দেশে বেসরকারি উদ্যোগে গড়ে ওঠা প্রথমদিকের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটি দি ইউনিভার্সিটি অব কুমিল্লা। তবে নানা অনিয়মের কারণে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) অনুমোদন হারিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। যদিও কয়েক বছর ধরে ঢাকা ও আশপাশের এলাকায় অবৈধভাবে ক্যাম্পাস খুলে দি ইউনিভার্সিটি অব কুমিল্লার নামে দেদারসে বিক্রি হচ্ছে উচ্চতর ডিগ্রির সনদ। উচ্চ শিক্ষার নামে চলমান এ নৈরাজ্য বন্ধে অনেকটা অসহায় ভূমিকায় দেখা যাচ্ছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসিকে। অনিয়ম বন্ধে উচ্চশিক্ষার সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারক প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকা দু-একটি চিঠি চালাচালির মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে।
দি ইউনিভার্সিটি অব কুমিল্লা অনুমোদন পায় ১৯৯৫ সালে। আইন অমান্য, প্রশাসনিক ও আর্থিক অব্যবস্থাপনা এবং শিক্ষার মান সন্তোষজনক না হওয়ায় ২০০৬ সালে বিশ্ববিদ্যালয়টি বন্ধ করে দেয় সরকার। এর প্রায় এক দশক পর ২০১৬ সালে আদালতের আদেশে পুনরায় শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার সুযোগ পায় বিশ্ববিদ্যালয়টি। তবে আদালতের নির্দেশনা সত্ত্বেও ঠিকানা স্থানান্তর, সংরক্ষিত তহবিল, শিক্ষক নিয়োগসহ নানা জটিলতায় এখন পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়টিকে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার অনুমোদন দেয়নি ইউজিসি। যদিও অনুমোদন না থাকলেও কয়েক বছর ধরে ঢাকা ও আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় দি ইউনিভার্সিটি অব কুমিল্লা নামে ক্যাম্পাস খুলে দেদারসে সনদ বিক্রি হচ্ছে, যা ক্রমেই বাড়ছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ইউজিসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. কাজী শহীদুল্লাহ গণমাধ্যমকে বলেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনিয়ম বন্ধে আইন অনুযায়ী যত ধরনের ব্যবস্থা নেয়া যায়, কমিশন সেটি নিচ্ছে। তবে আমাদের সুপারিশ ও প্রস্তাবনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অন্য অনেক প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভর করতে হয়। সরকারের অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো চিঠি দেয়ার পরও ব্যবস্থা না নিলে আমাদের কিছু করার থাকে না। উচ্চশিক্ষার মান ও পরিবেশ ঠিক রাখতে সরকারের অনেকগুলো সংস্থাকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হয়। কারণ একটি অবৈধ প্রতিষ্ঠান বন্ধ করা তো কমিশনের কাজ নয়। এটা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসির তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দি ইউনিভার্সিটির একমাত্র বৈধ ঠিকানা উত্তরার ৮ নম্বর সেক্টরের পলওয়েল কার্নেশন ভবন। যদিও এ ঠিকানায় বিশ্ববিদ্যালয়টির কোনো অস্তিত্ব নেই। অনুসন্ধানে দেখা যায়, বৈধ ঠিকানায় ক্যাম্পাস না থাকলেও উত্তরা ও নারায়ণগঞ্জের দুটি ঠিকানায় অবৈধ ক্যাম্পাস খুলে শিক্ষার্থী ভর্তি ও তাদের সনদ সরবরাহ করা হচ্ছে। এমনকি অবৈধ ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থী ভর্তির জন্য ফলাও করে বিজ্ঞাপনও প্রচার করা হচ্ছে। দেখা গেছে, এসব ক্যাম্পাস পরিচালনার জন্য আলাদা ওয়েবসাইট ব্যবহার করা হচ্ছে। অনলাইনে দি ইউনিভার্সিটি অব কুমিল্লার নামে অন্তত চারটি ওয়েবসাইট পাওয়া যায়।
অবৈধ ক্যাম্পাসগুলোর একটি ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে অবস্থিত উত্তরার হোসাইন টাওয়ারে। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়টির নামে সনদ বাণিজ্য চলছে। এ ক্যাম্পাসে ভর্তির জন্য শিক্ষার্থীদের প্রলুব্ধ করতে দেয়া বিজ্ঞপ্তিতে ৩০টিরও বেশি প্রোগ্রামের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ক্যাম্পাসটি পরিচালনায় ব্যবহার করা হচ্ছে https://theunicedubd.ac/ ওয়েবসাইটটি। ওয়েবসাইটে গিয়ে দেখা যায়, ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য হিসেবে ৪২ জনের নাম রয়েছে। যদিও আইন অনুযায়ী বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্ট হতে হবে সর্বোচ্চ ২১ সদস্য বিশিষ্ট।
এ ওয়েবসাইটের তথ্যমতে, ৪২ সদস্যের ট্রাস্টের নির্বাহী চেয়ারম্যান কামাল মোস্তফা ও চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ শেখ মোহাম্মদ বায়োজিদ আল হাসান। অবৈধভাবে পরিচালিত এ ক্যাম্পাস বন্ধে এখন পর্যন্ত কোনো উদ্যোগ নেয়নি শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসি।
একইভাবে নারায়ণগঞ্জের ভুলতায় হাবিবুল্লাহ মোতালেব প্লাজায় দি ইউনিভার্সিটি অব কুমিল্লার নামে আরেকটি অবৈধ ক্যাম্পাস পরিচালনা করছে ভিন্ন একটি চক্র। এ চক্রও আলাদা দুটি ওয়েবসাইট খুলে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে প্রতারণা করছে। ওয়েবসাইটগুলো হলো https://theuniversityofcumilla.org/ ও https://cuedu.org/।
নারায়ণগঞ্জের অবৈধ ক্যাম্পাসটির বিষয় নজরে এলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসন ও পুলিশ সুপারকে চিঠি দেয় ইউজিসি। আলাদাভাবে দেয়া চিঠিতে বলা হয়, বিশ্ববিদ্যালয়টির ট্রাস্টি বোর্ডের দাবিদার একাধিক পক্ষ আইন ও নির্দেশনা অমান্য করে অবৈধভাবে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়টির ট্রাস্টি বোর্ড নিয়ে উচ্চ আদালতে একাধিক মামলা চলমান। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়টিতে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত কোনো বৈধ কর্তৃপক্ষ নেই। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুযায়ী, ক্যাম্পাস স্থাপন, স্থানান্তর ও পরিচালনায় সরকার ও কমিশনের অনুমোদনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। দি ইউনিভার্সিটি অব কুমিল্লার নারায়ণগঞ্জের ক্যাম্পাসটি অনুমোদন ছাড়া পরিচালিত হচ্ছে, যা আইন মোতাবেক শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তাই নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসন ও পুলিশকে ক্যাম্পাসটি বন্ধের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়।
যদিও চিঠি দেয়ার দুই মাস পার হলেও এখন পর্যন্ত নির্বিঘ্নে পরিচালিত হচ্ছে নারায়ণগঞ্জের ওই অবৈধ ক্যাম্পাস। চলতি সপ্তাহেও শিক্ষার্থী পরিচয় দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টির নম্বরে যোগাযোগ করা হলে ভর্তির সুযোগ ও সহজে সনদ পাওয়ার নিশ্চয়তা দেন সেখানকার ভর্তি কর্মকর্তা পরিচয় দেয়া এক ব্যক্তি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (আইসিটি ও শিক্ষা) এসএম মাহফুজুর রহমান গণমাধ্যমকে জানান, এ ধরনের কোনো চিঠির কথা তিনি মনে করতে পারছেন না। তাছাড়া মাত্র তিন মাস আগে বর্তমান কর্মস্থলে পদায়ন হয়েছে তার। ফলে এখন কিছু বলতে পারছেন না। বিষয়টি খোঁজ নিয়ে দেখা হবে বলেও জানান তিনি।
এদিকে দি ইউনিভার্সিটি অব কুমিল্লার নামে https://unicedu.ac/ ঠিকানার আরো একটি ওয়েবসাইট রয়েছে। এ ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, ইউজিসির অনুমোদিত ঠিকানায় অনিবার্য কারণে কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। বর্তমানে ট্রাস্ট অফিস হিসেবে কুড়িল এলাকার একটি ঠিকানা দেয়া রয়েছে। এ ওয়েবসাইটে যৌথ মূলধনি কোম্পানি ও ফার্মগুলোর নিবন্ধকের পরিদপ্তর (আরজেএসসি) অনুমোদিত ১১ সদস্যবিশিষ্ট একটি ট্রাস্টি বোর্ডের তথ্য দেয়া রয়েছে।
এ ট্রাস্টি বোর্ডের কোষাধ্যক্ষ তানভীর হায়দার ভূঁইয়া বলেন, নারায়ণগঞ্জে যে ক্যাম্পাসটি অবৈধভাবে পরিচালিত হচ্ছে, তাদের সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। তবে আমাদের একজন ট্রাস্টি সদস্য ট্রাস্টের কোনো অনুমোদন ছাড়াই উত্তরায় অবৈধভাবে একটি ক্যাম্পাস পরিচালনা করছেন, যা দুঃখজনক। আমরা চাই, সরকার সবগুলো অবৈধ ক্যাম্পাস বন্ধ করে দিক। অভিযুক্ত ট্রাস্টির বিরুদ্ধে আমরা আইনানুগ ব্যবস্থা নেব। তাছাড়া নিজেদের সার্বিক অবস্থান তুলে ধরে ইউজিসিকে চিঠি দেয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি।
এসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টি তদন্ত করতে সম্প্রতি কমিশনের একজন সদস্যকে প্রধান করে একটি কমিটি গঠন করেছে ইউজিসি। এ বিষয়ে ইউজিসির সদস্য অধ্যাপক ড. বিশ্বজিৎ চন্দ বলেন, দি ইউনিভার্সিটি অব কুমিল্লার শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার কোনো অনুমোদন নেই। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে কোনো ক্যাম্পাস ও প্রোগ্রাম পরিচালনা সম্পূর্ণরূপে অবৈধ। এ বিষয়ে তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সুপারিশ করবে কমিশন।
এদিকে অবৈধ ক্যাম্পাসের বিষয়ে কঠোর সিদ্ধান্ত নেয়া হলেও আদালতের স্থগিতাদেশ নিয়ে সেগুলো পরিচালনার নজির রয়েছে বলে জানান ইউজিসির একজন কর্মকর্তা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, ইউজিসি থেকে বিভিন্ন সময় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবৈধ প্রোগ্রাম ও ক্যাম্পাস বিষয়ে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া হয়। যদিও পরবর্তী সময়ে মন্ত্রণালয় ও আদালতের নির্দেশনার সুযোগ নিয়ে তার অবৈধভাবে ক্যাম্পাস বা প্রোগ্রাম পরিচালনার সুযোগ পেয়ে যায়। ফলে সমন্বিত উদ্যোগ না নেয়া হলে অবৈধ ক্যাম্পাস পরিচালনার মাধ্যমে সনদ বাণিজ্য ও শিক্ষার্থী ভর্তি বন্ধ করা সম্ভব নয়।
Discussion about this post