নারায়ণগঞ্জের প্রতিটি পাড়া মহল্লায় রয়েছে একেকজন মহাজন ! যারা তিতাস গ্যাস নিজেদের পৈতৃক সম্পত্তি মনে করে ৭০ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকায় অবৈধ সংযোগ দিয়ে প্রতি মাসে ভাড়া আদায় করছে। এলাকাভিত্তিক এমন মহাজনদের নানাভাবে শেল্টার দেয় শাসক দলের কুলাংগার নেতারা । নারায়ণগঞ্জ জেলার সকল উপজেলায় এমন হাজার হাজার অবৈধ সংযোগ পেতে তিতাস কার্যালয়ের অসাধু চক্র নানাভাবে মহাজনদের সহায়তা করে যাচ্ছে – এমন মন্তব্য তিতাসের এক কর্মকর্তার ।
তিনি অসহায়ত্ব প্রকাশ করে আতংকের সাথে আরো বলেন, নারায়ণগঞ্জ তিতাসের হাজার হাজার কোটি টাকার লুটপাটের চিত্র প্রকাশ করলে আমার লাশের চিহ্নও খুজে পাবে না আমার পরিবার !
ঢাকা ও আশপাশে ২৪৫ কিলোমিটার অবৈধ পাইপলাইন, গ্রাহক প্রায় ১০ লাখ। বিল তোলা হয়, অবশ্য সরকার পায় না।
সোনারগাঁ পৌরসভার নোয়াইলে একটি চুন কারখানা চালান ব্যবসায়ী মজিবুর রহমান। তাঁর কারখানার গ্যাস-সংযোগটি অবৈধ। নারায়ণগঞ্জে মসজিদে বিস্ফোরণের দুই দিন পর গত রোববার বিকেলে ওই কারখানার সামনে গিয়ে দেখা যায়, মূল ফটকে তালা ঝুলছে। তবে কারখানার ভেতরে লোকজন ছিল।
কারখানার মালিক মজিবুর রহমানও তখন ভেতরেই ছিলেন। একপর্যায়ে তিনি কারখানার আরেকটি দরজা দিয়ে কোনো কথা না বলে বেরিয়ে যান। পরে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে মজিবুর বলেন, উপজেলার আরও অনেক কারখানা ও আবাসিক গ্রাহকেরা যে উপায়ে গ্যাস ব্যবহার করছেন, তিনিও একই পথ বেছে নিয়েছেন। তবে উপায়টি অবৈধ।
নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, ঢাকাসহ ছয় জেলায় আবাসিক ও বাণিজ্যিক গ্যাস সরবরাহ করে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড। তিতাসের আঞ্চলিক কার্যালয় ও পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, গত আট বছরে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলায় ২৫টির বেশি গ্যাস-সংশ্লিষ্ট দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ৯ জন। এ ছাড়া শতাধিক মানুষ অগ্নিদগ্ধ ও বিভিন্নভাবে আহত হয়েছেন। গ্যাস দুর্ঘটনার একটি বড় কারণ নিম্নমানের পাইপ ও রাইজার (গ্যাসলাইনের মাটির ওপরের অংশ) বসিয়ে অবৈধভাবে গ্যাস-সংযোগ নেওয়া। সোনারগাঁয়ে অবৈধ গ্যাস-সংযোগ বেশি দেওয়া হয়েছিল ২০১২ সালের পর থেকে কয়েক বছর। তখনকার স্থানীয় আওয়ামী লীগের সাংসদ আবদুল্লাহ আল কায়সার ও তাঁর অনুসারীদের বিরুদ্ধে অবৈধ গ্যাস-সংযোগ দেওয়ার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছিল। এ নিয়ে গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। আবদুল্লাহ আল কায়সার অবশ্য সব সময় অভিযোগ অস্বীকার করে আসছেন।
তিতাসের লোক যুক্ত না থাকলে অবৈধ সংযোগ দেওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু কারা কারা যুক্ত, সেটি বের করাই চ্যালেঞ্জ।
নসরুল হামিদ, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী
শুধু সোনারগাঁ নয়, অবৈধ গ্যাস-সংযোগ পুরো নারায়ণগঞ্জ জেলার একটি সাধারণ চিত্র। তিতাসের নিজস্ব হিসাব বলছে, ঢাকা ও আশপাশের চার জেলায় গ্যাসের প্রায় ২৪৫ কিলোমিটার অবৈধ পাইপলাইন রয়েছে। সবচেয়ে বেশি অবৈধ পাইপলাইন নারায়ণগঞ্জ সদর, রূপগঞ্জ, বন্দর, আড়াইহাজার ও রূপগঞ্জ উপজেলায়। যার মোট দৈর্ঘ্য ১৭৯ কিলোমিটার। এরপর রয়েছে মুন্সিগঞ্জ সদর ও গজারিয়া। এখানে অবৈধ লাইন রয়েছে ৩১ কিলোমিটার। ঢাকার যাত্রাবাড়ী, শ্যামপুর, পোস্তগোলা, ডেমরা, মাতুয়াইল, সাইনবোর্ড, কড়াইল বস্তি, বনানীর বিটিসিএল এলাকা, জামগড়া, ধলপুর, আমতলাসহ কয়েকটি এলাকায় ২২ কিলোমিটার অবৈধ গ্যাসলাইন রয়েছে। গাজীপুরে রয়েছে ১৩ কিলোমিটার। এর বাইরে নরসিংদীতেও কিছু অবৈধ পাইপলাইন আছে।
অবৈধ গ্যাস-সংযোগ দেওয়া-নেওয়ার এই প্রবণতা শুরু হয় ২০০৯ সালের পর থেকে, যে বছর সরকার গ্যাস-সংকটে বৈধভাবে সংযোগ দেওয়া বন্ধ ঘোষণা করে। এখনো আবাসিকে গ্যাস-সংযোগ দেওয়া বন্ধ। শিল্পে সংযোগ পাওয়াও বড় কঠিন। অবশ্য সহজে সংযোগ পাওয়া যায় ঘুষ দিলে। তিতাস যে আড়াই শ কিলোমিটার অবৈধ পাইপলাইনের হিসাব তৈরি করেছে, তার বিপরীতে গ্রাহকসংখ্যা সুনির্দিষ্ট করা যায়নি। ঢাকা ও আশপাশের এলাকায় জনসংখ্যা ও আবাসিক ভবনের ঘনত্ব বিবেচনায় নিয়ে তিতাসের কর্মকর্তারা বলছেন, অবৈধ গ্রাহকের সংখ্যা অন্তত ১০ লাখ হবে।
তিতাসের কর্মী, মনোনীত ঠিকাদার ও ক্ষমতাসীনদের যোগসাজশ।
সংযোগপ্রতি ২০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা ঘুষ।
অবৈধভাবে ব্যবহৃত গ্যাস ‘সিস্টেম লসের’ খাতে,বেড়েছে ৫ গুণ।
অবৈধ সংযোগ নেওয়া গ্রাহকেরা বলছেন, তিতাসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একাংশ, ঠিকাদার ও ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের স্থানীয় কিছু নেতার যোগসাজশে ঘুষের বিনিময়ে অবৈধ গ্যাস-সংযোগ পাওয়া যায়। কোনো কোনো এলাকায় মাসে মাসে বিল তুলে ভাগ-বাঁটোয়ারা করা হয়। অভিযোগ আছে, অবৈধ সংযোগে যেসব গ্যাস ব্যবহৃত হয়, তা সিস্টেম লসের খাতে ঢুকিয়ে দেয় তিতাস।
অবৈধ সংযোগের হিসাব বের করলেও কীভাবে এসব লাইন দেওয়া হলো এবং কারা জড়িত, তা-ও চিহ্নিত করেনি তিতাস কর্তৃপক্ষ। মাঝেমধ্যে লোক দেখানো কিছু অভিযান হয়, কিছু সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়, কিছু ঠিকাদারকে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়; কিন্তু অবৈধ পাইপলাইন স্থাপন ও বাসাবাড়িতে অবৈধ গ্যাস-সংযোগ দেওয়া বন্ধ হয় না। তবে নারায়ণগঞ্জে মসজিদে বিস্ফোরণের পর যখন গ্যাসলাইনের ছিদ্রকে দায়ী করা হচ্ছে, তখন নড়েচড়ে বসেছে সরকারের জ্বালানি বিভাগ।
এ বিষয়ে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ গত রোববার প্রথম আলোকে বলেন, অবৈধ গ্যাস-সংযোগের একটি তালিকা করা হয়েছে। তালিকা ধরে শিগগিরই অভিযান চালানো হবে। তিতাস যদি অবৈধ পাইপলাইনের তালিকা করতে পারে, তাহলে স্থানীয় কার্যালয় অভিযান কেন চালায় না—এ প্রশ্নের জবাবে প্রতিমন্ত্রী বলেন, তিতাসের লোক জড়িত না থাকলে অবৈধ সংযোগ দেওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু কারা কারা জড়িত, সেটি বের করাই চ্যালেঞ্জ। অবৈধ সংযোগের সঙ্গে তিতাসের যাঁরাই জড়িত থাকবেন, এবার তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মন্ত্রী প্রথম আলোকে এ বক্তব্য দেওয়ার পরদিন গত সোমবার তিতাসসহ দেশের ছয়টি গ্যাস বিতরণ কোম্পানির প্রধানদের নিয়ে বৈঠক করেন। বৈঠকে অভিযান শুরুর সিদ্ধান্ত হয় বলে জানা গেছে।
ঘুষ ২০ থেকে ৭০ হাজার
নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার তিনগাঁওয়ে স্থানীয় প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কার্যালয়ের সামনে তিতাসের পাইপলাইন। গত মঙ্গলবার কাছে যেতেই শোনা গেল শোঁ শোঁ শব্দে গ্যাস বেরোচ্ছে। স্থানটি উন্মুক্ত, তারপরও গ্যাসের ঝাঁজ নাকে আসছে। কোনোভাবে আগুনের সংস্পর্শ পেলেই বড় দুর্ঘটনার আশঙ্কা থাকে। তিতাসের পাইপলাইন থেকে অবৈধ সংযোগ নেওয়াতেই এই ছিদ্রের সৃষ্টি হয়েছে।
নারায়ণগঞ্জের পাঁচটি উপজেলার সর্বত্রই এমন অবৈধ গ্যাসলাইনের ছড়াছড়ি। অবৈধ এসব সংযোগ দিতে এলাকাভেদে এককালীন ২০ হাজার থেকে ৭০ হাজার টাকা করে নেওয়া হয়। এরপর বিল আকারে প্রতি মাসে ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকা করে নেওয়া হয়, যা তিতাসের হিসাবে জমা হয় না, ভাগ-বাঁটোয়ারা হয়।
গত এক বছরে জেলার বন্দর উপজেলায় আটটি ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে প্রায় ৩০ হাজার অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে বলে জানান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শুক্লা সরকার।
বন্দর উপজেলার আদমপুর এলাকার বাসিন্দা তাজুল ইসলামের বাড়ি সড়কের পাশে খালপাড়ে। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, অবৈধ গ্যাস-সংযোগ পাওয়ার সময়ও তাঁকে জমির দলিল, পর্চাসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দিতে হয়েছে। সংযোগ পেতে তাঁরা তিন ভাই মিলে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা দিয়েছেন স্থানীয় পঞ্চায়েত কমিটিকে। বন্দরের বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দারা জানান, গ্যাসলাইনের অবৈধ সংযোগের বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করেন পঞ্চায়েত কমিটির সদস্যরা। এ ছাড়া স্থানীয় ইউপি সদস্যরাও সংযোগের বিপরীতে টাকা পান।
আদমপুর পঞ্চায়েত কমিটির সভাপতি মো. শাহজালাল প্রথম আলোকে বলেন, তিনি একা কিছু করেননি। স্থানীয় সবাই মিলে এই সংযোগ নিয়েছেন। তবে সংগৃহীত টাকা কাকে দেওয়া হয়েছে, সে প্রশ্নের কোনো জবাব দেননি তিনি।
এলাকায় অবৈধ গ্যাস-সংযোগের ছড়াছড়ি বলে জানান আদমপুরের ইউপি সদস্য হাবিবুল্লাহ্। তবে তাঁর দাবি, এসবের সঙ্গে তিনি জড়িত নন।
করোনায় অভিযান বন্ধ
কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নেই, করেননি আবেদনও, তারপরও ঢাকার আশুলিয়ার বেলমা গ্রামের আইয়ুব আলীর বাড়িতে এক বছরের বেশি সময় ধরে গ্যাস-সংযোগ রয়েছে। বাড়ির তত্ত্বাবধায়ক কাউসার আহমেদ বলেন, স্থানীয় প্রভাবশালীদের কয়েক লাখ টাকা দিয়ে বছর দেড়েক আগে ১১টি চুলার জন্য গ্যাসের অবৈধ সংযোগ নিয়েছেন তাঁরা। ঝামেলা ছাড়া গ্যাস ব্যবহারের জন্য বিল বাবদ প্রভাবশালীদের প্রতি মাসে টাকা দিতে হয়।
সাভার ও আশুলিয়ায় ৬০ থেকে ৭০ লাখ লোকের বসবাস। ভাড়াটেরা গ্যাস-সংযোগ ছাড়া বাসা ভাড়া নিতে চান না। তাই বাড়ির মালিকেরা অবৈধভাবে গ্যাসের সংযোগ নিয়ে থাকেন। আর এ সুযোগে স্থানীয় প্রভাবশালীরা তিতাসের অসাধু ঠিকাদারদের সহায়তায় সংযোগপ্রতি ৭০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা নিয়ে অবৈধ সংযোগের ব্যবস্থা করে দেন।
তিতাসের সাভার আঞ্চলিক বিপণন বিভাগের ব্যবস্থাপক আবু সাদাৎ মো. সায়েম বলেন, অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা হয়। করোনার কারণে অভিযান বন্ধ ছিল। এ সময়ের মধ্যে উচ্ছেদ করা এলাকায় আবার নতুন করে অবৈধ সংযোগ নেওয়া হয়েছে। খুব শিগগির আবার উচ্ছেদ অভিযান শুরু করা হবে।
ঢাকার কেরানীগঞ্জ উপজেলায়ও অবৈধ গ্যাস-সংযোগ রয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, স্থানীয় কয়েকজন প্রভাবশালী ও দালাল মিলে বাসাবাড়িতে গ্যাস-সংযোগ ব্যবস্থা করে দেন। তিতাস অভিযান চালিয়ে কিছু সংযোগ বিচ্ছিন্নও করেছে।
সংযোগের ব্যবস্থা করে দেওয়ার কথা বলে টাকা নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে ঘাটারচর আরশিনগর এলাকার হানিফ মেম্বার ও আঁটিবাজার এলাকার লিয়াকত আলীর বিরুদ্ধে। অবশ্য অভিযোগ অস্বীকার করেন হানিফ মেম্বার। অন্যদিকে লিয়াকত আলী বলেন, তিনি কিছুদিনের মধ্যে গ্যাস-সংযোগের ব্যবস্থা করে দেবেন।
অভিযান চলে, সংযোগও চলে
ঢাকা – নারায়ণগঞ্জ ছাড়াও তিতাসের আওতাধীন গাজীপুর, টঙ্গী, শ্রীপুর ও কালিয়াকৈর এলাকায়ও থেমে নেই অবৈধ গ্যাস-সংযোগ। কর্তৃপক্ষ অবৈধ গ্যাস-সংযোগ বিচ্ছিন্নকরণে অভিযান চালায়। কিন্তু সংযোগকারী দালাল ও গাজীপুর তিতাসের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের লাগাম টেনে ধরা যায় না। বিচ্ছিন্ন করা সংযোগ আবার চালু হয়ে যায়।
Discussion about this post