মা তাহেরা বেগম কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘আমার পোলারে লাঠি, হাতুড়ি দিয়ে মারছে। টাকা দিয়া দিমু কইয়া কতবার পাও ধইরা কানলাম। কিন্তু পাষানগো মন গলে নাই। হাতুড়ি দিয়া আমার পোলাডার মাথা ভাইঙ্গালাইসে। যেই পোলার চোখে চুমা দিতাম ওই চোখ তুইল্লালাইসে। আমার চোখের সামনে মানিকরে মাইরা লাইলো হাশমতে।’
এমন কান্না পুরো আড়াইহাজারের সকলের মুখে উচ্চারিত হচ্ছে । স্থানীয় আওয়ামীলীগ নেতাদের কেউ কেউ এমন হত্যাকান্ডের তীব্র নিন্দা প্রকাশ করে বলেছেন, “আমরা আওয়ামীলীগ – বিএনপি বুঝি না । আমরা এমন হত্যাকান্ডর বিচাই চাই বলেই তাৎক্ষনিকভাবে গ্রেফতার হয়েছে আসামী ।
বুধবার (৫ এপ্রিল) মধ্যরাতে আড়াইহাজারের যুবদল নেতা মাহাবুবুল আলম হত্যার ঘটনায় মামলা হয়েছে। নিহত মাহাবুবের বড় ভাই মহিবুর বাদী হয়ে ১৪ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতনামা আরও ৪-৫ জনকে আসামি করে আড়াইহাজার থানায় এই মামলা দায়ের করেছেন।
মামলায় প্রধান আসামি করা হয়েছে দুপ্তারা ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক লীগের ৬নং ওয়ার্ডের সভাপতি হাসমত আলীকে। অন্য আসামিরা হলেন- কিছমত আলী, কামাল, ডলি আক্তার, ইব্রাহীম, আবু তাহের, আইয়ুব, হান্নান, অনিক, আলামিন, শান্ত, নূরা, সাইফুল ও আমান।
এর আগে গত ৪ এপ্রিল আড়াইহাজারের দুপ্তারা ইউনিয়নের সিংরাটি এলাকায় পাওনা টাকার জেরে মাহাবুব আলমকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে নির্মমভাবে পিটিয়ে, কুপিয়ে ও চোখ তুলে হত্যা করা হয়।
নিহত মাহাবুব দুপ্তারা ইউনিয়নের ৬নং ওয়ার্ডের সিংরাটি এলাকার হাজী আব্দুল হানিফার ছেলে। তিনি দুপ্তারা ইউনিয়ন যুবদলের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন।
স্থানীয়রা জানান, একই গ্রামের হাশমত মিয়ার কাছে মাহাবুব একটি জমি বিক্রির জন্য ৩ লাখ টাকা বায়না নিয়েছিলেন। কিন্তু কিছুদিন যাবৎ হাশমত বায়নার টাকা ফেরৎ চাচ্ছিলেন। এর জের ধরে মঙ্গলবার কালিবাড়ি এলাকা থেকে মাহাবুবকে হাশমত আলীর নেতৃত্বে একদল লোক তুলে নিয়ে যায়। পরে হাশমত আলী সিংরাটি এলাকার তার নিজ বাড়িতে নিয়ে একটি কক্ষে মাহাবুবকে আটকে রেখে দীর্ঘ সময় ধরে মারধর করেন। তাদের মারধরে মাহাবুব গুরুতর আহত হয়ে পড়লে তাকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় উদ্ধার করে আড়াইহাজার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। হাসপাতালে নেওয়ার পর তার শারীরিক অবস্থার আরও অবনতি হলে ঢাকায় নেওয়ার পথে মৃত্যু হয়।
নিহত মাহাবুবের চাচা মজিবর রহমান বলেন, একই গ্রামের হাশমত মিয়ার কাছে মাহাবুব তার একটি জমি বিক্রির জন্য ৩ লাখ টাকা বায়না নেয়। কিন্তু কিছুদিন যাবৎ হাশমত সেই জমি নেবে না জানিয়ে বায়নার টাকা ফেরৎ চায়। মাহাবুব টাকা ফেরতের জন্য সময় চায়। এ নিয়ে তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। সকালে মাহাবুব উপজেলার কালিবাড়ি এলাকায় গেলে সেখানে হাশমতের লোকজন প্রথমে মাহাবুবকে মারধর করে। এরপর অপহরণ করে একটি সিএনজিতে করে হাশমতের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে হাশমত, তার ভাই কিসমত ও কামালসহ পরিবারের লোকজন পর্যায়ক্রমে তাকে মারধর করতে থাকে।
তিনি আরও বলেন, খবর পেয়ে মাহাবুবের বাবা হানিফ মিয়া, মা তাহেরা বেগম, দুই ভাই মহিবুর ও হাবিবুর এবং আমি হাশমতের বাড়িতে যাই। সেখানে গিয়ে দেখি মাহাবুবকে তারা মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্যাতন করছে। তারা লাঠি ও হাতুড়ি দিয়ে তাকে পেটাচ্ছে। এসময় আমরা টাকা পরিশোধ করে দেবো জানিয়ে মাহাবুবের প্রাণ ভিক্ষা চাই। কিন্তু আমাদের অনুনয় বিনয়ে তাদের মন গলেনি। উল্টো আমাদের সামনেই মাহাবুবের একটি চোখ উঠিয়ে ফেলা হয়। হাতুড়ি দিয়ে পর্যায়ক্রমে তার মাথায় আঘাত করে মাথার খুলি ফাটিয়ে রক্তাক্ত করা হয়। মাহাবুব জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লে তারা আমাদের বলে এবার নিয়ে যা।
নিহত মাহবুব আলমের স্ত্রী সাহিদা আক্তার বলেন, ‘কত বড় ডাকাইত, দিনে-দুপুরবেলা পিডায়। আমার স্বামী রোজা রাখছে, আর মাইরেন না আপনারা। মাফ কইরা দেন। এগো মতো ডাকাইত এ পৃথিবীতে আর কেউ হইব না। ধইরা আইনা বাড়িতে কোপাইয়া মাইরা ফালাইছে। জীবন ভিক্ষা চাইলাম দিল না।’
আড়াইহাজার থানার উপ পরিদর্শক (এসআই) নাহিদ বলেন, হাসমত ও তার লোকজন মিলিত হয়ে মাহবুব কে সিএনজিতে উঠিয়ে বাড়িতে এনে মারধর করে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে – এমন খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে এসে দেশীয় অস্ত্রসহ হাতেনাতে মোট আটজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এই ঘটনায় মামলার প্রস্তুতি চলছে। আরো কেউ জড়িত কি না তদন্ত করে তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।
আড়াইহাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মুহাম্মদ ইমদাদুল ইসলাম তৈয়ব গণমাধ্যমকে বলেন, হত্যার ঘটনায় মামলা দায়ের করা হয়েছে। আরো আসামিদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।
Discussion about this post