এনএনইউ ডেক্স :
নারায়ণগঞ্জের চাঞ্চল্যকর সাত খুন মামলায় ১৫ আসামির ফাঁসির আদেশ বহাল রেখে হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় লেখার কাজ শেষ হয়েছে। দীর্ঘ এক বছরেরও বেশি সময় ধরে চলে এই রায় লেখার কাজ। প্রায় সাড়ে ৮০০ পৃষ্ঠার রায় লেখার পর আজ বৃহস্পতিবার রায়ের কপিতে স্বাক্ষর করেছেন রায় প্রদানকারী বিচারপতি ভবানী প্রসাদ সিংহ ও বিচারপতি মো. মোস্তফা জামান ইসলাম।
তবে আজ সন্ধ্যা পর্যন্ত রায়ের কপি হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট সেকশনে পৌঁছায়নি। আগামী রোববার নাগাদ রায়ের কপি প্রকাশিত হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এখন আসামিপক্ষ রায়ের কপি হাতে পেয়ে আপিল বিভাগে আপিল করবেন। আপিল বিভাগে শুনানির পর তাদের সাজা চূড়ান্ত হবে।
এ মামলায় নারায়ণগঞ্জের সাবেক কাউন্সিলর ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা নূর হোসেন এবং র্যাবের সাবেক তিন কর্মকর্তা তারেক সাঈদ, আরিফ হোসেন, এম মাসুদ রানাসহ ১৫ জনের ফাঁসির দণ্ড বহাল রেখে হাইকোর্ট রায় ঘোষণা করেছিলেন ২০১৭ সালের ২২ আগস্ট। রায়ে নিম্ন আদালতে মৃত্যুদ-প্রাপ্ত বাকি ১১ আসামির সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং ৯ জনের বিভিন্ন মেয়াদে দেওয়া কারাদণ্ডের আদেশ বহাল রাখেন হাইকোর্ট। আসামিদের ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যু অনুমোদন মামলা) ও আপিলের ওপর চূড়ান্ত শুনানি শেষে সংক্ষিপ্ত ওই রায় দেন।
রায়ের পর্যবেণে বলা হয়, কিছু উচ্ছৃঙ্খল র্যাব সদস্যের কারণে এ বাহিনীর গৌরবোজ্জ্বল অর্জন ম্লান হতে পারে না। তাদের সন্ত্রাসবিরোধী গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা ধূলিসাৎ হতে পারে না। কিন্তু এ ঘটনায় বাহিনীর কতিপয় সদস্যের শয়তানি প্রবৃত্তি মানবসভ্যতার মধ্যে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। যে সাতজনকে হত্যা করা হয়েছে, হেফাজতে তাদের মৃত্যুযন্ত্রণা ছিল ভয়াবহ ও অকল্পনীয়। র্যাব সদস্যরা এতটাই নির্দয় ছিলেন যে তাদের হত্যার পর তলপেট ছুরি দিয়ে কেটে বস্তাবন্দী করা হয়। প্রতিটি বস্তার সঙ্গে ১০টি ইট বেঁধে দেওয়া হয়, যাতে লাশ নদীর পানিতে তলিয়ে যায়। এ নৃশংসতায় প্রতীয়মান হয়, তারা মরদেহের ওপর কতটা নির্দয় ছিলেন।
রায়ে বলা হয়, আসামিরা যে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন তাতে এসেছে, এই হত্যাকাণ্ড ছিল সুপরিকল্পিত ও ষড়যন্ত্রমূলক। আর্থিক লেনদেন হয়েছে নূর হোসেনের সঙ্গে। নূর হোসেন হত্যাকাণ্ডের মাস্টারমাইন্ড। তার সঙ্গে ছিলেন তারেক সাঈদ, আরিফ ও মাসুদ রানা। সংক্ষিপ্ত রায়ের পর পূর্ণাঙ্গ রায় লেখার কাজ শুরু হয় যা বৃহস্পতিবার শেষ হয়।
জানা যায়, ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল ঢাকা-নারায়ণগঞ্জের লিংক রোডের লামাপাড়া এলাকা থেকে র্যাবের গাড়িতে তুলে নেওয়া হয় কাউন্সিলর নজরুল, তিন সহযোগী ও তার গাড়ি চালককে। ওই পথ দিয়ে যাওয়ার সময় আইনজীবী চন্দন সরকার তাদেরকে গাড়িতে ওঠানোর বিষয়টি দেখে ফেলায় তাকে ও তার গাড়িচালককেও র্যাব তুলে নিয়ে যায়। পরে তাদের সবাইকে হত্যা করে ওই রাতেই পেট কেটে এবং ইটের বস্তা বেঁধে সবার লাশ শীতলক্ষা নদীতে ডুবিয়ে দেওয়া হয়।
এরপর ওই বছর ৩০ এপ্রিল ছয়জন ও পরদিন একজনের লাশ ভেসে ওঠে। এর এক সপ্তাহের মধ্যে এ ঘটনায় র্যাব-১১-এর অধিনায়ক তারেক সাঈদসহ তিন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার যুক্ততার তথ্য প্রকাশ পায়, টাকার বিনিময়ে হত্যার অভিযোগ ওঠে। একসঙ্গে সাতজনকে ঠান্ডা মাথায় হত্যা ও গুমের নৃশংসতায় শিউরে ওঠে মানুষ। এ ঘটনায় দুটি মামলা হয়। একটির বাদী নজরুলের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম এবং অপরটির বাদী আইনজীবী চন্দন সরকারের জামাতা বিজয় কুমার পাল।
২০১৫ সালের ৮ এপ্রিল র্যাবের ২৫ জন (চাকরিচ্যুত) কর্মকর্তা, সদস্যসহ ৩৫ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। নিম্ন আদালত এ মামলার বিচার শেষে ২০১৭ সালের ১৬ জানুয়ারি রায় ঘোষণা করেন। রায়ে ২৬ আসামিকে মৃত্যুদণ্ড ও ৯ আসামিকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেয় নিম্ন আদালত। একই বছরের ১৬ জানুয়ারি নিম্ন আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে ৩৫ আসামির মধ্যে ২৮ আসামি আপিল করেন, বাকি ৭ জন ঘটনার পর থেকেই পলাতক।
এছাড়া মামলাটি ডেথ রেফারেন্স হিসেবে হাইকোর্টে গেলে তা দ্রুত নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেন তখনকার প্রধান বিচারপতি। পরে হাইকোর্ট ২০১৭ সালের ২২ আগস্ট রায় দেন।
হাইকোর্টের রায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত অপর আসামিরা হচ্ছেন— হাবিলদার মো. এমদাদুল হক, ল্যান্স নায়েক বেলাল হোসেন, সিপাহি আবু তৈয়্যব আলী, কনস্টেবল শিহাব উদ্দিন, এসআই পূর্ণেন্দু বালা, সৈনিক আবদুল আলীম, ল্যান্স নায়েক হীরা মিয়া ও আরওজি-১ এবি মো. আরিফ হোসেন, সৈনিক মহিউদ্দিন মুন্সী, সৈনিক আল আমিন শরীফ, সৈনিক এমডি তাজুল ইসলাম।
সাজা কমিয়ে যে ১১ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন হাইকোর্ট তারা হচ্ছেন— আলী মোহাম্মদ, মিজানুর রহমান দিপু, রহম আলী, আবুল বাশার, আসাদুজ্জামান নূর, মোর্তুজা জামান চার্চিল, এনামুল কবীর, সেলিম, সানাউল্লাহ ছানা, শাহজাহান ও জামলা উদ্দিন। অন্যান্য মেয়াদে দণ্ড বহাল রাখেন নয় আসামির। এরা হচ্ছে— রুহুল আমীন ১০ বছর, বজলুর রহমান ৭ বছর, নাসির উদ্দিন ৭ বছর, আবুল কালাম আজাদ ১০ বছর, নুরুজ্জামান ১০ বছর, বাবুল হাসান ১০ বছর, মো. মোখলেছুর রহমান ১০ বছর, কামাল হোসেন ১০ বছর এবং হাবিবুর রহমানের দুই অপরাধের জন্য ১৭ বছরের দণ্ড বহাল রাখা হয়।
Discussion about this post