নারায়ণগঞ্জ শহরের বঙ্গবন্ধু সড়কের ফুটপাতের পাশাপাশি পুরো সড়কজুড়ে হকারদের নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ার ঘটনায় মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী ও সংসদ সদস্য শামীম ওসমান সমর্থকদের মধ্যে আলোচিত সংঘর্ষের ঘটনায় হওয়া মামলায় অভিযোগপত্র জমা দিয়েছে তদন্তকারী সংস্থা।
ঘটনার প্রায় পাঁচ বছরে এসে পুলিশ ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছে আদালতে।
অভিযোগ পত্রে ১২ জনের বিরুদ্ধে হুমকি, হত্যাচেষ্টা, জখম, নাশকতা, ভাঙচুরসহ অরাজকতার প্রমান পেয়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। তবে অস্ত্র আইনের ধারা থেকে আসামীদের বাদ দেয়া হয়েছে। যা নিয়ে শুরু হয়েছে তোলপাড়।
এমন ঘটনায় খোদ পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) এর একজন শীর্ষ কর্মকর্তা ক্ষোভ প্রকাশ করে ৮ মিনিট ৩৬ সেকেন্ডের মুঠোফোনের আলোচনায় বলেন, নারায়ণগঞ্জ পিবিআই এর পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম (পিপিএম) নরায়ণগঞ্জ জেলায় কাজ করছেন প্রায় সাত বছর যাবৎ । কি করছেন তিনি ? নারায়ণগঞ্জ জেলা (এসপি) পুলিশ সুপার হিসেবে পদায়িত হওয়ার জন্য তার খায়েস দীর্ঘদিনের। এসপি হারুন নারায়ণগঞ্জ থেকে বদলী হওয়ার পর এই মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম (পিপিএম) তিন মাসের জন্য চলতি দায়িত্ব পালন করে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পরেন। এরপর কোন অবস্থাতেই নারায়ণগঞ্জ ছেড়ে যাতে যেতে না হয় সেই লক্ষ্যে এই নারায়ণগঞ্জ জেলায় কাজ করে যাচ্ছেন । একটি বিশেষ রাজনৈতিক নেতার ও তার পাতি/ সিকি নেতার পক্ষে অন্ধের মতো কাজ করেন বলেও গুঞ্জন রয়েছে পিবিআই এর সকলের মাঝে । তাই এই চাঞ্চল্যকর মামলার আসামীদের বাড়তী সুবিধা দিয়ে আবার নারায়ণগঞ্জে পুলিশ সুপার হিসেবে নিয়োগ পেতে এমন কান্ড ঘটিয়েছেন।
এমন তথ্য প্রদানকারী পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) এই শীর্ষ কর্মকর্তা আরো বলেন, নামটা প্রকাশ কইরেন না। নাম প্রকাশ হলে ডিপার্টমেন্টে সমালোচনা হবে। তবে এই চার্জসীট দেয়ার আগে পরে কি কি ঘটেছে তার খোজ নেন। অনুসন্ধ্যান করেন বেড়িয়ে আসবে মনিরুল ইসলামের আরো চাঞ্চল্যকর তথ্য।
খোজ নিয়ে আরো জানা যায়, মামলার এজহার থেকে মাত্র দ্ইুজন আসামীর নাম এসেছে অভিযোগ পত্রে। মামলা থেকে অব্যহতি দেয়ার আবেদন জানানো হয়েছে অন্য ৭ জনকে। তবে নতুন করে আরও ১০ জনের নাম যুক্ত করা হয়েছে ওই তদন্ত প্রতিবেদনে। পিবিআই এর দেয়া তদন্ত প্রতিবেদনে মামলার অজ্ঞাত নামা আসামীদেরকে খোঁজ পাওয়া যায়নি বলেও উল্লেখ্য করা হয়।
সংঘর্ষের ঘটনায় যে দুটি মামলা হয়েছিল, তার একটিতে কাউকে শনাক্ত করতে না পেরে আগেই সদর মডেল থানা পুলিশ চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। অন্য মামলাটির তদন্তকারী সংস্থা পিবিআই দ্বায়িত্ব পাওয়ার পর তিন বছর তদন্ত করে নিশ্চুপ ভাবে আদালতে যে প্রতিবেদন দাখিল করেছে তা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে।
২০১৮ সালের ১৬ জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জ শহরের বঙ্গবন্ধু সড়কে ফুটপাতে হকার বসানোকে কেন্দ্র করে মেয়র আইভী ও সংসদ সদস্য শামীম ওসমানের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। দুই পক্ষের সংঘর্ষে আইভীসহ অর্ধশতাধিক মানুষ আহত হয়।
এ ঘটনায় জেলা প্রশাসন যে তদন্ত কমিটি করেছিল, সেটির প্রতিবেদন আর জমা দেয়াই হয়নি। অথচ সরকারের ঘোষণা ছিল, প্রতিবেদন দেখে ব্যবস্থা নেয়ার। তখন জেলা প্রশাসন তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল। দফায় দফায় সময় বাড়ানোর হয় প্রতিবেদন জমা দেয়ার। পরে এক সময় কমিটির কর্মকর্তারা বদলি হয়ে যান অন্য জেলায়।
ঘটনার পরদিন ১৭ জানুয়ারি মেয়র আইভীর ভাইসহ সহ ১৭ জনের নাম উল্লেখ করে থানায় অস্ত্র ছিনতাই ও হত্যা চেষ্টার লিখিত অভিযোগ দেন যুবলীগ নেতা নিয়াজুল ইসলাম। যার হাতে অস্ত্রসহ ছবি প্রকাশ হয় গণমাধ্যমে।
অন্যদিকে আইভীকে হত্যাচেষ্টার অভিযোগ এনে ২২ জানুয়ারি নিয়াজুলসহ ৯ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরও এক হাজার জনকে আসামি করে থানায় অভিযোগ দেন সিটি করপোরেশনের আইন কর্মকর্তা জিএম সাত্তার।
তবে পুলিশ অভিযোগ দুটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) হিসেবে রেকর্ড করে। ২২ মাস ১৮ দিন পর ২০১৯ সালের ৪ ডিসেম্বর উচ্চ আদালতের নির্দেশে সদর মডেল থানায় দেয়া অভিযোগটি মামলা হিসেবে রেকর্ড করা হয়।
আরও এক মাস পর পুলিশ সদর দফতরের নির্দেশে তদন্তে নামে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। তিন বছর তদন্ত শেষে সংস্থাটি তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছে আদালতে।
আদালত পুলিশের পরিদর্শক আসাদুজ্জামান জানান, গত বছরের ২৩ নভেম্বর আদালতে অভিযোগ জমা দেয় মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা। অভিযোগ পত্রে যাদের আসামী করা হয়েছে। তাদের মধ্যে নিয়াজুল ইসলাম ও শাহ নিজাম উচ্চ আদালত থেকে জামিনে আছেন। আগামী ২৯ জানুয়ারী মামলার পরবর্তী শুনানির দিন। ওই দিন অভিযোগ পত্র নিয়ে আদালত মামলার বাদীর কথা শুনবেন।
অভিযোগ পত্রে আসামী করা হয়েছে, অস্ত্র প্রদর্শনকারী নিয়াজুল ইসলাম খান, নারায়ণগঞ্জ মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক শাহ নিজাম, নারায়ণগঞ্জ হকার্স লীগের সভাপতি রহিম মুন্সি, হকার সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি আসাদুল ইসলাম, সাধারণ সম্পাদক মো. পলাশ মিয়া, হকার সায়মন, ইকবাল হোসেন, মাসুদ পাটোয়ারী শুক্কুর, মো. তোফাজ্জল, মহসীন বেপারী, সালাউদ্দিন গাজী, মো. সাদেকুল ইসলামকে।
অভিযোগ পত্রে বলা হয়েছে, এসব আসামীর বিরুদ্ধে হুমকি, হত্যাচেষ্টা, জখম, নাশকতা, ভাঙচুরসহ অরাজকতার অভিযোগ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রমানিত হয়েছে। ঘটনার সময় তারা সেখানে ছিলেন ও ঘটনার সাথে জড়িত।
তবে মেয়র আইভীকে হত্যার উদ্দ্যেশে আসামীরা গুলি ছুড়েছে তা এজহারে উল্লেখ্য করা হলেও এ সংক্রান্ত কোন আলামত ঘটনাস্খলে পাওয়া যায়নি। পরবর্তীতেও কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। ঘটনার সময় আসামী নিয়াজুল যে অস্ত্র প্রদর্শন করেছে সেটির লাইসেন্স আছে। শাহ নিজামের নামে একটি বন্দুকের লাইসেন্স রয়েছে। তবে ঘটনার সময় শাহ নিজাম কে বিনা লাইসেন্সের অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র (পিস্তল) বহন ও নিজ দখলে দেখা যায়। তিনি জামিনে থাকায় তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা সম্ভব হয়নি ও পিস্তল উদ্ধার করা যায়নি। এর কারণে অস্ত্র আইনের ধারায় তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমানিত হলো না।
মামলা থেকে অব্যহতির জন্য আবেদন করা হয়েছেন, নারায়ণগঞ্জ মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জাকিরুল আলম হেলাল, মহানগর যুবলীগের সভাপতি শাহাদাৎ হোসেন সাজনু, জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি জুয়েল হোসেন, স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা জানে আলম বিপ্লব, জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক (মৃত) মিজানুর রহমান সুজন, যুবলীগ কর্মী নাসির উদ্দিন ওরফে টুন্ডা নাসির ও যুবলীগ নেতা চঞ্চল মাহমুদকে।
মামলার তদন্তকারী পিবিআই এর পুলিশ পরির্দশক আতাউর রহমান জানান, ঘটনার যতটুকুর তদন্তে পেয়েছি ততটুকুই দিয়েছি। এর বাইরে যদি আরও কোন তথ্য পাওয়া যায় তাহলে পরবর্তীতে আমরা সেটি সম্পৃক্ত করবো তা প্রতিবেদনে জানিয়েছি।
তিনি আরও জানান, মামলার অজ্ঞাতনামা আসামীদের পাওয়া যায়নি। পরে পাওয়া গেলে সেগুলোও সংযুক্ত করা হবে।
অস্ত্রধারীদের অস্ত্রসহ দেখা গেলেও কেন অস্ত্র আইনের ধারা থেকে বাদ দেয়া হলো এমন প্রশ্নের জবাবে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা আতাউর রহমান বলেন, নিয়াজুলের কাছে যে অস্ত্র ছিলো সেটি বৈধ। ঘটনার সময় সেটি দিয়ে কাউকে আহত বা নিহত করা হয়নি। তিনি গুলিও করেনি। তবে শাহ নিজামের কাছে অস্ত্র দেখা গেলেও সেটি উদ্ধার করা যায়নি। এ কারণে অস্ত্র আইনের ধারা প্রমানিত হয়নি।
তবে আসামিদের বিরুদ্ধে হুমকি, হত্যাচেষ্টা, জখম, নাশকতা, ভাঙচুরসহ অরাজকতার অভিযোগ প্রমানিত হয়েছে।
পিবিআই এর নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার মনিরুল ইসলাম জানান, অস্ত্র মামলার ধারায় বলা আছে, অস্ত্র উদ্ধার মানে প্রদর্শনীয় থাকতে হবে। আমরা মামলার দ্বায়িত্ব অনেক পরে পেয়েছি। ততক্ষনে আসামীরা জামিনে। এখন কোন আসামী জামিনে থাকলে তাকে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা তারপর অস্ত্র উদ্ধার করা সম্ভব নয়। মামলার আরেক আসামী নিয়াজুল ইসলামের বৈধ অস্ত্র। তার বৈধ অস্ত্র যদি অবৈধ ভাবে ব্যবহার হয় তাহলে কর্তৃপক্ষ যথাযথ ব্যবস্থা নিবে। ইতিমধ্যে ব্যবস্থাও নেয়া হয়েছে মানে তার অস্ত্রের লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে।
অভিযোগ পত্র মানেনি আইভী :
পিবিআই এর দেয়া ওই প্রতিবেদন মানেনি নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী। তিনি আদালতে অভিযোগ পত্রের বিরুদ্ধে নারাজী দেবেন। পুলিশ যে প্রতিবেদন দাখিল করেছেন তার বিরোধীতা করে মেয়র আইভী পুলিমের এমন কান্ডে সমারোচনা করেন।
আইভী বলেন, পিবিআই ভুল তথ্যের ভিত্তিকে সম্পূর্ন মিথ্যা রিপোর্ট দিয়েছে। আমরা এই প্রতিবেদন মানি না। আমরা এর বিরুদ্ধে আদালতে নারাজী দিব।
মামলার বাদী নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের আইন কর্মকর্তা জিএম সাত্তার জানান, তদন্তকারী সংস্থা একটি মনগড়া প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। সারা দেশের মানুষ দেখেছে সে ঘটনা। কিভাবে অস্ত্র নিয়ে হামলা করা হলো, গুলি করা হলো তাহলে অস্ত্র ধারা বাদ হয় কিভাবে। আমরা এই মনগড়া অভিযোগ পত্রের বিরুদ্ধে আদালতে নারাজী দিবো। আমরা সুষ্টু তদন্ত চাই। ন্যায় বিচার চাই।
পুলিশের মামলায় কেউ শনাক্ত হয়নি
মেয়র আইভী ও সাংসদ শামীম ওসমান সমর্থকদের সংঘর্ষের ঘটনার আট দিন পর ২৪ জানুয়ারি রাতে আরেকটি মামলা করেছিলেন নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানার পরিদর্শক (অপারেশন) জয়নাল আবেদীন। ওই মামলায় পুলিশের কাজে বাধা ও হামলার অভিযোগ এনে অজ্ঞাত ৪০০ থেকে ৫০০ জনকে আসামি করা হয়।
মামলার তদন্ত করেন পুলিশ পরিদর্শক মিজানুর রহমান। সদর থানার রেজিস্ট্রারে দেখা যায়, ২০১৯ সালের ২৯ আগস্ট তিনি আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন (এফআরটি) দাখিল করেছেন। প্রতিবেদনে বলা হয়, ঘটনা সত্য। তবে ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি।
২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর মামলাটি নিষ্পত্তি করা হয়েছে বলে উল্লেখ রয়েছে রেজিস্ট্রারে।
“নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশের থাকাবস্থায় একাধিক পদোন্নতির পর এই জেলাতেই এসপি হারুন নারায়ণগঞ্জ থেকে ২০১৯ সালের ৩ নভেম্বর বদলীর পর চলতি দায়িত্ব পালন করেন তিন মাস এসপি মনিরুল ইসলাম । এর মধ্যে এসপি জাহেদুল আলম ফুয়াদ নারায়ণগঞ্জের এসপি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের আগে জোড়ালোভাবে এই মনিরুল ইসলাম নারায়ণগঞ্জে এসপি হিসেবে পদায়িত হতে বহু চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হন। এরপর পিবিআই নারায়ণগঞ্জের দায়িত্ব গ্রহণের পর জাহেদুল আলম ফুয়াদ পদোন্নতি পেলে এসপি হিসেবে গোলাম মোস্তফা রাসেল, পিপিএম (বার) নারায়ণগঞ্জে যোগদানের পূর্বে বারংবার নারায়ণগঞ্জে পদায়িত হতে চেষ্টা অব্যাহত রাখেন । এরই ধারাবাহিকতায় নারায়ণগঞ্জের কয়েকজন প্রভাবশালী নেতা / আধা নেতা / পাতি নেতাদের সাথে বৈঠক করেছেন নারায়ণগঞ্জে এসপি হিসেবে কাজ করার খায়েস থেকে এসপি মনিরুল ইসলামের কারিশমায় রক্ষা পেয়েছে অস্ত্রধারীরা । আর আসামী হয়েছে হকাররা । এরই ফলশ্রুতিতে এমন চার্জসীট প্রদান করা হতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন পিবিআই এর এই কর্তা।“
যার ৮ মিনিট ৩৬ সেকেন্ডের বক্তব্য উঠে এসেছে আরো অনেকে তথ্য।
Discussion about this post