সিদ্ধিরগঞ্জ প্রতিনিধি:
সিদ্ধিরগঞ্জে একের পর এক ঘটনায় বছর জুড়েই আলোচনায় সমালোচনায় ছিলেন নাসিক ৬ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর মতিউর রহমান মতি ও তার একান্ত সহযোগী আক্তার ওরফে পানি আক্তার। তারা এলাকায় গুরু শিষ্য হিসেবেই বেশ পরিচিত। তাদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ নাসিক ৬ নং ওয়ার্ডের ব্যবসায়ী ও বাসিন্দারা।
কাউন্সিলর মতিউর রহমান মতি সিদ্ধিরগঞ্জের নাসিক ৬ নং ওয়ার্ডের সুমিলপাড়া এলাকার মৃত বাদশা মিয়ার ছেলে ও তার সহযোগী আক্তার ওরফে পানি আক্তার মৃত করিম কসাইয়ের ছেলে। তবে এলাকাবাসী বলছেন কাউন্সিলর মতিউর রহমান মতির বাবা বাদশা মিয়া ছিলেন একজন রাজাকার। কাউন্সিলর মতিকে রাজাকারের ছেলে হিসেবেই সকলে চিনেন।
এদিকে গত ২২ ডিসেম্বর প্রায় সাড়ে ১৯ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ ও সম্পদের তথ্য গোপনের অভিযোগে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের (নাসিক) কাউন্সিলর মতিউর রহমান মতি ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে পৃথক দু’টি চার্জশিট দাখিল করেন দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
অপরদিকে মতির ঘনিষ্ঠ সহযোগী আক্তার ওরফে পানি আক্তারের বিরুদ্ধে হামলা, মারামারি, চুরি, ডাকাতি ও হত্যা মামলাসহ একাধিক মামলা রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
সর্বশেষ আদমজী ইপিজেড এর নির্মাণাধীন ফ্যাক্টরির ২৫ লাখ টাকার নির্মাণ সামগ্রী চুরির দায়ে আক্তার ও তার সহযোগীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। গত বছরের ১৩ ডিসেম্বর আক্তারের বাড়ির পাশ থেকে চুরি হওয়া আদমজী ইপিজেড এর নির্মাণাধীন ফ্যাক্টরির নির্মাণ সামগ্রীর ২৫ লাখ টাকার লুন্ঠিত মালামাল উদ্ধার করেন ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশ-৪। তবে আসামিদের গ্রেফতার করতে সক্ষম হননি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
এদিকে এলাকাবাসী বলছেন, কাউন্সিলর মতির বিরুদ্ধে দুদক চার্জশিট দিলেও এখনও তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। উল্টো এখনও পূর্বের মতই এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করছেন। অন্যদিকে মতির শিষ্য আক্তার ওরফে পানি আক্তার চুরির মামলায় বেশ কিছুদিন পলাতক থেকে বর্তমানে এলাকায় এসে আবারও বেপরোয়া দিন যাপন করছেন। তাদের ভয়ে আতংকে রয়েছেন এলাকাবাসী।
তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় এক আওয়ামী লীগ নেতা জানান, কাউন্সিলর মতি বর্তমানে এক আতঙ্কের নাম। তার বিপুল পরিমাণ অর্থের কাছে সকলেই বিক্রি হয়ে গেছেন। কেউ তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে সাহস পায় না। অবৈধ সম্পদ অর্জনের দায়ে দুদক মতি ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে দূর্নীতির মামলা দিয়েছেন। দুদকের মামলার পর বেশ কিছুদিন গা ডাকা দিয়েছেন। সাধারণ মানুষের টাকা লুটপাট করে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়ে বর্তমানে রাতের আধারে গরীব মানুষকে কম্বল বিতরণ করছেন। এসব কম্বল বিতরণ করে বর্তমানে সে হাসির পাত্র হয়েছেন মানুষের কাছে। একজন দূনীতিবাজ রাজাকারের সন্তান হয়ে কিভাবে এলাকায় ত্রাসের সৃষ্টি করে এবং কিশোর গ্যাং বাহিনী তৈরি করে বীরদর্পে চলাফেরা করে। তাই প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তিনি।
সূত্রে জানা যায়, নাসিক ৬ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর মতিউর রহমানের (মতি) বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধান করার পর সম্পদ বিবরণীর নোটিশ জারি করলে ২০২১ সালের ৭ সেপ্টেম্বর সম্পদ বিবরণী দাখিল করেন। তার দাখিল করা সম্পদ বিবরণী অনুযায়ী, স্থাবর সম্পদের মূল্য ৫ কোটি ৬৫ লাখ ১ হাজার ২২৪ টাকা ও অস্থাবর সম্পদ ৩ কোটি ৯৭ লাখ ৪০ হাজার ৮০৩ টাকাসহ মোট ৯ কোটি ৬২ লাখ ৪২ হাজার ২৭ টাকার স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ এর ঘোষণা দেন। কিন্তু তদন্তকালে স্থাবর-অস্থাবর মিলিয়ে ১৫ কোটি ৩৩ লাখ ৮ হাজার ৮৬ টাকার সম্পদ অর্জনের তথ্য পাওয়া যায়। যার মধ্যে গোপন করা সম্পদের পরিমাণ ৬ কোটি ৬২ লাখ ৮২ হাজার ৭৫৩ টাকা। এছাড়া মতিউর রহমানের বিভিন্ন ব্যাংকে ৭৪ কোটি ৯৬ লাখ ৪০ হাজার ১১৪ টাকা জমা ও উত্তোলন করার তথ্য পাওয়া গেছে তদন্তে।
অন্যদিকে, কাউন্সিলর মতিউর রহমানের (মতি) স্ত্রী রোকেয়া রহমানের বিরুদ্ধে ৮ কোটি ১৪ লাখ ৮৫ হাজার ৯১৯ টাকার অভিযোগ আনা হয়েছে দাখিল করা চার্জশিটে। এর মধ্যে গোপন করা সম্পদের পরিমাণ ২ কোটি ৪২ লাখ ৫৯ হাজার ৩৩২ টাকা। এছাড়া তদন্তকালে বিভিন্ন ব্যাংকে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় ১ কোটি ৭৬ লাখ ১৬ হাজার ৯৪ টাকা জমা ও উত্তোলনের তথ্য পাওয়া গেছে।
এদিকে দীর্ঘদিন যাবত নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় ভাবে ভুমিকা পালান করছেন আলোচিত-সমালোচিত মতিউর রহমান মতি। বাংলাদেশের বহুল আলোচিত সাত খুনের ঘটনা পর থেকেই হঠাৎ মতির ভাগ্য পরিবর্তনের চাবিকাঠি ঘুরে যান। তখন থেকে গতি বাড়ে তার টাকা উপার্জনের চাকার। নিজের জনবলকে খাঁটিয়ো তখন থেকেই হয়ে উঠেন অঢেল সম্পাদকের মালিক।
নারায়ণগঞ্জ জেলার সিদ্ধিরগঞ্জ থানার নাসিক ৬ নং ওয়ার্ড এলাকার বাসিন্দা মতিউর রহমান মতির বিরুদ্ধে রয়েছে একাধিক অভিযোগ। নানান বিতর্কিত কর্মকান্ডর কারণে বিভিন্ন সময় পত্রিকার শিরোনামে দেখা মিলে তাকে। কখনো তিনি আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মারধর আবার কখনো অকথ্য ভাষায় গালমন্দ করে শিরোনাম বনে যান।
সর্বশেষ দীর্ঘ ১৯ বছর আগে সিদ্ধিরগঞ্জ থানা যুবলীগের আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা হয়। তবে তার পর থেকে আর কোনো কমিটি না হওয়ায় যুবলীগের সভাপতি বনে যান মতি। নিজেকে আহ্বায়ক নন সভাপতিতে প্রতিষ্ঠিত করেন তিনি। রাজনীতিতে অনেকটা সক্রিয় হওয়া তার আধিপত্য বিস্তারের শিকার হয়েছে নানান ব্যবসায়ীসহ জনসাধারণ।
সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকাটি শিল্প এরিয়া হিসেবে দেশব্যাপী পরিচিত। এখানে অবস্থিত আদমজী ইপিজেডটিতে প্রায় ৫৬টি ফ্যাক্টরি রয়েছে জানান ব্যসসায়ীরা। এই ইপিজেডের অভ্যন্তরে মতি ও তার সহযোগীদের আধিপত্য নিয়ে প্রায়সময়ই সংবাদ হয়েছে বিভিন্ন পত্র পত্রিকায়।
নাম না প্রকাশ না করার অনুরোধে একাধিক ব্যবসায়ী জানান, ইপিজেডের ফ্যাক্টরিগুলোর মধ্যে প্রায় ১৯ টিতেই মতির একক ব্যবসা রয়েছে। শুধু মতিই নন তার ভাই-ভাতিজাগণের রয়েছে বিশাল সিন্ডিকেট। তাদের যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে সংরক্ষিত ইপিজেড এর লাইসেন্সবাহী ব্যবসায়ীরা।
এদিকে টানা দ্বিতীয় বারের মতো কাউন্সিলর হওয়ায় তার রাজত্ব যেনো আরও বড় আকারে পরিনত হয়ে পড়েন। তার বিশাল বাহিনীর অত্যাচারে অন্যান্য মানুষজন ঢুকতেও সাহস পান না ইপিজেডে।
অন্য দিকে তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী কিশোর গ্যাং লিডার পানি আক্তারের হামলা, ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের মতো ঘটনা থেকে রক্ষা পাননি ব্যবসাীরা। স্থানীয় পত্রিকাগুলোতে প্রায় সময়ই শিরোনামে দেখা মিলে তাকে। তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষন করেন এলাকাবাসী।
Discussion about this post