বিলাসবহুল ফ্ল্যাট ভাড়া করে ‘রংমহল’ বানিয়েছিলেন আন্ডারওয়ার্ল্ডে ‘থাই ডন’ হিসেবে পরিচিত সেলিম প্রধান। সেই রংমহলে যাতায়াত করতেন প্রভাবশালী রাজনীতিক, মন্ত্রী, শিল্পপতি, ব্যবসায়ী ও উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তাগণ। চলতো অনৈতিক কাজ, যার ভিডিও গোপন ক্যামেরায় ধারণ করতেন সেলিম।
গুলশান ২-এর ৯৯ নম্বর সড়কের ১১/১ নম্বর বাসায় ওই রংমহল বানান তিনি। সেখানে প্রতি শনিবার বিকেল সাড়ে ৩টা থেকে সারারাত ‘জলসা’ হতো। র্যাবের হাতে গ্রেপ্তারের পর সেলিম প্রধানের অপরাধ জগতের অনেক চমকপ্রদ তথ্য বেরিয়ে আসছে। সেলিমের ঘনিষ্ঠজন ছাড়াও একাধিক দায়িত্বশীল গোয়েন্দা সূত্র থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। সমকাল’র এক বিশেষ প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে আসে।
সেই জলসায় নিয়মিত যেতেন সাবেক দুই প্রতিমন্ত্রীও। সেখানে অংশগ্রহণকারীদের অনৈতিক ও অসংযত জীবনাচরণের ছবি ধারণ করতে বসানো ছিল গোপন ক্যামেরা। সেই ক্যামেরায় ধারণ করা ভিডিও মেমোরি কার্ডে নিয়ে রাখতেন সেলিম। পরে ওই ছবি দেখিয়ে ভিআইপিদের ফাঁসানোর ফাঁদ পাতেন তিনি।
গোয়েন্দা সূত্র মতে, আন্ডারওয়ার্ল্ডের ডন সেলিম প্রধান গত ৩০ সেপ্টেম্বর থাই এয়ারওয়েজের একটি ফ্লাইটে বিদেশ যাওয়ার সময় তার লাগেজের সঙ্গে অনেক মালপত্র নিয়ে যাচ্ছিলেন। লাগেজ তল্লাশি করে পাওয়া যায় তিনটি মেমোরি কার্ড। পরে ওই কার্ড পরীক্ষা করে দেখা যায়, সেখানে রয়েছে দেশি-বিদেশি তরুণীদের সঙ্গে অনেক ভিআইপির অন্তরঙ্গ ছবি। জিজ্ঞাসাবাদে জানতে চাওয়া হয়, কেন ওই মেমোরি কার্ড থাইল্যান্ডে নিয়ে যাচ্ছিলেন- এ প্রশ্নের কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি সেলিম।
তবে এ বিষয়ে গোয়েন্দারা বলছেন, এসব ভিডিও দেখিয়ে ফাঁসানোর ভয় দেখিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা ছিল সেলিম প্রধানের। বিদেশে বসে ভিআইপিদের গোপন ভিডিও প্রচার ও প্রকাশের কথা বলে টাকা হাতিয়ে নেয়াই ছিল তার মূল উদ্দেশ্য।
এরই মধ্যে অনলাইন ক্যাসিনোর মূল হোতা সেলিম প্রধানসহ তিনজনকে মাদক মামলায় চার দিনের রিমান্ডে পাঠিয়েছেন আদালত। ঢাকা মহানগর আদালতের হাকিম মইনুল ইসলাম বৃহস্পতিবার দুপুরে এ আদেশ দেন। অন্য দুই আসামি হলেন- আখতারুজ্জামান ও রোমান। সেলিমের আরো কয়েকজন ঘনিষ্ঠ সহযোগীকে খোঁজা হচ্ছে। তাদের মধ্যে একাধিক দেশি-বিদেশি নারীও আছেন।
দীর্ঘদিন ধরে সেলিমের কর্মকাণ্ডের তথ্য রাখেন এমন একাধিক ব্যবসায়ী ও গোয়েন্দা সূত্র জানায়, গুলশান-২ নম্বর সেকশনের একটি বাড়ির দুটি ফ্লোর ভাড়া নিয়েছিলেন সেলিম প্রধান। ওই বাড়ির তৃতীয় তলায় এক বাঙালি স্ত্রীকে নিয়ে বসবাস করতেন তিনি। চতুর্থ তলায় ছিল তার রংমহল। সেখানে পাঁচটি বড় বড় কক্ষ রয়েছে। এর মধ্যে দুটি কক্ষে তার অফিস সহকারীরা বসতেন। বাকি তিনটি রুম নাচ-গান ও ভিআইপিদের মনোরঞ্জনের জন্য ব্যবহার হতো। একটি বিশেষ কক্ষে ভেন্টিলেটরের ওপর ছোট্ট গোপন ক্যামেরা বসানো থাকত। দেশি-বিদেশি সুন্দরী তরুণীদের সঙ্গে একান্তে সময় কাটানোর মুহূর্তগুলো ওই ক্যামেরায় ধারণ করা হতো। সেলিম প্রধানের নির্দেশে মাসুম নামে এক যুবক ওই কক্ষে এই গোপন ক্যামেরা বসায়।
জানা যায়, সেলিম প্রধানের কাছে বাড়িওয়ালা ভাড়া বাবদ পাবেন ২৬ লাখ টাকা। প্রভাব-প্রতিপত্তি খাটিয়ে সেলিম সেই ভাড়া দিচ্ছেন না। এ বাড়িতে প্রভাবশালীদের আনাগোনা থাকার বিষয়টি জানতেন বাড়িওয়ালা। সেলিম প্রধানকে অনেক ‘ক্ষমতাধর’ মনে করে সাহস করে কিছু বলতেন না বাড়িওয়ালা।
আরো জানা গেছে, এরই মধ্যে সেলিম প্রধান তার গোপন ক্যামেরায় যাদের ছবি ধারণ করে রেখেছিলেন তাদের মধ্যে একাধিক প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা রয়েছেন। যাদের কেউ কেউ সাবেক প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন। এ ছাড়া আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তা ও শিল্পপতিদের ফাঁসানোর সব আয়োজন ছিল তার।
গোয়েন্দারা জানান, সেলিম প্রধান একজন বহুরূপী প্রতারক। সমাজের উচ্চবিত্ত শ্রেণির সঙ্গে তার গভীর সখ্য ছিল। অনেক সময় বড় বড় প্রতিষ্ঠান কোনো আইনি ঝামেলায় পড়লে প্রভাবশালীদের ব্যবহার করে তা মিটমাট করে দেয়ার বিনিময়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়েছেন তিনি। তবে যারা তার রংমহলে নিয়মিত যেতেন তারা কোনোভাবে টের পাননি গোপনে তার ছবি ধারণ করে রাখা হচ্ছে।
এরই মধ্যে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি সংস্থা সেলিমের সহকারী মাসুমকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। তিনি সেলিমের রংমহলের অনেক তথ্য দিয়েছেন। গুলশানে সেলিমের বাসা থেকে অসামাজিক কাজে ব্যবহার হতো, এরকম অনেক আলামত পাওয়া গেছে।
মাসুম জানান, সেলিমের নির্দেশে বায়তুল মোকাররম মার্কেট থেকে গোপন ক্যামেরা কিনে গুলশানের বাসায় লাগানো হয়। গোপনে ভিআইপিদের ছবি ধারণ করার দায় সেলিম প্রধানের। গুলশানে তার রংমহলে যারা নিয়মিত যেতেন তাদের ‘প্রধান ক্লাবের’ সদস্য করে নিতেন সেলিম। ‘প্রধান ক্লাবে’ একবার কেউ নাম লেখালে সেখান থেকে বের হওয়া কঠিন ছিল। মূলত এই রংমহলের আনঅফিসিয়াল নাম ছিল প্রধান ক্লাব।
গণমাধ্যমটির হাতে আসা একটি ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, কীভাবে ওই রংমহলে গোপন ক্যামেরা বসানো হয়েছিল তার ব্যাখ্যা দিচ্ছিলেন সেলিম প্রধানের দীর্ঘদিনের বিশ্বস্ত সহযোগী মাসুম।
Discussion about this post