নারায়ণগঞ্জের চাঞ্চল্যকর ও লোমহর্ষক সাত খুনের মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত এক নম্বর আসামি নূর হোসেন এখন আছেন জেলাখানায় কনডেম সেলে। কিন্তু তার সাম্রাজ্য আছে বহাল তবিয়তে। জেলখানার কনডেম সেলে থেকেই তার হাতে গড়া অবৈধ সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণ করছেন তিনি। নূর হোসেনের ভাই-ভাতিজাসহ তার সন্ত্রাসী বাহিনী প্রতিদিন সিদ্ধিরগঞ্জে চাঁদাবাজি, দখল ও মাদক ব্যবসা চালাচ্ছেন।
খুনের সঙ্গেও যুক্ত হয়েছেন কেউ কেউ।
নতুন করে এলাকায় সরকারি জায়গা দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে মার্কেট। নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকা ঘুরে এ চিত্র পাওয়া গেছে। কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম, অ্যাডভোকেট চন্দন সরকারসহ আলোচিত সাত খুনের মামলায় নারায়ণগঞ্জের সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর নূর হোসেনসহ ২৬ জনের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দিয়েছে আদালত।
এলাকাবাসীর ভাষ্য, সাত খুনের আগে নূর হোসেন সিদ্ধিরগঞ্জে জমি দখল, চিটাগাং রোড ও শিমরাইল ট্রাকস্ট্যান্ড থেকে চাঁদাবাজি, শীতলক্ষ্যা থেকে বালু উত্তোলন, নদীতীর দখল, মাদক ব্যবসা ও জুয়ার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তিনি ছিলেন এলাকায় অপরাধ জগতের গডফাদার। সিদ্ধিরগঞ্জের অপরাধের নিয়ন্ত্রক নূর হোসেন। এখনো গডফাদার রূপে জেলখানায় থেকে সাম্রাজ্য চালানোর সার্বিক নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছেন। তার নির্দেশনা বাস্তবায়ন করছেন তার বাহিনী।
পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা প্রতি মাসে তার বাহিনীর কাছ থেকে নির্ধারিত হারে টাকা নিচ্ছে।
এ কারণে অনেকটা বেপরোয়া নূর হোসেনের সন্ত্রাসী বাহিনী। যা এলাকাবাসীকে ভাবিয়ে তুলেছে। একই সঙ্গে নিহতের স্বজনরা রয়েছেন আতঙ্কে। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত নূর হোসেনসহ ২৬ জনের মৃত্যুদণ্ড রায় দ্রুত বাস্তবায়ন ও তার সন্ত্রাসী বাহিনীর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন এলাকাবাসী ও নিহতের স্বজনরা।
এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন তারা।
লোমহর্ষক সেই সাত খুনের ৯ বছর আজ।
সাত খুন মামলার রায়ের সর্বশেষ অবস্থা বিষয়ে আদালত সূত্রে জানা গেছে, হাইকোর্টে রায় নিষ্পত্তি হয়েছে। এখন আপিল বিভাগে শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে।
২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল সাবেক কাউন্সিলর নজরুল ইসলামসহ সাত জন অপহরণ ও পরে তাদের হত্যা করা হয়। এ ঘটনার মূল আসামি সাবেক কাউন্সিলর নূর হোসেন ফাঁসির দণ্ড নিয়ে কারাগারে থাকলেও তার স্বজনরা আজ প্রতিষ্ঠিত। নূর হোসেনের সাম্রাজ্য বর্তমানে তাদের দখলে। শুধু নূর হোসেনের স্বজনরা নয়, তার সহযোগীরাও নানা অপকর্ম করে বেড়াচ্ছে। অন্যদিকে নিহত সাত জনের পরিবার আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে। এদের একদিকে আর্থিক কষ্টে মানবেতর জীবনযাপন অন্যদিকে কখন খুনির লোকজন আক্রমণ করে—এই ভয়ে স্বজনহারা পরিবারগুলোর দিন আতঙ্কে কাটছে। তাদের ভয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গেও এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি নিহতের স্বজনরা।
সাত খুনের মূল হত্যাকাণ্ডের শিকার নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের (নাসিক) সাবেক কাউন্সিলর ও প্যানেল মেয়র মো. নজরুল ইসলাম। নিহত নজরুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম সিদ্ধিরগঞ্জের মিজমিজি তার বাবার দেওয়া বাড়িতে বসবাস করেন। গতকাল তার বাসায় গেলে এ বিষয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে রাজি হননি। রায় প্রকাশের সাড়ে চার বছর পরও রায় কার্যকর না হওয়ায় হতাশার কথা জানিয়ে বলেন, স্বামী নেই। আজ বাবাও নেই। এ বাড়িতেই ছেলেমেয়ে নিয়ে চরম আতঙ্কে বসবাস করছি। রায়ের বিষয়ে তিনি জানান, এটা আল্লাহর ওপর ছেড়ে দিয়েছি। এ নিয়ে আমার আর কিছুই বলার নেই।
এলাকাবাসী জানায়, সাত খুনের মূল নূর হোসেন ফাঁসির দণ্ড নিয়ে কারাগারে থাকলেও তার ভাই ও ভাতিজাসহ ক্যাডার বাহিনী শিমরাইল মোড়ে ট্রাকচালক ইউনিয়নের সভাপতি হয়ে পুরু এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে চাঁদাবাজি করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। শিমরাইল মোড় এখন নূর হোসেনের দখলেই আছে। এছাড়াও মামলার এজাহার নামীয় আসামিরা এ এলাকার প্রভাবশালী হওয়ায় নিহতের স্বজনরা আতঙ্কে রয়েছে।
আরেক নিহত মনিরুজ্জামান স্বপনের স্ত্রী মোরশেদা আক্তারও তার মেয়ে নিয়ে আতঙ্কে রয়েছেন। তিনি এ বিষয়ে কিছুই বলতে রাজি হননি। নিহত মনিরুজ্জামানের ছোট ভাই নাসিক কাউন্সিলর মিজানুর রহমান রিপন বলেন, ১৭ কোটি মানুষের আশারস্থল প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার সুদৃষ্টি কামনা করছি।
এদিকে নিহত নজরুলের সহযোগী নিহত তাজুল ইসলামের পরিবার, বন্ধু লিটনের পরিবার, চালক জাহাঙ্গীরের পরিবারও আর্থিক কষ্টে মানবেতর জীবন যাপন করছে বলে তারা জানিয়েছে।
উল্লেখ্য, ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ আদালতে মামলায় হাজিরা দিয়ে ফেরার পথে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের ফতুল্লার লামাপাড়া এলাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র ও ২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম ও আইনজীবী চন্দন সরকারসহ সাত জনকে অপহরণ করা হয়। অপহরণের তিন দিন পর ৩০ এপ্রিল নজরুলসহ ছয় জন ও ১ মে আরেক জনের লাশ শীতলক্ষ্যা নদীর শান্তিরচর থেকে উদ্ধার করে পুলিশ। সাত খুনে নিহতরা হলেন—নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম, আইনজীবী চন্দন সরকার, যুবলীগ নেতা মনিরুজ্জামান স্বপন, স্বপনের গাড়িচালক জাহাঙ্গীর, নজরুলের সহযোগী তাজুল ইসলাম, নজরুলের বন্ধু সিরাজুল ইসলাম লিটন ও চন্দন সরকারের গাড়িচালক ইব্রাহিম।
এ ঘটনায় নিহত নজরুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি ও নিহত আইনজীবী চন্দন সরকারের জামাতা বিজয় কুমার পাল বাদী হয়ে ফতুল্লা থানায় পৃথক দুটি মামলা দায়ের করেন। এ মামলায় ২০১৭ সালের ১৬ জানুয়ারি সাবেক কাউন্সিলর নূর হোসেন, র্যাব-১১-এর চাকরিচ্যুত অধিনায়ক লে. কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, মেজর আরিফ হোসেন ও লে. কমান্ডার এম মাসুদ রানাসহ ২৬ জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং ৯ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা প্রদান করে নারায়ণগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ আদালত। নিম্ন আদালতের পর উচ্চ আদালত ২০১৮ সালে ২২ আগস্ট ১৫ জনের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ বহাল রেখে বাকি আসামিদের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা বহাল রাখে। বর্তমানে মামলাটি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে বিচারাধীন। সাড়ে চার বছর ধরে মামলাটি আপিল বিভাগে থাকায় নিহতদের আত্মীয়স্বজনরা হতাশা প্রকাশ করেছেন। নিহতদের পরিবারসহ নারায়ণগঞ্জবাসী সাত খুন মামলার রায় দ্রুত কার্যকর করার দাবি জানিয়েছেন।
Discussion about this post