জমি অধিগ্রহণ নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হওয়ায় ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ ডাবল রেললাইন প্রকল্প বাস্তবায়ন নিয়ে বিপাকে পড়েছে রেলপথ মন্ত্রণালয়। প্রাথমিক পরিকল্পনায় জমি অধিগ্রহণের বিষয় ছিল না। এখন নতুন করে বিষয়টি সামনে আসায় প্রকল্প ব্যয় শতভাগেরও বেশি বেড়ে গেছে। এই পরিস্থিতিতে প্রকল্পের দুই কিলোমিটার রেলপথ বাদ দিয়েই ডাবল লাইনে উন্নীত করার কথা জানিয়েছে রেলপথ মন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন।
রেলপথ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১৫ সালের ২০ জানুয়ারি ঢাকা- নারায়ণগঞ্জ সেকশনে সমান্তরাল একটি ডুয়েলগেজ রেললাইন নির্মাণ প্রকল্প অনুমোদন করে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)। ওই সময়ে প্রকল্প ব্যয় ধরা হয় ৩৭৮ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারের তহবিল ( জিওবি) থেকে ১২৯ কোটি ১১ লাখ টাকা ও জাপানের অনুদান ২৪৯ কোটি ৫৪ লাখ টাকা সরবরাহ করার কথা। আর প্রকল্প বাস্তবায়নের মেয়াদ ধরা হয় ২০১৪ সালের ১ জুলাই থেকে জুন ২০১৭ সাল পর্যন্ত। ব্যয় বৃদ্ধির কারণে প্রকল্পের মেয়াদ চলতি বছরের অর্থাৎ ২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বর নির্ধারণ করা হয়।
জানা যায়, প্রকল্প গ্রহণের চার বছরের মাথায় গিয়ে পরিকল্পনায় ত্রুটি সামনে আসে। ফলে প্রকল্পটি সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। আর সেই সংশোধনী ব্যয় ৩৭৮ কোটি ৬৫ লাখ থেকে বেড়ে ৭৭৮ কোটি ১৩ লাখ টাকায় গিয়ে ঠেকে। অর্থাৎ সংশোধনীতে নির্ধারিত ব্যয়ের চেয়ে ৩৯৯ কোটি ৪৮ লাখ টাকা বেশি প্রস্তাব করা হয়। এই ১০৭ ভাগ বেশি প্রকল্পের ব্যয়ের বোঝা বহন করতে চায় না দাতা সংস্থা। জাপান সরকারের পক্ষ থেকে সাফ জানিয়ে দিয়েছে নির্ধারিত অর্থের বেশি এক পয়সাও ব্যয় করবে না তারা। ফলে এই বাড়তি ব্যয় পুরোটাই সরকারি তহবিল থেকে সরবরাহ করতে হবে। এদিকে প্রকল্প মেয়াদ তিন দফা বৃদ্ধির পর আরেক দফা মেয়াদ বাড়তে পারে এমন আভাস দিয়েছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
জানা গেছে, বর্তমানে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ যে রেলপথ রয়েছে, সেটি মিটারগেজ । জুরাইন রেল গেট থেকে নারায়ণগঞ্জ রেলওয়ে স্টেশন পর্যন্ত বিদ্যমান সিঙ্গেল লাইনের সমান্তরাল ১২ দশমিক ০১ কিলোমিটার ডুয়েলগেজ ডাবল লাইন নির্মাণ ও আনুষাঙ্গিক কাজ করা হবে। জুরাইন রেলগেট হতে ঢাকার কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন পর্যন্ত অবশিষ্ট ৪ কিলোমিটার নির্মাণকাজ পদ্মাসেতু রেল লিংক প্রকল্পের আওতায় করার কথা। পুরো রেলপথটি ডাবল লাইনে উন্নীতের কাজ করছে রেলপথ মন্ত্রণালয়। কিন্তু পুরো রেলপথটি ডাবল লাইনে রূপান্তর কাজে বিপত্তি বেধেছে চাষাঢ়া রেলওয়ে স্টেশন এলাকায়। নারায়ণগঞ্জ থেকে চাষাড়া পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণে ১৮৮২ সালে রেলগেট টি-১ থেকে টি-২ পর্যন্ত ৬২ ফুট প্রস্থ জমি অধিগ্রহণ করেছিল তৎকালীন ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে। প্রকল্পের কর্মকর্তারা জানান, প্রকল্পটি গ্রহণ করার সময় ধারণা করা হয়েছিল ওই জমি রেলওয়ের আওতায়। সেই চিন্তা থেকেই ডাবল লাইন নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রকল্প সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, তারা জানতেন না ওই জমি বেহাত হয়ে ব্যক্তি মালিকানায় চলে গেছে। যা এখন আর রেলওয়ের আওতায় নেই। প্রকল্প হাতে নেওয়ার সময় ওই জমি রেলওয়ের ধরে নিয়েই উদ্যোগ নেওয়া হয়। এজন্য প্রকল্পের ডিপিপিতে জমি অধিগ্রহণের কোনো অর্থের সংস্থান রাখা হয়নি।
পরে প্রকল্প পরামর্শক প্রতিষ্ঠান পরীক্ষা নিরিক্ষা করে জানিয়েছে, ঢাকা- নারায়নগঞ্জ পর্যন্ত ডুয়েলগেজ রেললাইন নির্মাণ করতে হলে আরও ০ দশমিক ৫১ একর জমির প্রয়োজন। সরকারের বর্তমান আইন অনুযায়ী, এই পরিমান জমি ও জমির ওপরে থাকা স্থাপনা সরাতে ক্ষতিপূরন বাবদ ১৩৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা বাড়তি প্রয়োজন।
রেলপথ মন্ত্রণালয় মনে করছে, রেলওয়ের অনুকূলে ১৮৮২ সালে অধিগ্রহণ করা ভূমি সিএস ও আরএস জরিপে অন্যের নামে রেকর্ডভূক্ত হওয়ায় তা নিরসনে বড় ধরনের বিপত্তি দেখা দেবে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, একবার অধিগ্রহণ করা জমি আবার অধিগ্রহন করা এবং এর সঙ্গে আর্থিক বিষয় সংশ্লিষ্ট সেজন্য অডিট আপত্তি ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে। এসব চিন্তা করে ভূমি অধিগ্রহণের বিষয়টি বাদ দিয়ে চাষাড়া স্টেশন থেকে নারায়নগঞ্জ স্টেশন পর্যন্ত দুই কিলোমিটার রেলপথ বাদ দিয়ে বাকি পথটুকু ডুয়েলগেজে রূপান্তর করা হবে।
এ প্রসঙ্গে রেলপথ মন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন গণমাধ্যমকে জানান, একদিকে আটটি সাততলা ভবন। এমনভাবে বাড়িগুলো নির্মাণ করা হয়েছে যে, রেললাইন নির্মাণ করা হলে মানুষদের ঘর থেকে বের হওয়াই দায় হয়ে যাবে।
তিনি জানান, রেলের স্থানে এসব ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। এই অসুবিধার জন্য প্রকল্প চাষাঢ়া পর্যন্ত গিয়ে শেষ করতে হবে।
এমন ঘটনায় দীর্ঘদিন যাবৎ নারায়ণগঞ্জে চাউর রয়েছে, “রাজনৈতিক বিরোধীতার কারণে নারায়ণগঞ্জ শহরের অনেক উন্নয়ন বাধাগ্রস্থ হচ্ছে । একটি চক্রে রেলের জমি লুটপাটের মহোৎসবে নেমেছে । এরই মধ্যে মার্কেট নির্মান করতে নারায়ণগঞ্জ রেল স্টেশন এলাকায় উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয়েছে। শত বছরের ঐতিহ্যবাহী এই রেল ষ্টেশনের বিশাল সম্পত্তির প্রতি একটি ব্যবসায়ী চক্র কুদৃষ্টি রয়েছে বলেও নগরবাসীর মুখে উচ্চারিত হচ্ছে । আর ঐ ব্যবসায়ী ও লুটপাটকারী অপরাধী চক্রের পক্ষে মোটা অংকের টাকার রেল মন্ত্রণালয়ের অনেক অসাধু কর্মকর্তারা জড়িত রয়েছে বলেও জোড়ালো অভিযোগ তুলেছে নারায়ণগঞ্জবাসী ।
উল্লেখ্য, ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ সেকশনে বর্তমান মিটারগেজ রেললাইনের সমান্তরালে একটি ডুয়েল গেজ রেললাইন নির্মাণ প্রকল্পটি সরকার ও দাতা সংস্থার তহবিলে নির্মাণ করা হচ্ছে। এরই মধ্যে প্রকল্পের সিংহ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে বলে জানা গেছে। চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে লাইনটি রেল চলাচলের জন্য খুলে দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।
Discussion about this post