নারায়ণগঞ্জ নিউজ আপডেট :
২০১৫ সালে সনাতন ধর্মালম্বীদের মহার্তীথ লাঙ্গলবন্দ অষ্টমী স্নান উৎসবকালে অনাকাংখিত ঘটনা মাথায় রেখে শুক্রবার ১২ এপ্রিল ব্যাপক নিরাপত্তার আয়োজন করা হয়েছে । কোন প্রকার অপ্রীতিক ঘটনা যাতে না ঘটে সেলক্ষে ১৬ শত পুলিশ নিরাপত্তা বলয়ের মধ্যে রাখা হবে । লাঙ্গলবন্দের স্নান উৎসবে সারা দেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে পূর্নার্থীরা পূন্য স্নান করতে আসে । তাদের নিরাপত্তায় জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে কোন কমতি নেই। আমরা সকল ধরনে প্রস্তুতি গ্রহন করেছি। মোবাইল টিম, ওয়াচ টাওয়ার, মহিলা পুলিশ, আনাসার বাহিনী নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়জিত থাকবে।
নারায়ণগঞ্জ জেলার বন্দর থানার লাঙ্গলবন্দের স্নান উৎসবকে কেন্দ্র করে নাান আয়োজনের সকল বিষয় পর্যবেক্ষন শেষে বুধবার ১০ এপ্রিল বিকেলে পুলিশ সুপার হারুন অর রশিদ প্রেস ব্রিফিংকালে এমন মন্তব্য করেন ।
তিনি আরো বলেন, ১৮টি স্নান ঘাটসহ পুরো লাঙ্গলবন্দ সিসি ক্যামেরায় আওতাভূক্ত থাকবে। ২০১৫ সালে যে অনাকাংক্ষিত ঘটনা ঘটে ছিল সে ঘটনার আর যেন না ঘটে সেজন্য সকলকে সর্তক থাকতে হবে ।
এ সময় উপস্থিত ছিলেন বন্দর উপজেলা পরিষদের নির্বাহী কর্মকর্তা পিন্টু বেপারী, বন্দর উপজেলা ভূমি কমিশনার রুমানা আক্তার, পুলিশ সুপার (অপরাধ) মো: মামুন, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এ সার্কেল ইমরান, সিনিয়র সহকারি পুলিশ সুপার সালেহ, ডিআইওয়ান ইন্সপেক্টর মনির, বন্দর থানা অফিসার ইনর্চাজ মোঃ রফিকুল ইসলাম, বন্দর থানা ওসি তদন্ত আজহার, ইন্সপেক্টর শাহাদাৎ, পল্লী বিদুৎ সমিতি ডিজিএম আশরাফুল আলম, মহানগর পূজা উদযাপন কমিটির সাধারন সম্পাদক শিখন সরকার শিপন, মুছাপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হাজী মাকসুদুর রহমান ও কামতাল তদন্ত কেন্দ্রের ইনর্চাজ এসআই হারুন অর রশিদসহ অনেকেই ।
পুর্নতীর্থ লাঙলবন্দের ইতিহাস …..
চৈত্র মাসের শুক্লা অষ্টমী তিথি, পুণ্য অষ্টমী স্নান বা ব্রহ্মপুত্র স্নান। ঢাকা থেকে ২১ কিলোমিটার পূর্ব-দক্ষিণে নারায়ণগঞ্জ জেলার বন্দর থানার মহাতীর্থ লাঙ্গলবন্দে পুণ্যস্নান উপলক্ষে পুণ্যার্থীদের ঘটবে মিলনমেলা। সনাতন ধর্মমতে গঙ্গাদি স্নানযোগের রয়েছে গভীর তাৎপর্য। এক একটি স্নানে এক এক প্রকার পুণ্য লাভ হয়ে থাকে। অক্ষয়তৃতীয়া, জহ্নুসপ্তমী, দশহরা, ব্যতীপাতযোগ, পরারুণোদয়ে করতোয়া, অক্ষয়ষষ্ঠী, শ্রীশ্রীবামনজয়ন্তী, দ্যূতপ্রতিপদ, পুষ্কর, অগ্রহায়ণ রোহিণীনক্ষত্রযুক্ত কৃষ্ণাপ্রতিপদ, মকরাদি বা গঙ্গাসাগর, মাকরী সপ্তমী,গোবিন্দ দ্বাদশী, বারুণী স্নানসহপূর্ণিমা, মন্বন্তরা, অক্ষয়া, যুগাদ্যা, ত্র্যহস্পর্শ, গোসহস্রীযোগ, পুণ্যতরা, সংক্রান্তি, গ্রহণ, অহোরাত্র, ব্রহ্মপুত্র ইত্যাদিতে নামের সাথে তাৎপর্যযুক্ত
হয়ে এ মহাদেশে স্নান অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। ব্রহ্মপুত্র নদে চৈত্র মাসের শুক্লা অষ্টমীতে স্নান উপলক্ষে ‘লাঙ্গলবন্দে’দেশ বিদেশের বহু পুণ্যার্থীর আগমন ঘটে। কি আছে সে স্নানে? ‘লাঙ্গলবন্দ’ কেন পুণ্যতীর্থ ? ‘লাঙ্গলবন্দ’ নামকরণ হলো কেন? প্রশ্ন গুলো আমাদের মনের গভীরে দোল দেয়। প্রশ্নগুলোর উত্তর প্রাপ্তির দিক বিবেচনা রেখেই আমাদের আলোচ্য
ব্রহ্মপুত্রে লাঙ্গলবন্দ স্নান’। লাঙ্গলবন্দ’ তীর্থের উৎপত্তি সম্বন্ধে
কালিকা পুরাণ (৮৪/৮৫ অধ্যায়) আছে :
শান্তনু মুনির পত্নী অমোঘা দেবী
ব্রহ্মার তেজ গর্ভে ধারণ করে এক সুন্দর
পুত্র সন্তান প্রসব করেন। প্রসবের পূর্বে
মুনি উত্তরে কৈলাস, পূর্বে সম্বর্তক,
দক্ষিণে গন্ধমাদন ও পশ্চিমে জারুধি এই
চার পর্বতের মধ্যে একটি কুণ্ড খনন করে
রাখেন। প্রসবান্তে পুত্রটিকে সেই কুণ্ডে
স্থাপন করেন এবং ব্রহ্মা এসে ঐ পুত্রকে
দেখে নাম রাখেন ‘লোহিত্য’। কিছুদিন
পরে পুত্র জলে দেহ বিস্তার করে কুণ্ড
মধ্যে অবস্থান করেন। সে হতে ইহা
‘ব্রহ্মকুণ্ড’ নাম হয়।
ত্রেতাযুগে জমদগ্নি নামে এক মুণি
ছিলেন। রেণুকার সাথে তার বিবাহ হয়।
তাদের ছিল পাঁচ পুত্র সন্তান। কনিষ্ঠ
সন্তানের নাম হলো পরশুরাম, বিষ্ণুর দশম
অবতারের মধ্যে ষষ্ঠ অবতার। একদিন মুনি
জমদগ্নি স্ত্রী রেণুকার জল আনতে
বিলম্বের কারণ জিজ্ঞাসা করে এবং
যোগবলে তার মানসিক বিকৃতির কথা
অবহিত হন। ক্রোধান্বিত হয়ে মুনি
রূঢ়স্বরে তার পুত্রদেরকে তাদের মাকে
হত্যা করার আদেশ দেন। অগ্নিশর্মা
মুনির উক্ত আদেশ প্রথম চার পুত্রের
কেউই পালন করতে রাজি হয়নি। পরে
পঞ্চমপুত্র পরশুরাম পিতার আদেশে কুঠার
দিয়ে মায়ের দেহ দ্বিখণ্ডিত করেন।
কিন্তু পরশুরামের হাতে ঐ কুঠারটি লেগে
থাকে। পিতার কাছে এর কারণ জানতে
চাইলে পিতা বলেন ‘তুমি মাতৃহত্যা আর
নারীহত্যা’ এই দ্বিবিধ পাপেই আক্রান্ত
হয়েছ। আর জেনে রেখো, পাপ ছোট বা
বড় যা-ই হোক না কেন কৃতকর্মীকে তা
স্পর্শ করবেই।’ তারপরও পুত্রকে আশ্বস্ত
করে তীর্থ পরিভ্রমণের উপদেশ দিয়ে
বলেন ‘যে তীর্থ গমনে বা স্নানে তোমার
হাতের কুঠার স্খলিত হবে, জানবে যে ঐ
পুণ্যস্থানই পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ
তীর্থক্ষেত্র।’
পিতৃআজ্ঞায় পরশুরাম তীর্থ পরিভ্রমণে
বের হয়ে তীর্থ ভ্রমণ করতে লাগলেন।
পরশুরাম ব্রহ্মকুণ্ডে স্নান করার সাথে
সাথে তাঁর হাতের কুঠার স্খলিত হয়ে
যায় এবং সর্বপাপ থেকে মুক্তি লাভ
করেন। তিথিটি ছিল চৈত্র মাসের শুক্লা
অষ্টমী তিথি বুধবার পুনর্বসু নক্ষত্র। পরে
পরশুরাম চিন্তা করলেন এমন সুমহান
পুণ্যজনক জলকে সকলের সহজলভ্য করার
জন্য এর ধারা পৃথিবীতে নিয়ে আসবেন।
পিতৃ আজ্ঞায় ব্রহ্মকুণ্ডের জলধারাকে এ
পৃথিবীতে নিয়ে আসার জন্য পরশুরাম
হাত থেকে স্খলিত কুঠার দিয়ে
ব্রহ্মকুণ্ডের জলধারাকে হিমালয়ের
পাদদেশ পর্যন্ত আনতে সক্ষম হন। তারপর
লাঙ্গল দিয়ে মাটি কর্ষণ করে
হিমালয়ের পাদদেশ থেকে নারায়ণগঞ্জ
জেলার ‘লাঙ্গলবন্দ’ পর্যন্ত নিয়ে আসেন।
সুদূর হিমালয় থেকে একাদিক্রমে হাল
চালনায় ক্লান্ত হয়ে পরশুরাম বিশ্রাম
করার জন্যে এখানে লাঙ্গল বন্ধ রাখেন
বলে স্থানটির নাম হয় ‘লাঙ্গলবন্দ’।
যে মন্ত্র পড়ে স্নান করতে হয়, সে
স্নানমন্ত্রেও ব্রহ্মপুত্র স্নানের
মাহাত্ম্য বর্ণিত আছে :
ওঁ ব্রহ্মপুত্র মহাভাগ শান্তনোঃ কুলনন্দন
অমোঘোগর্ভসম্ভূত পাপং লোহিত্য মে
হর।
ত্বং ব্রহ্মপুত্র ভুবনতারণ-তীর্থরাজ
গম্ভীর-নীর পরিপূরত সর্বদেহ।
ত্বদ্দর্শনাদ্ হরতু মে ভবঘোরদুঃখং
সংযোগতঃ কলিযুগে ভগবন নমস্তে ।।
অর্থাৎ হে মহাভাগ ব্রহ্মপুত্র! তুমি শান্তনু
মুণির কুলতিলক, তুমি অমোঘা দেবীর
গর্ভে জন্মগ্রহণ করেছ। হে লোহিত্য! তুমি
আমার পাপ হরণ কর। হে ব্রহ্মপুত্র! তুমি
ভুবন পরিত্রাণকারী তীর্থরাজ, তোমার
সর্বদেহ গভীর সলিল রাশিদ্বারা
পরিপূরিত। তোমার দর্শন ও সংযোগ
দ্বারা এ কলিযুগে আমার ভবব্যাধিজনিত
ঘোর দুঃখ হরণ কর। হে ভগবান! তোমাকে
প্রণাম।
‘লাঙ্গলবন্দ’ স্নানে অধিক পুণ্যতিথি
যেটি : চৈত্র মাসের শুক্লা অষ্টমী
বুধবার ও পুনর্বসু নক্ষত্র যোগ হলে তাকে
‘বুধাষ্টমী’ বলে। প্রতি বার বছর পর পর এ
তিথি একত্রে মিলিত হয়। আর এ সময়
ব্রহ্মপুত্রে সর্বতীর্থের সমাগম হয় এবং
তীর্থরাজে পরিণত হয়। এই ‘বুধাষ্টমী’
যোগে ব্রহ্মপুত্র স্নানে সর্বপাপ থেকে
মুক্তি লাভ হয়।
বিশ্ববরেণ্য দার্শনিক ও আধ্যাত্মিক
ধর্মগুরু ড. মহানামব্রত ব্রহ্মচারীজীর
তথ্যমতে ‘মহাপ্রভু শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যদেব
লাঙ্গলবন্দে এসে স্নান ও তর্পণ
করেছিলেন।’ ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে পবিত্র
‘বুধাষ্টমী’ যোগে জননী ভুবনেশ্বরী
দেবীকে নিয়ে স্বামী বিবেকানন্দ,
নেপালের রাজা, মহাত্মাগান্ধীসহ বহু
সাধু-সন্ন্যাসী এ তীর্থ স্নান করেন।
বর্তমান সময়েও দেশী-বিদেশী লাখ লাখ
পুণ্যার্থীদের কথা বিবেচনা করে
বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু সমাজ
সংস্কার সমিতিসহ ধর্মীয় ও সামাজিক
সংগঠন বিভিন্ন স্নানঘাটে সেবাদান
করে থাকে।
Discussion about this post