পরিবেশ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার পর এবার দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নতুন মন্ত্রী শপথ নিলে উঠেপরে কাজ দেখানোর জন্য নতুন নতুন নাটক মঞ্চায়ন করেই যাচ্ছে পরিবেশ অধিদপ্তরের অসাধু কর্মকর্তারা। অবৈধ সকল ইট ভাটায় অভিযান বর্তমান প্রেক্ষাপটে অভিযান চালালেও এতোদিন এই পরিবেশ অদিদপ্তর কি করেছে ? বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরের মধ্যে রাজধানী ঢাকা বারবার শীর্ষ অবস্থানে থাকার পরও পরিবেশ অধিদপ্তরের অসাধু চক্রের দৌড়াত্ম এতটাই দূর্ধর্ষ যার কারণে এই বিপর্যয় ঠেকানো সম্ভব হচ্ছে না।
গত সেপ্টেম্বরে নারায়ণগঞ্জ পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে বদলী হন মহা দূর্ণীতিবাজ উপ পরিচালক মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল মামুন । তার বিরুদ্ধে পুরো নারায়ণগঞ্জ জেলায় গার্মেন্টস, ডাইং কারখানা ইটিপি বন্ধ রেখে পরিবেশ ধ্বংস করতে সকল কল কারখানা, ইট ভাটা, মিল ফ্যাক্টরি, ক্লিনিকসহ পরিবেশ অধিদপ্তর নিয়ন্ত্রিত সকল প্রতিষ্ঠান থেকে নিয়মিত মাসোহারা আদায়ের অভিযোগ ছিলো জোড়ালোভাবে ।
এরপরে একই পদে অধিষ্ঠিত হন আরেক উপ পরিচালক হাফিজুর রহমান। তার প্রতি নারায়ণগঞ্জের মানুষ ব্যাপক আস্থা রাখলেও তিনি আরো বড় মাপের দূর্ণীতিবাজ বলে এই চার মাসের মধ্যেই প্রমাণ করেছেন বলে খোদ নারায়ণগঞ্জ পরিবেশ অধিদপ্তরের কেউ কেউ ক্ষুদ্ধ মন্তব্য করেন।
নাম প্রকাশ না করা অনুরোধে পরিবেশ অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, “গ্রামে প্রচলিত একটি প্রবাদ হচ্ছে, এক বউ তাড়াইলাম চাউল চাবানোর ভয়ে আরেক বউ আইন্না দেখি চাউলে খুদে গিলে ! আমাদের পরিবেশ অধিদপ্তরের বর্তমান কর্তা হচ্ছে এমন ।‘
রাজধানী ঢাকার পাশের জেলা নারায়ণগঞ্জের একেকজন কর্মকর্তা যেন দূর্ণীতির বিশাল ফিরিস্তি হাতে নিয়ে নাারয়ণগঞ্জে বদলী হয়েই অবৈধ ইটভাটা, সকল ডাইং কারখানা, ক্যামিকেল কারখানাসহ পরিবেশ ধ্বংস করতে যারা জড়িত তাদের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তুলে মাসোয়ারা আদায় করে যাচ্ছে নির্লজ্জতার সাথে। এমন পরিবেশ ধ্বংস করে রাজধানী ঢাকার পাশের কয়েকটি নদী যেমন বড়িগঙ্গা, শীতলক্ষা ও বালু নদীতে বর্জ্য ফেলার সযোগ করে দেয়ায় মারাত্মক প্রভাব পরেছে এই নদীগুলিতে। যার একটি জ্বলন্ত উদহারণ হিসেবে নয়ন আদিত্য তুলে এনেছেন একটি ভয়াবহ চিত্র। যা প্রকাশ পেয়েছে একাত্তর অনলাইনে।
এমন অসংখ্য প্রতিবেদন গণমাধ্যমে উঠে আসলেও পরিবেশ অধিদপ্তরের নির্লজ্জ উচ্ছিষ্ঠভোগীদের দৌড়াত্ম কোন অবস্থাতেই বন্ধ না হওয়ায় পরিবেশের উন্নতি হচ্ছে না কোন অবস্থাতেই।
বুড়িগঙ্গার দূষণ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে কোনো মাছ থেকে জলজ উদ্ভিদ এমনকি পানির পোকামাকড়ও আর বাঁচতে পারছে না। ১০ বছরে এই নদীতে অন্তত চার প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হয়েছে।
তবে, অভিযোজন প্রক্রিয়ায় মাছের একটি প্রজাতি কোনোমতে টিকে আছে। কিন্তু সেই মাছ বেশিদিন খেলে ক্যান্সারের ঝুঁকি রয়েছে। ১০ বছরের গবেষণায় এসব তথ্য পেয়েছেন গবেষকরা।
সরেজমিনে নদীর পানি দেখে মনে হতে পারে কালো কোন ক্যানভাস রঙিন হয়েছে শিল্পীর হাতের ছোঁয়ায়। বাস্তবতা হচ্ছে এটি পানিতে ভাসমান প্লাস্টিকের সূক্ষ্ম কণা।
রাজধানী ঢাকার পাশে বয়ে চলা বুড়িগঙ্গার কালো রঙের পানি বলছে নদীর জীবনের অবস্থা। নগরীর বর্জ্য ও সুয়ারেজে ও ড্রেনেজ লাইন সাথে পলিথিন। সব মিলিয়ে এই নদীর নীল পানি পরিণত হয়েছে নিকষ কালোতে। আর পানির স্তরে স্তরে মেলে নানা ধরনের পলিথিন।
এসবের মাঝেই চোখে পড়ছিলো মাছের লাফালাফি। কথা হয় বুড়িগঙ্গার বুকে জীবনের ৪০ বছর কাটানো মাঝি সাত্তারের সাথে। তিনি জানান, এখন আর তেমন মাছের দেখা মেলেনা। যাও বা পাওয়া যায়, তা খাবারের অযোগ্য। মাছ থেকে উৎকট গন্ধ আসে। তার সাথেই একমত হন বেশ কয়েকজন স্থানীয় বাসিন্দা। জানান, রান্না করার পরও সেই উৎকট গন্ধ যায় না।
এক জেলে দম্পতি প্রতিবেদককে জানালেন, তাদের জালে ৭০ কেজির মতো মাছ উঠেছে। তবে এর মধ্যে সাকার মাছই সব। অন্য মাছ পাওয়া গেছে হাতে গোনা কয়েকটা। এই মাছ ২০২৩ সালে সাকার মাছ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে সরকার। তবে ছড়িয়ে পরা এই মাছের সংখ্যা কীভাবে কমানো যাবে তার কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি।
প্রায় ১০ বছর ধরে দেশের নদ-নদীর পানি ও মাছের উপর গবেষণা করছেন শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের একোয়াকালচারের বিভাগীয় প্রধান মীর মোহাম্মদ আলী।
তিনি জানান, কালি বাউশ, টেংরা, চাপিলা, পুঁটি, নলাসহ দূষণের কারণে প্রায় সকল জাতের মাছ বিলুপ্ত হয়েছে। এখন যে মাছ গুলো পাওয়া যাচ্ছে তা ‘ক্যাট ফিশ’ প্রজাতিভুক্ত শিং, মাগুর, কৈ, শোল আর সাকার মাউথ। যা সরাসরি বায়ু মন্ডল থেকে অক্সিজেন নিতে পারে এবং পানিতে অল্প অক্সিজেনেই বাঁচতে পারে।
মীর মোহাম্মদ আলী বলেন, আমি ২০১৪-১৫ সালের দিকেও আরও বেশ কয়েক ধরনের মাছ পেয়েছিলাম। কিন্তু ২০২০ বা ২১ সালের দিকে মাত্র তিন থেকে চার ধরনের মাছ আমরা পেয়েছি।
মীর আলী জানান, বিভিন্ন ধরনের ভারী ধাতুর পরিমাণ বুড়িগঙ্গায় খুবই বেশি। বেশিদিন ধরে এ মাছ খেলে ক্যান্সারের ঝুঁকি তৈরি হতে পারে। এছাড়া আরও নানান ধরনের সমস্যাও দেখা দিতে পারে এ মাছ খাওয়ার ফলে।
উদ্বেগের বিষয় হলো, বুড়িগঙ্গায় খাপ খাইয়ে নেয়া এই মাছগুলোতে ক্যান্সার তৈরি করে এমন সব উপাদানের মাত্রাতিরিক্ত উপস্থিতি পাওয়া গেছে।
মৎস্য ও পশুসম্পদ মন্ত্রণালয়ের নির্ধারিত মান ধরা হয়েছে লেড ০.৩ মি:গ্রা:/কেজি, আর্সেনিক ৫.০০ মি:গ্রা: ক্যাডমিয়াম ০.২৫ মি:গ্রা এবং ক্রোমিয়াম ১ মি:গ্রা:/কেজি।
গাইড লাইন অনুযায়ী এই খাবারে মাত্রার অতিক্রম করলেই স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়ে। সেখানে কয়েকগুণ বেশি মাত্রা ক্যান্সারের কারণ হতে পারে। এই নদীর মাছগুলোতে আর্সেনিক ৫ মিলিগ্রাম মাত্রায় থাকার কথা থাকলেও তা আছে ৪ গুণের বেশি। আর ক্রোমিয়াম ৮ গুণ এবং লেডের উপস্থিতি পাওয়া গেছে কয়েক’ শ গুণ বেশি।
ফলে নদীর জীব বৈচিত্র্যতায় যেমন প্রভাব পরেছে, তেমনি নদী পাড়ের জেলেদের দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্য ঝুঁকির সৃষ্টি হচ্ছে।
Discussion about this post