ.) এই দিনে ফেরাউনের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন। এই ঘটনার স্মরণেই তারা রোজাব্রত পালন করেন। তখন মহানবী হজরত মুহম্মদ সা. তাঁর অনুসারীদের বললেন, ইয়াহুদীদের চেয়ে আমরা মুসা নবীর অধিক কাছের এবং প্রিয়। তাই তিনি মুসলমানদেরকে আশুরার দিনে রোজা রাখার আদেশ দিলেন। পরে রমজান মাসে রোজা ফরজ করা হলে আশুরার দিনের রোজা গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে। তবে মুসলমানদের অনেকে আশুরার দিনে নফল এবাদত হিসেবে রোজাব্রত পালন করে থাকেন। ইয়াহুদীদের সঙ্গে যাতে ধর্ম পালনে কোন মিল না থাকে এ কারণে আশুরার দিনের সঙ্গে মিলিয়ে দুটি রোজা রাখার বিধান রয়েছে।
তবে সব ছাপিয়ে আশুরার দিনে ঘটে যাওয়া কারবালার প্রান্তরের শোকাবহ ঘটনাকেই বেশি স্মরণ করা হয়ে থাবে। মহানবী হজরত মুহম্মদ সা. এঁর প্রিয় দৌহিত্র হজরত ইমাম হোসেন (রা.) এবং তার পরিবার ও অনুসারীরা সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে যুদ্ধ করতে গিয়ে ফোরাত নদীর তীরে কারবালা প্রান্তরে ইয়াজিদ বাহিনীর হাতে শহীদ হন। আরবী ৬১ হিজরীর (সনের) ১০ মহরম দিনে এই হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটেছিল।
এ ঘটনা স্মরণ করেই বিশ্ব মুসলিম যথাযোগ্য মর্যাদায় দিনটি পালন করে থাকে। শান্তি ও সম্প্রীতির ধর্ম ইসলামের মহান আদর্শকে সমুন্নত রাখতে তাদের এই আত্মত্যাগ মানবতার ইতিহাসে সমুজ্জ্বল হয়ে রয়েছে। কারবালার এ শোকাবহ ঘটনা ও পবিত্র আশুরার শাশ্বত বাণী সকলকে অন্যায় ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে এবং সত্য ও সুন্দরের পথে চলতে প্রেরণা যোগায়।
এদিকে বিদ্যমান করোনা পরিস্থিতিতে এ উপলক্ষে রাজধানী ঢাকাসহ দেশব্যাপী সংক্ষিপ্ত কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়েছে। দিনটি যথাযথ মর্যাদায় পালনের জন্য ইসলামিক ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে কর্মসূচী নেয়া হয়েছে। বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে থাকছে এবাদত/বন্দেগী পালনের নানা কর্মসূচী। এছাড়া রাজধানীসহ সারাদেশের মসজিদে বিশেষ কর্মসূচী নেয়া হয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে অনেকেই এই দিনে অধিক পূর্ণ লাভের আশায় দান/খয়রাতসহ নানা ধরনের এবাদত বন্দেগী পালন করবেন।
দেশে শিয়া সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে ১০ মহরম উপলক্ষে কারবালার ঘটনাবহ দিনকে স্মরণ করে নানা কর্মসূচী পালন করে। আশুরার দিনে তাজিয়া মিছিল বের করা হয় শোকের আবহে। মূলত ইমাম হোসেন (রা.) এর সমাধির প্রতিকৃতি নিয়ে এই মিছিল হয়। আরবী ‘তাজিয়া’ শব্দটি শোক ও সমবেদনা প্রকাশ করতে ব্যবহার করা হয়। তবে করোনা পরিস্থিতি বিবেচনায় এবার সব ধরনের তাজিয়া, শোক ও পাইক মিছিল নিষিদ্ধ করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। স্বাস্থ্যবিধি মেনে ইমামবাড়াগুলোতে ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করা যাবে। কিন্তু এসব অনুষ্ঠানস্থলে দা, ছোরা, কাঁচি, বর্শা, বল্লম, তরবারি, লাঠি ইত্যাদি বহন এবং আতশবাজি ও পট্কা ফোটানো সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
এ উপলক্ষে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের পক্ষ থেকে এক বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়েছেÑ পবিত্র আশুরা উদ্যাপন উপলক্ষে ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায় সব ধরনের তাজিয়া, শোক ও পাইক মিছিল নিষিদ্ধ করেছে। তবে ধর্মপ্রাণ নগরবাসী স্বাস্থ্যবিধি মেনে ইমামবাড়াগুলোতে ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করতে পারবেন। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বর্তমান করোনাভাইরাস সংক্রমণের পরিস্থিতিতে ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকার নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে ডিএমপি আশুরা উপলক্ষে সব ধরনের তাজিয়া, শোক ও পাইক মিছিল নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে।
এদিকে পবিত্র আশুরা উপলক্ষে দেয়া এক বাণীতে রাষ্ট্রপতি মোঃ আব্দুল হামিদ বলেছেন, কারবালার শোকাবহ ঘটনা অন্যায় ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে উদ্বুদ্ধ করে এবং সত্য ও সুন্দরের পথে চলার প্রেরণা যোগায়। পবিত্র আশুরা মুসলিম উম্মাহর জন্য এক তাৎপর্যময় ও শোকের দিন। সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে ৬১ হিজরীর ১০ মহরম হজরত মুহম্মদ (সা.) এঁর প্রাণপ্রিয় দৌহিত্র হজরত ইমাম হোসেন (রা:) তার পরিবারের সম্মানিত সদস্য ও ঘনিষ্ঠ সহচরবৃন্দ বিশ্বাসঘাতক ইয়াজিদের সৈন্যদের হাতে কারবালায় শহীদ হন। ইসলামের সুমহান আদর্শ ও ত্যাগের মহিমাকে সমুন্নত রাখার জন্য তাঁদের এই আত্মত্যাগ ইতিহাসে সমুজ্জ্বল হয়ে আছে। কারবালার শোকাবহ ঘটনা আমাদের অন্যায় ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে উদ্বুদ্ধ করে এবং সত্য ও সুন্দরের পথে চলার প্রেরণা যোগায়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর বাণীতে পবিত্র আশুরার মর্মবাণী অন্তরে ধারণ করে জাতীয় জীবনে সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে নিজ নিজ অবস্থান থেকে জনকল্যাণমুখী কাজে অংশ নিয়ে বৈষম্যহীন, সুখী, সমৃদ্ধ ও শান্তিপূর্ণ দেশ গড়ে তুলতে সকলের প্রতি আহবান জানিয়েছেন। বলেন, পবিত্র আশুরা একটি তাৎপর্যপূর্ণ দিন। এ দিনটি বিশ্বের মুসলমানদের কাছে অত্যন্ত পবিত্র ও ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ। মহানবী হজরত মুহম্মদ (সা.) এঁর প্রিয় দৌহিত্র হজরত ইমাম হোসেন (র.) ও তার পরিবারবর্গ কারবালার প্রান্তরে শাহাদাত বরণ সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠায় তাদের এ আত্মত্যাগ মুসলিম উম্মাহর জন্য এক উজ্জ্বল ও অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। এবার আমরা এক সঙ্কটময় সময়ে আশুরা পালন করছি। করোনাভাইরাস সমগ্র বিশ্বকে স্থবির করে দিয়েছে। আমাদের সরকার এ পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছে। আমরা জনগণকে সকল সহযোগিতা অব্যাহত রেখেছি। মহান আল্লাহ বিপদে মানুষের ধৈর্য পরীক্ষা করেন। এ সময় সকলকে অসীম ধৈর্য নিয়ে সহনশীল ও সহানুভূতিশীল মনে একে অপরকে সাহায্য করে যেতে হবে। তিনি সকলকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, আমরা সকলে মহান আল্লাহর দরবারে বিশেষ দোয়া করি যেন এই সংক্রমণ থেকে দ্রুত মুক্তি পাই।
Discussion about this post