ফুটপাত ঘিরে নারায়ণগঞ্জ শহরে দফায় দফায় লংকাকান্ডের পর প্রভাবশলী চক্র এবং নগরবাসীর সমস্যা নিরসনের পরিবর্তে দীর্ঘদিনের জঞ্জাট টিকিয়ে রেখে ফায়দা হাসিলের জন্য সকল ধরণের অপচেষ্ঠা চালিয়ে যাচ্ছে ।
অথচ এই ফুটপাত দখলমুক্ত রাখতে ও নগরবাসীর স্বস্তির লক্ষ্যে ২০০৮ সালে প্রায় ৬০০ হকারের তালিকা করে শহরের মিশনপাড়া এলাকায় তাঁদের স্থায়ী দোকান করে দেওয়া হয়েছিল। প্রায় ১৫ বছর আগে নির্মিত মিশনপাড়া হকার্স মার্কেটের নাম এখনো অক্ষুণ্ন থাকলেও দোকানে আর হকারদের অস্তিত্ব নেই। ৪৫১টি দোকান বিক্রি করে দিয়ে আবার ফুটপাতে নেমে পড়েছেন হকাররা। সিটি কর্পোরেশনের তালিকা থেকেই এ তথ্য জানা গেছে।
৩ ফেব্রুয়ারী নাারয়ণগঞ্জের তিনজন জন প্রতিনিধি একত্রে বসে আবার হকারমুক্ত ফুটপাতের দাবি তুলেছেন। অভিযান শুরু করেছে পুলিশ। তবে হকাররা আন্দোলনে নেমে আবার পুনর্বাসন চাইছেন।
নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের তথ্য অনুযায়ী, শহরের মিশনপাড়া এলাকায় ৬০০ হকার এবং ডিআইটি এলাকায় ২০০ হকারকে পুনর্বাসন করেছে সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী। ওই দুই স্থান থেকেই সরে এসেছেন হকাররা। বিক্রি কম হয় অজুহাত দেখিয়ে সরে এলেও হকার্স মার্কেট এখনো কেনাবেচায় চাঙা। বিশেষ করে, স্বল্প আয়ের মানুষের কাছে হকার্স মার্কেট ভরসার স্থল।
সিটি কর্পোরেশনের কাছ থেকে দোকান নেওয়া ৬০০ হকারের তালিকা সংগ্রহ করেছে আজকের পত্রিকা। ২০০৮ সালে হকার্স মার্কেটে বরাদ্দ পেয়েছেন ৫৯৮ জন হকার। তাঁদের অধিকাংশই দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা। দোকান বরাদ্দ পাওয়া হকারদের মধ্যে ৪৫১ জন তাঁদের দোকান বিক্রি করে দিয়েছেন। এ দোকানিদের এখন আর কোনো ভাড়া দিতে হয় না। কেবল বিদ্যুৎ বিল দিয়ে যাচ্ছেন। অথচ সিটি করপোরেশনকে প্রতি মাসে ৪৫০ টাকা হারে ভাড়া দেওয়ার কথা এই দোকানিদের।
তালিকা ধরে অনুসন্ধানে পাওয়া যায়, দোকান বিক্রি করা অনেক হকার আবার ফুটপাতে ব্যবসা করছেন। সিটি কর্পোরেশনের মালিকানাধীন দোকান হাতবদল করতে অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন থাকলেও তা করেননি হকাররা। উল্টো নিজেদের সুবিধামতো দোকান ভেঙে বড় করে নিয়েছেন। হকারদের দোকানে এখন বসছে ক্ষুদ্র হোসিয়ারি থেকে শুরু করে ভাতের হোটেল।
শহরের ১২ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা মোস্তফা। দীর্ঘদিন প্রবাসে থাকার সুবাদে ভাইদের কাছে টাকা পাঠিয়েছেন। সেই টাকায় হকার্স মার্কেট থেকে কিনে নিয়েছেন দুটি দোকান। পুরোনো নামে দোকান সিটি করপোরেশনের কাছে লিপিবদ্ধ থাকলেও ভোগদখল করছেন নতুন মালিক। আলাদা করে চুক্তি করে নিয়েছেন আগের মালিকের কাছ থেকে। বিদ্যুৎ বিল দিয়ে আসছেন পুরোনো নামেই। ফলে বাড়তি সমস্যায় পড়তে হয় না তাঁদের।
হকার্স মার্কেটের এক রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ী নাম না প্রকাশ করার শর্তে বলেন, ‘আমি পাঁচটা দোকান কিনে একটা রেস্তোরাঁ বানাইছি। এক মালিকের নামে কারেন্ট রাখছি। বাকি চার মালিকের কারেন্ট কাইটা দিসে। যাদের থেকে কিনসি তাদের নাম সিটি করপোরেশনের কাছে থাকলেও মালিক তো আর আমার কাছে কিছু দাবি করেন না। সিটি করপোরেশনও কিছু কয় না। আমরা আমাগো মতো ব্যবসা করতাছি।’
বর্তমান প্রেক্ষাপটে কয়েকজন হকার ফুটপাতে পসরা নিয়ে বসতে গিয়ে অনেক বাধা বিপত্তির মুখে পরে ক্ষোভের সাথে বলেন, “আমরা কেউ কেউ তো চাই জনসাধারণের বিরক্তির কারণ না ঘটিয়ে ব্যবসা করি । কিন্তু এই ফুটপাতে ব্যবসা করতে এসে দেখলাম থানার ওসি থেকে শুরু করে পুলিশের কন্সস্টেবল পর্যন্ত নিয়মিত চাঁদাবাজি করেই যাচ্ছে। নেতাফেতা বাদ দেন মূলতঃ থানা পুলিশ যদি এই ফুটপাতের বিষয়ে দৃঢ় থাকে তবে কোন চাঁদাবাজি ই হবে না । আর আসাদ, রহিম মুন্সী সোহেল কিংবিা তাজুল ই বলেন এদের এই শহরে কোন অস্তিত্বই থাকবে না । যদি পুলিশের সাথে এই চাঁদাবাজদের সাথে পিড়িত না করে তবেই হবে পরিচ্ছন্ন এই নগরী। নেতা আর পুলিশের অতিমাত্রার লোভের কারেণ ই শহরে থকে অনিয়ন্ত্রিত। শহরের চিহ্নিত ১৯/২০ জন চাঁদাবাজ ই কোন দোকানদারী না করেই এখন আন্দোলন করে যাচ্ছে । কিন্তু কার জন্য ? হকারদের জন্য ? নিশ্চিত করে বলতে পারি এরা হকারদের জন্য কোন আন্দোলন করতেছেন না। এরা নিজেদের চাঁদাবাজি টিকিয়ে রাখতেই এই আন্দোলন করছে । কারণ চাঁদাবাজিতে লাভ বেশী। আর ফুটপাতে কোন হকার নাই । যাদের দেখেন পসরা নিয়ে বসেছে তারা ৫শ টাকার কামলা। আর এই দোকানের তো মহাজন আছেন । তারা সকলেই কোটিপতি। বিশ্বাস করেন আর নাই করেন, ফুটপাতের একজন দোকানী ৭০ লাখ টাকার পাইকারী জুতা কিনে এনেছেন আগামী রমজান ঈদে কে সামনে রেখে।’
কর্পোরেশনের বাজার কর্মকর্তা মনিরুজ্জামান বলেন, ‘দোকানপ্রতি ৪৫০ টাকা ভাড়া প্রতি মাসে সিটি কর্পোরেশনকে দেওয়ার কথা মালিকদের। পৌরসভা আমলে (২০০৮ সালে) নির্ধারিত এই ভাড়া এখনো বাড়ায়নি সিটি কর্পোরেশন। কয়েকজন দোকানি বাদে অধিকাংশই এসব ভাড়া পরিশোধ করেননি। সর্বনিম্ন ২০১৪ সাল থেকে সর্বোচ্চ ২০০৮ সাল থেকে বাকি রয়েছে অনেক দোকানের ভাড়া। সব মিলিয়ে সিটি কর্পোরেশনের এই হকার্স মার্কেট থেকে ৪ কোটি ৭০ লাখ ৩১ হাজার ৩০০ টাকা পাওনা। এই হিসাব মার্কেট চালু হওয়ার পর থেকে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত।’
অপরদিকে নগরীর ফুটপাতে ব্যবসা করা হকারদের থেকে জানা যায়, হকার নেতা আসাদ ও রহিম মুন্সির মাধ্যমে দৈনিক ১০০ টাকা চাঁদা দিতে হয়। এই চাঁদা বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে ভাগ-বাঁটোয়ারা হয়ে থাকে। রাজনীতিবিদ ও অসাধু সরকারি কর্মচারীও এই চাঁদার ভাগ পান। দৈনিক ১০০ টাকা করে চাঁদা উঠলে মাসে প্রায় ৩ হাজার টাকা ওঠে একজন হকারের কাছ থেকে। অথচ এই হকাররাই দোকান বরাদ্দ পাওয়ার পর মাসে ৪৫০ টাকা ভাড়া দেননি।
হকারদের পক্ষে সিপিবির জেলা সভাপতি হাফিজুল ইসলাম বলেন, ‘হকাররা দোকান বিক্রি করেছেন, এই তথ্যে আমি একমত নই। তাঁরা দোকানগুলো বড় করে একজনের কাছে দায়িত্ব দিয়েছেন। এটা সত্য, অনেকেই ফের ফুটপাতে ফিরে এসেছেন। আমরা মনে করি, এই স্থানে বহুতল ভবন করে হকারদের পুনর্বাসন করা হলে এবং একটি নীতিমালার মধ্যে নিয়ে আসা হলে হকাররা উপকৃত হবেন।’
হকার নিয়ে চলমান সংকটের বিষয়ে মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী বলেন, ‘আমরা হকারদের পুনর্বাসন আগেও করেছি। কিন্তু হকাররা দোকান বিক্রি করে আবার রাস্তায় নেমে এসেছেন। কিন্তু বারবার সিটি কর্পোরেশনের ভর্তুকি দেবে, আর তাঁরা দোকান বিক্রি করে ব্যবসা করবেন, ফুটপাত দখল করবেন—এটা অযৌক্তিক। কারা দোকান পেয়েছেন এবং কারা বর্তমানে দোকানের মালিক, সমস্ত তালিকা করে জেলা প্রশাসকের কাছে পাঠানো হয়েছে। হকার্স মার্কেটে প্রায় সাড়ে ৪ কোটি টাকার বেশি ভাড়া বকেয়া আছে। সেই টাকা পরিশোধ করলে তাঁদের জন্য কাজ করতে আমাদের সুবিধা হবে।’
Discussion about this post