২০১৩ সালে রুদ্ধদ্বার এক বৈঠকের লিখিত সিদ্ধান্তের মাধ্যমে শাপলা চত্বরে অবস্থান নিয়েছিল হেফাজতে ইসলাম। সে বছর ৪ মে লালবাগ জামিয়া কোরয়ানিয়া আরাবিয়া মাদ্রাসায় সংগঠনের শীর্ষ নেতারা ওই রূদ্ধদ্বার বৈঠকটি করেন।
বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, যে কোনও মূল্যে ঢাকা ঘেরাও করা হবে এবং অবরোধ পরবর্তী সমাবেশ শেষে অবস্থান কর্মসূচি গ্রহণ করা হবে। সংগঠনটি যদিও সেদিন দোয়া মাহফিল করতে শাপলা চত্বরে আসার কথা বলেছিল। হেফাজতের প্রয়াত আমির শাহ আহমদ শফীর নির্দেশে শাপলা চত্বরেই অবস্থানের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। অবস্থানের ঘোষণা দেন হেফাজতের প্রয়াত মহাসচিব জুনায়েদ বাবুনগরী।
অরাজনৈতিক সংগঠন হলেও ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারাই হেফাজতের নেতৃত্বে। এ সংগঠনের প্রয়াত আমির মহাপরিচালক আল্লামা শাহ আহমদ শফীকে সামনে রেখে এই আন্দোলন শুরু হলেও পরবর্তী সময়ে তা রাজনৈতিক আন্দোলনের রূপ নেয়। ৫ মে রাজধানীসহ সারাদেশে ব্যাপক সহিংসতা ও নাশকতা হয়।
সেদিন মতিঝিল এলাকায় প্রায় ৮ ঘণ্টা তাণ্ডব চালায় হেফাজতে ইসলামের কর্মীরা। পরিস্থিতি সামাল দিতে রাতে বিজিবি, ব়্যাব ও পুলিশের যৌথ বাহিনী মতিঝিলকে ঘিরে অভিযান চালালে পিছু হটে তারা। ৮৩ মামলায় ৩ হাজার ৪১৬ জনের নাম উল্লেখসহ ৮৪ হাজার ৯৭৬ জনকে আসামি করা হয় বলে পুলিশ সদর দফতর।
২০১৩ সালের পর কয়েক বছর ৫ মে দোয়া মাহফিল করেছিল হেফাজত। ধীরে ধীরে এই দিবস স্মরণ ও ৫ মে নিয়ে আলোচনা থেকে সরে আসেন হেফাজত নেতারা। এই ঘটনা পরবর্তী সময়ে নানাভাবে তারা টিকে থাকার চেষ্টা করে গেছে বলে মন্তব্য করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
তবে সর্বশেষ ২০২১ সালে ২৭ ও ২৮ মার্চ দু’দিন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আগমন বিরোধিতা করে বিক্ষোভ ও হরতালে সহিংস হয়ে ওঠে হেফাজত। বিভিন্ন কর্মসূচিতে ১৭ জন নিহত এবং শতাধিক আহত হয়। এরপর হেফাজতের পুরাতন কমিটি বাতিল করা হয়। যদিও সারা দেশব্যাপী জেলা, থানা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে হেফাজতে ইসলামের কমিটি গঠন করার কথা বললেও কোন অগ্রগতি নেই।
হেফাজতে ইসলামের নেতা মাওলানা মুহিউদ্দীন রাব্বানী বলেন, হেফাজত ৫ মে ভুলে যায়নি। বিভিন্ন কারণে এই দিনটিতে গতকয়েকবছর কোন পরিকল্পনা করা হয়নি। অনেক নেতা জেলে আছেন, জেলা পর্যায়ে কমিটি নেই। আগামীতে প্রয়োজন বুঝে কর্মসূচি দেওয়া হবে। তবে তৃণমূলের অনেক নেতাকর্মী ৫ মে স্মরণে কোনো কর্মসূচি না থাকায় হতাশা ব্যক্ত করেন।
যা ঘটেছিলো নারায়ণগঞ্জে :
নারায়ণগঞ্জে হেফাজতে ইসলামের লঙ্কাকাণ্ডের নেতৃত্বে ছিলেন ডিআইটি মসজিদের ঈমাম মাওলানা আবদুল আউয়াল। নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন মাদ্রাসা থেকে শিশু কিশোর শিক্ষার্থীদের জড়ো করে এক ভয়াবহ লংকাকান্ডের জন্ম দেয় এই মাওলানা আবদুল আউয়াল। যার বিরুদ্ধে রয়েছে ভয়াবহ অপরাধের অভিযোগ। আন্দোলনের নামে নাশকতার চূড়ান্ত অপরাধের জন্ম দেয় এই ইসলামের নামধারী স্বার্থান্বেষী চক্র। আন্দোলনের নামে নাশকতা ছাড়াও দায়িত্ব পালন করতে আসা গণমাধ্যমকর্মীদের মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ, টাকা ছিনতাইসহ মারপিটের ঘটনাও ঘটানোর হয় এই মাদ্রাসা পড়ুয়া শিশু কিশোরদের দিয়ে। পরবর্তীতে ওই ছিনতাই হওয়া মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ, টাকা ডিআইটি মসজিদ থেকে বিতর্কিত মাওলানা আবদুল আউয়াল তা ফেরৎ দিয়ে ক্ষমাও চান গণমাধ্যমকর্মীদের কাছে।
এমন ন্যাক্কার জনক ঘটনার ১১ বছর পরও সেই ঘটনা ভুলতে পারেনি সেদিনের অনেকেই।
২০১৩ সালের ৫ মে ঢাকাতে হেফাজতে ইসলামের মহাসমাবেশ ও রাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিবর্ষণ, টিআর সেল নিক্ষেপ কর সকলকে রাজধানীর শাপলা চত্তর থেকে ছত্রভঙ্গ করে দেয়ার পরদিন ৬ মে নারায়ণগঞ্জের সদর উপজেলার ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়ক দখল করে দফায় দফায় আগুণ সন্ত্রাস চালিয়ে ভীতিকর পরিস্থিতির জন্ম দেয় হেফাজত ইসলামীর নারায়ণগঞ্জের নেতা মাওলানা আবদুল আউয়াল। একদিকে সাধারণ মানুষের উপর হামলা অপরদিকে আগুণ সন্ত্রাস ছাড়াও আইনশংখলা বাহিনীর সদস্যদের হতাহতের ঘটনা ঘটানোর পর ফের নারায়ণঞ্জে হয়ে উঠে রক্তের খেলা।
মাওরানা আবদুল আ্উয়ালের ইসরামের জেহাদী ডাকের মোবাইল ফোনের আদেশ পেয়ে ৬ মে ভোর থেকে দুপুর পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জের শিমরাইলে ঢাকা-চট্রগ্রাম মহাসড়কে হেফাজতে ইসলাম, স্থানীয় লোকজন ও হেফাজত ইসলামীর সমর্থদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের টানা সাড়ে ৫ ঘণ্টার ব্যাপক সংঘর্ষে ১৪ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। তাদের মধ্যে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) এর দুই সদস্য ও পুলিশের ২ জন সদস্য ছিল।
এ ঘটনায় সিদ্ধিরগঞ্জ ও সোনারগাঁয়ে ১৭টি মামলা হয়েছিল।
এ ১৭টি মামলার মধ্যে সিদ্ধিরগঞ্জে ১১টি ও সোনারগাঁও থানায় ৬টি মামলা হয়। এখন পর্যন্ত বেশিরভাগ মামলার চার্জশীট আদালতে জমা দেওয়া হয়েছে।
সংঘর্ষের সময়ে রাস্তার উপর পড়ে থাকে লাশগুলো
২০১৩ সালের ৬ মে সকাল সিদ্ধিরগঞ্জের সানারপাড় এলাকায় মাদানী নগর মাদ্রাসায় অভিযান চালাতে গেলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে মাদ্রাসার ছাত্র, হেফাজতের কর্মীরা । সকাল সাড়ে ১১টা পর্যন্ত চলা বিরামহীন এ সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যায় অনেকে। তাদের লাশ দীর্ঘক্ষণ পড়ে ছিল মহাসড়কের উপরেই। এলাকাবাসী ও নিহতের স্বজনেরা বলছেন, নিহত কেউ হেফাজতের কর্মী না। তারা নিছক নিরীহ। কাজের উদ্দেশ্যেই তারা বাসা থেকে বের হয়েছিল। কিন্তু বুলেট কেড়ে নিয়েছিল তাদের প্রাণ।
বিজিবির ২ জন ও পুলিশের ২ সদস্য নিহত
সংঘর্ষ চলাকালে এক পর্যায়ে বিজিবি ও পুলিশ সদস্যদের রাস্তায় ফেলে বেধড়ক পেটাতে থাকে মাওলানা আউয়ালের সমর্থকরা । এতে পুলিশ ও বিজিবির অন্তত ৫০ সদস্য গুরুতর আহত হয়। তাদেরকে দ্রুত শহরের খানপুর ২০০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতাল, ১০০ শয্যার জেনারেল হাসপাতাল, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ও রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে পাঠানো হয়। ঢাকা নেওয়ার পথে ৩ জনের মৃত্যু ঘটে। নিহত বিজিবি সদস্য হলেন শাহ আলম (৪০), পুলিশের নায়েক ফিরোজ (৩৫) ও কনস্টেবল জাকারিয়া (২৮)। পরে মারা যান সিপাহী লাভলু।
৫ ঘণ্টা শুধু গুলির আওয়াজ
সকাল ৬টা হতে শুরু হয় মহাসড়কের প্রায় শতাধিক পয়েন্টে অগ্নি সংযোগ । একদিক আগুণ সন্ত্রাস অপরদেক ইট নিক্ষেপ এমন ঘটনায় সাড়ে ১১টা পর্যন্ত কাঁচপুর থেকে সাইনবোর্ড পর্যন্ত সংঘর্ষের সময়ে এ তিন কিলোমিটার এলাকায় শুধু শোনা গেছে গুলির মুহুর্মুহু শব্দ। বিরামহীনভাবে শব্দে এলাকায় দেখা দেয় তীব্র আতঙ্ক।
পুলিশ জানান, তারা কয়েক হাজার শর্টগানের রাবার বুলেট, চাইনিজ রাইফেলের গুলি ও টিয়ার সেল নিক্ষেপ করে। এছাড়া প্রচুর সাউন্ড গ্রেনেডের শব্দ শোনা গেছে। সকাল সাড়ে ১১টায় পরিস্থিতি শান্ত হলেও টিয়ার সেলের গ্যাসের ঝাজ বিরাজ করছিল বিকেল পর্যন্ত। সকাল ৬টা হতে সাড়ে ১১টা পর্যন্ত ৩ কিলোমিটার এলাকায় লোকজন চলাফেরা করতে পারেনি কাঁদানে গ্যাসের কারণে।
এদিকে সকাল ৬টা হতে সাড়ে ১১টা পর্যন্ত ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের সাইনবোর্ড হতে কাঁচপুর সেতু পর্যন্ত প্রায় ৩ কিলোমিটার জুড়ে ঢাকা-সিলেট ও ঢাকা-চট্রগ্রাম মহাসড়কে দুটি লেনের অন্তত শতাধিক গাড়িতে আগুন দেয় হেফাজতের মাওলানা আউয়াল সমর্থন করা হাজার হাজার নেতদা কর্মী। বিজিবি ও পুলিশের গাড়িতেও আগুণ দেয় এই ধর্মীয় সংগঠনের নেতা কর্মীরা। বিভিন্ন যানবাহনের গাড়িও ছিল ভাংচুর অবস্থায়। সড়কের ১০০ -১১০ টি স্থানে টায়ারে জ্বলছিল আগুন। সড়কের অনেক স্থানে বাঁশ, ইটপাটেকল ও রড ফেলে রাস্তায় অবরোধ সৃষ্টি করা হয়। সড়কের পাশে তখন মানুষের জটলা, হাতে ছিল বাঁশ আর লাঠিসোটা।
Discussion about this post