সাংবাদিক দম্পতি সাগর- রুনি হত্যার তদন্ত এতদিন ডিএনএ টেস্টে ঝুলে ছিল৷ কিন্তু এবার জানা গেল ডিএনএ টেস্টেও হত্যাকারীদের চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি৷ কারণ, ওই টেস্টের মাধ্যমে সুনির্দিষ্ট কোনো সিদ্ধান্তে আসা আসতে পারেনি ব়্যাব ৷
ডিএনএ টেস্টের ব্যাপারে তিনি হতাশা প্রকাশ করে বলেন, ‘‘আসলে আমরা চেষ্টা করেছিলাম ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে হত্যকারীদের চিহ্নিত করতে৷ এজন্যই যুক্তরাষ্ট্রের সেরা ল্যাবে ডিএনএ টেস্টের জন্য পাচিয়েছিলাম৷ কিন্তু এখন তাদের ফল পেয়ে আমরা অনেটাই হতাশ৷ আমরা হত্যাকাণ্ডের মোটিভ সম্পর্কেও এখনো নিশ্চিত নই৷’’
২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি রাতে সাংবাদিক দম্পতি সাগর সারওয়ার ও মেহেরুন রুনি তাদের পশ্চিম রাজাবাজারের বাসায় খুন হন৷ ওই ঘটনার সময় বাসায় তাদের সঙ্গে ছিল শিশু পুত্র মেঘ ৷ গত ১১ বছরে এই মামলার তদন্ত সংস্থা পরিবর্তন হয়েছে তিনবার৷ সর্বশেষ আদালতের নির্দেশে র্যাব মামলাটি তদন্ত করছে৷ সেখানে বার বার তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তন হয়েছে৷ এ পর্যন্ত ৯৫ বার তারিখ দিয়েও তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে জমা দিতে পারেননি তদন্তকারীরা৷ কিন্তু হত্যাকাণ্ডের পর তখনকার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন ৪৮ ঘন্টার মধ্যেই অপরাধীদের গ্রেপ্তারের কথা বলেছিলেন৷ তিনি তখন দাবি করেছিলেন সব তথ্য তারা পেয়ে গেছেন৷
আমার প্রশ্ন তারা কি উদ্দেশ্যমূলকভাবে তদন্তে দেরি করছে, না ভয় পাচ্ছে প্রকাশ করতে?: সালেহা মুনির
তার কথা, ‘‘পিবিআই যদি ৩০-৩৫ বছর পর সগিরা মোর্শেদ হত্যাকাণ্ডের অপরাধীদের চিহ্নিত করতে পারে, তাহলে র্যাব কেন পারে না ? তারা না পারলে বলুক, তদন্ত ছেড়ে দিক৷ যারা পারে, তারা তদন্ত করুক ৷ আমার প্রশ্ন- তারা কি উদ্দেশ্যমূলকভাবে তদন্তে দেরি করছে, না ভয় পাচ্ছে প্রকাশ করতে ?’’
তিনি বলেন, ‘‘এর আগে র্যাব বলল ডিএনএ টেস্টে দুই জনের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ মিলেছে৷ তারপর আর কোনো খবর নেই ৷ তারা কি শুধু ল্যাবেই পাঠাবে? ডিএন টেস্ট ছাড়া আরো কোনো তদন্ত নেই! তারা কোনো তদন্ত করবে না ?’’
সাগর সারোয়ারের মা কান্নাজড়িত কন্ঠে বলেন, ‘‘রুনির মা তদন্তের শেষ না দেখেই মারা গেছেন ৷ আমারও সময় শেষ হয়ে আসছে৷ আমি যতদিন বেঁচে থাকবো, বিচার চেয়েই যাবো৷ আমি আমার ছেলের কবরের পাশে যাবো না অপরাধীরা ধরা পড়ার আগে ৷’’
ডিএনএ টেস্টের ফল আসেনি
এই মামলা এখন তদন্ত করছেন র্যাবের অ্যাডিশানল এসপি শফিকুল ইসলাম৷ তিনি তার ফোন বন্ধ রেখেছেন কয়েকদিন ধরে, যাতে কেউ তার সঙ্গে যোগাডোগ করতে না পারেন৷
তবে র্যাবের দায়িত্বশীল কয়েক জনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, র্যাব মামলার তদন্তে নেমে গ্রেপ্তারকৃত আট আসামি, নিহত সাগর-রুনি এবং স্বজনসহ ২৫ জনের ডিএনএ নমুনা পরীক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে পাঠায়৷ যুক্তরাষ্ট্রের পরীক্ষাগার থেকে পরীক্ষার রিপোর্টগুলো হাতে পাওয়ার পর অপরাধচিত্রের প্রতিবেদন (ক্রাইম সিন রিপোর্ট) পর্যালোচনা করে দুইজনের ডিএনএর পূর্ণাঙ্গ প্রোফাইল পেয়েছে৷ তবে তাতে সন্দেহভাজন খুনি শনাক্ত হয়নি৷
এই মামলায় গ্রেপ্তার আট জনের মধ্যে পাঁচজন- রফিকুল, বকুল, সাইদ, মিন্টু ও কামনুন হাসান ওরফে অরুন মহাখালীর বক্ষব্যাধি হাসপাতালের চিকিৎসক নারায়ণচন্দ্র রায় হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত৷ গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে সাগর-রুনির পারিবারিক বন্ধু তানভীর এবং বাসার নিরাপত্তাকর্মী পলাশ রুদ্র পাল ও হুমায়ূন কবীরকে৷ তারা সবাই হাইকোর্ট থেকে জামিন পেয়েছেন৷ সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডে দুই মাস পর র্যাবকে আদালত এই মামলা তদন্তের দায়িত্ব দেয়৷ এ পর্যন্ত এই মামলায় তারা ১৬০ জনের জবানবন্দি নিয়েছেন৷
দুই-তিন বছর ধরে ব়্যাবের তদন্তকারীরা আর আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন না: নওশের রোমান
‘এই সরকারের তদন্তে অনীহা আছে’
রুনির ভাই নওশের রোমান বলেন, ‘‘দুই-তিন বছর ধরে র্যাবের তদন্তকারীরা আর আমাদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করেন না৷ আমরাও করি না৷ করলে তো একই কথা বলবে- আমরা চেষ্টা করছি, তদন্ত অব্যাহত আছে৷ আমার মনে হয় এই সরকারের আমলে এই হত্যার বিচার পাবো না৷ এই সরকার এর বিচার বা তদন্তে কোনো আগ্রহ দেখাচ্ছে না৷ হয়ত কাউকে তারা আড়াল করতে চাইছে বা কোনো প্রভাবশালীদের রক্ষা করতে চাইছে ৷’’
তিনি বলেন, ‘‘তদন্ত চলাকালে এর আগে আমাদের হয়রানিও করা হয়েছে৷ আমাদের জড়িয়ে কথা বলা হয়েছে৷ আমাদের সঙ্গে যতবার কথা বলতে চেয়েছে, আমরা বলেছি৷ আমাদের যতবার ডেকেছে, গিয়েছি৷ এখন আমরা হতাশ, তবে আশা ছাড়িনি ৷’’
র্যাবের বক্তব্য
র্যাবের পরিচালক, মিডিয়া অ্যান্ড লিগ্যাল উইং কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘‘সাগর-রুনি হত্যা মামলাটি অত্যন্ত সংবেদনশীল একটি মামলা৷ এটা একটা আলোচিত মামলা৷ তাই অত্যন্ত গ্ররুত্ব দিয়ে আমরা এই মামলার তদন্ত করছি ৷ শুধু দেশে নয়, প্রয়োজনে বিদেশেও বিভিন্ন সংস্থার আমরা সহযোগিতা নিয়েছি ৷ প্রকৃত আসামিকে শনাক্ত করতে আমরা বিদেশে ডিএনএ টেস্টসহ নানা সহযোগিতা নিয়েছি৷ আমরা তদন্তে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনা করছি ৷’’
মামলার তদন্তে এত দীর্ঘ সময় লাগার কারণ জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘‘আমরা একটি জিনিস মাথায় রেখে তদন্ত করছি, যাতে একজন নিরপরাধ ব্যক্তিও ক্ষতিগ্রস্ত না হয়৷ আমরা যাতে প্রকৃত অপরাধীকে শনাক্ত করতে পারি, সেজন্যই আমাদের তদন্তে একটু দেরি হচ্ছে৷ কিন্তু আমরা আন্তরিক৷ তদন্ত কর্মকর্তা সুষ্ঠুভাবে তদন্ত করে যাচ্ছেন ৷’’
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের বলেন, ‘‘সাংবাদিক দম্পতি সাগর সারওয়ার ও মেহেরুন রুনি হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে দ্রুত তদন্ত প্রতিবেদন দিতে র্যাবকে নির্দেশনা দেয়া হবে৷ আমরাও চাই এ হত্যার রহস্য দ্রুত উন্মোচিত হোক ৷’’ সূত্র : ডয়চে ভেল
Discussion about this post