ছয় তলা ভবনের চার তলার ফ্ল্যাটের ভাড়াটিয়া শফিকুল ইসলাম মঞ্জু। স্ত্রী মীম আর দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে তার সংসার। এক শুক্রবার দুপুরে ওই ফ্ল্যাটে পোড়া গন্ধ। ধোঁয়া বেরোতে থাকে জানালা দিয়ে।
বাইরে থেকে লোকজন ওই ফ্ল্যাটে এসে জানতে চায় কিছু পুড়ছে কিনা। মঞ্জু বলেন, চুলায় মাংস। খেয়াল ছিল না তাই পুড়ে গেছে। মাংস পোড়া গন্ধ বেরোচ্ছে। লোকজন চলে যায়। এর কিছু সময় পরই ফ্ল্যাটে বাঁচাও বাঁচাও চিৎকার। মঞ্জু চিৎকার করছেন।
প্রচুর ধোঁয়া বেরোচ্ছে এবার। ভবনে তখন আগুন আতঙ্ক। অন্যান্য ফ্ল্যাট থেকে লোকজন হুড়মুড় করে নামতে থাকে। তবে বাঁচাও বাঁচাও চিৎকার শুনে কয়েকজন ওই ফ্ল্যাটে গিয়ে দরজা ভেঙে ভিতরে ঢোকে। বীভৎস দৃশ্য। মঞ্জু চিৎকার করছেন। বলছেন মীম পুড়ে গেছে। মীম তার স্ত্রী। রান্নাঘরে দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। ধোঁয়ায় একাকার।
লোকজন ধোঁয়ার ভিতর তার স্ত্রীর পুড়ে যাওয়া মৃতদেহ দেখতে পায়। গন্ধে লোকজন থাকতে পারছে না। ওই ভবনের নিচে তখন হাজারো মানুষ। মঞ্জু চিৎকার করতে করতে নিচে নেমে যান। রিকশায় ওঠার চেষ্টা করেন। লোকজন তাকে আটকায়। ঘটনা শুনে পুলিশ আসে। ফ্ল্যাটে যায়। ফ্ল্যাটটি তখন যেন ধ্বংসস্তূপ। আগেই গ্যাসের লাইন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আগুন নিভে গেছে। পুলিশ মঞ্জুকে থানায় নিয়ে যায়। স্ত্রীকে হারানোর বেদনায় কাঁদছিলেন। পুলিশ তাকে সান্তনা দেয়। ঘটনার সময় তাদের সন্তানরা বাসায় ছিল না। তদন্তে পুলিশ জানতে পারে পুরো ঘটনা। এটি দুর্ঘটনা বা আত্মহত্যা নয়। যা ঘটেছে শুনে আঁতকে ওঠেন তারা। মানুষের পক্ষে এমন পৈশাচিক হওয়া কি সম্ভব ? ভাবে পুলিশ ।
নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের দক্ষিণ সানারপাড়ের ঘটনা এটি। ২০১৭ সালের মার্চে রোমহর্ষক ও চাঞ্চল্যকর মীম খুনের ঘটনার পর যে আতঙ্ক তৈরি হয়েছিল তা এখনো রয়ে গেছে মানুষের মনে। পুলিশ তদন্ত শুরু করে।
মঞ্জুর হাতে ছিল কামড়ের দাগ। তাতে পুলিশের সন্দেহ হয়। থানায় নিয়ে মঞ্জুকে পুলিশ জেরা করে। বল, তোর স্ত্রীকে কেন খুন করেছিস। জবাবে মঞ্জু অস্বীকার করেন। বলেন, আমরা প্রেম করে বিয়ে করেছি। কেন খুন করব স্ত্রীকে। পুলিশ জানতে চায় হাতে কীসের দাগ। থতমত খান মঞ্জু। কোনো কিছু এড়াতে পারেন না। স্বীকার করেন সব। বলেন, তার স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়া হয়। সবাই যখন ঘুমিয়ে তখন মীম শরীরে আগুন ধরিয়ে আত্মহত্যা করেন। পুলিশ তাকে নানাভাবে জেরা করতে থাকে। কিন্তু কিছুতেই মুখ খোলেন না। পুলিশ তার থেকে কোনো তথ্য পাচ্ছিল না। পুলিশ এ সময় মঞ্জুর দুই সন্তানের খোঁজ করে। তারা কোথায় ? এ প্রশ্নে তিনি নানা কথা বলতে থাকেন। পুলিশের সন্দেহ জাগে। পুলিশ মঞ্জুর পরিচিত জনদের বিষয়ে খোঁজখবর নিতে শুরু করে। একপর্যায়ে জানতে পারে ডেমরায় মনির নামে তার এক বন্ধু আছেন। পুলিশ সেখানে যায়। মনিরের বাসায় গিয়ে মঞ্জুর দুই ছেলেমেয়ের সন্ধান পায়। সেখানেই তারা ছিল। মনিরের থেকে পুলিশ জানতে পারে মঞ্জুর নানা তথ্য। মনির জানতে পেরেছেন মীমকে হত্যা করা হয়েছে। এ খবর আগেই মঞ্জু তাকে জানিয়েছিলেন। কিন্তু দুই শিশু সন্তানের দিকে তাকিয়ে মনির এ বিষয়ে কাউকে কিছু বলেননি। পুলিশ নিশ্চিত হয় এটি নৃশংস খুনের ঘটনা। আবারও জেরা শুরু হয় মঞ্জুকে। কিন্তু তিনি আগের কথাতেই অটল।
পুলিশ এক পর্যায়ে মনিরকে মুখোমুখি করে মঞ্জুর। তখন মঞ্জু আর মুখ বন্ধ রাখতে পারেননি। স্বীকার করেন খুনের ঘটনা। তদন্তে পুলিশ জানতে পারে ঢাকার মগবাজারে একটি আবাসিক হোটেলে হোসনে আরা মীমের সঙ্গে মঞ্জুর পরিচয়। পরিচয়ের সূত্র ধরে দুজনের মধ্যে গড়ে ওঠে প্রেমের সম্পর্ক। রূপলাবণ্যে মীম এগিয়ে থাকলেও মঞ্জুর কম ছিল না। পরে তাদের প্রেমের পরিণয় ঘটে বিয়ের পিঁড়িতে। ভালোই চলছিল সবকিছু। তাদের কোলজুড়ে আসে এক কন্যা ও এক পুত্র সন্তান। একসময় সুখের সংসারে আঘাত হানে পরকীয়া। আগুন লাগে বিশ্বাসের ঘরে। নিত্যদিনের ঘটনায় পরিণত হয় ঝগড়া। এ নিয়ে হাতাহাতি, মারামারি চলতে থাকে।
বাবা-মায়ের এ চিত্র দেখতে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে যায় কোমলমতি দুই সন্তান। সবশেষ গত ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে বিকালে স্বামী-স্ত্রী দুই সন্তানকে নিয়ে বেড়াতে যাওয়ার প্রোগ্রাম ঠিক করেন। কিন্তু সকালে আকস্মিক স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়ার কারণে বেড়ানো ভেস্তে যায়। রাতে নিত্যদিনের মতো দুই সন্তান পাশের রুমে ঘুমিয়ে পড়ে। আরেক রুমে মঞ্জুর দুই বন্ধু নেশার আসর বসান। অন্য রুমে শুরু হয় স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া। আগের ঘটনার মতো মনে করে দুই সন্তান বাবা-মায়ের রুমে যায়নি। রাত ১২টার দিকে ঝগড়ার একপর্যায়ে প্যান্টের বেল্ট দিয়ে মঞ্জু প্রচ- মারধর করেন মীমকে। আহত মীম বাঁচার জন্য নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে মঞ্জুর হাতে কামড় দেন। কিন্তু তাতেও শেষ রক্ষা হলো না। মঞ্জু গলা টিপে হত্যা করেন মীমকে। এরপর সারা রাত লাশ গুমের পরিকল্পনা করতে থাকেন। পরে লাশ ঘরে তালাবদ্ধ করে খুব সকালে মঞ্জু দুই সন্তানকে চিড়িয়াখানায় বেড়ানোর কথা বলে বন্ধু স্বপনের মাধ্যমে ঢাকায় পাঠিয়ে দেন। সন্তানরা মায়ের কথা জানতে চাইলে মঞ্জু বলেন, ‘তোমাদের মা একটি জরুরি কাজে বাইরে গেছে। পরে আসবে। ’ ঘোরাঘুরি শেষে স্বপন দুই সন্তানকে ডেমরার কোনাপাড়ায় মঞ্জুর আরেক বন্ধু মনিরের বাসায় রেখে আসেন। পরে মঞ্জু তার দুই বন্ধুকে নিয়ে নানা ফন্দি আঁটতে থাকেন লাশ গুমের। মঞ্জু পুলিশকে বলেন, ‘আমি, স্বপন ও হুমায়ুন পরামর্শ করে আমার স্ত্রীর লাশ অন্যত্র ফেলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। সেমতে লাশ কম্বল দিয়ে পেঁচিয়ে বস্তার মধ্যে ভরে বাথরুমে রেখে দিই। অন্যত্র ফেলতে না পেরে সিদ্ধান্ত নিই লাশটি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলব। হুমায়ুনকে দিয়ে প্লাস্টিকের বড় আকারের একটি ড্রাম আনাই। লাশটি ড্রামের মধ্যে ভরে ছিপি দিয়ে মুখ আটকে রাখি। এভাবে তিন দিন তিন রাত পার হওয়ার পর লাশের দুর্গন্ধ বের হয়। দুর্গন্ধ যাতে বাইরে না যায় সেজন্য রুমে বিভিন্ন ধরনের সুগন্ধি ব্যবহার করি।
এক পর্যায়ে ৩০ মার্চ আমি, স্বপন ও হুমায়ুন তিনজনে মিলে লাশটি পোড়ানোর ব্যবস্থা করি। আমার বাসায় থাকা সিলিন্ডার গ্যাসের পাইপের সঙ্গে জানালার পর্দা টানানো পাইপ সংযোগ করি। রান্নাঘর থেকে গ্যাসলাইনের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ করে আগুন ধরিয়ে লাশ পুড়তে থাকি। একপর্যায়ে লাশ পোড়ানো গন্ধ ও ধোঁয়া জানালা দিয়ে বাইরে বের হলে পাশের ফ্ল্যাট, বিল্ডিং ও মসজিদে নামাজ শেষে মুসল্লিরা আগুন ধরেছে দেখে চিৎকার করতে থাকেন। তারা বাসার মালিকসহ আমার বাসায় এসে পুরো ঘটনা দেখে আমাকে আটক করে রাখেন। লোকজনের ভিড়ে স্বপন ও হুমায়ুন পালিয়ে যায়।
’৩০ মার্চ রাতেই মীমের মা শাহনুর বেগম বাদী হয়ে মঞ্জুকে প্রধান আসামি করে তিনজনের বিরুদ্ধে সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় একটি হত্যা মামলা করেন।
Discussion about this post