নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে নিতাইগঞ্জ বাজার। গুরুত্বপূর্ণ এ পাইকারি বাজার থেকে পণ্য কিনতে আসেন আশপাশের জেলার ব্যবসায়ীরাও। দিনে অন্তত ৩০০-৪০০ ট্রাক পণ্য ওঠানামা করে এখানে। বাজারের পাশেই ট্রাকস্ট্যান্ড। নতুন-পুরোনো ছোট-বড় ট্রাক সেখানে রেখে দিনের বেলায় বিশ্রাম নেন চালকরা। মাঝে মধ্যেই চোখে পড়ে জরাজীর্ণ কিছু ট্রাক। সম্প্রতি অনুসন্ধানে জানা গেল এসব ট্রাকের বিস্ময়কর কিছু তথ্য।
এসব ট্রাকের ইঞ্জিনের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে তিন দশকের বেশি আগে। ওই সময় মেয়াদোত্তীর্ণ শতাধিক জিপকে ট্রাকে রূপান্তর করা হয়। যা এখনও সড়ক-মহাসড়কে পণ্য নিয়ে চলাচল করছে।
ঢাকা-ড-৫৩৮০ নম্বর ট্রাকের সামনে গিয়ে মালিকের সন্ধান করতেই বেরিয়ে এলেন এক ব্যক্তি। নাম জানালেন সুমন। তিনিই ট্রাকটির চালক। মালিকের নাম জানতে চাইলে বললেন, সামসুল ইসলাম। কাগজপত্র ঠিক আছে? প্রশ্নের উত্তরে সুমন দৃঢ়স্বরে বললেন, ‘ট্রাকের কোনো কাগজপত্র নাই। এইগুলা কাগজ ছাড়াই চলে। সামসুল ভাইয়ের পুলিশের লগে যোগাযোগ আছে। তাঁর গাড়ি কেউ ধরে না।’
সুমনের কাছ থেকে ট্রাক মালিক সামসুল ইসলামের মোবাইল ফোন নম্বরে কল দিয়ে সাংবাদিক পরিচয় জানাতেই বললেন, ‘ওই ট্রাক আমার না। এ নম্বরের কোনো ট্রাক আমার নেই।’ তবে কয়েকটি ছোট ট্রাক আছে বলে নিশ্চিত করেন। বিষয়টি জানাতেই চালক সুমন ভোল পাল্টে ফেললেন মুহূর্তেই। তিনি বলেন, এই ট্রাক সামসুল ইসলামের না। তাঁর ছেলে শাকিল ইসলামের। তবে তাঁর ফোন নম্বর সংগ্রহে নেই।
খানিক দূরেই ছিল আরেকটি জরাজীর্ণ ট্রাক। নম্বর ঢাকা-ন-৪০৬৫। পাশে দাঁড়ানো এক ব্যক্তি পরিচয় না জানিয়ে মালিক কালু মিয়ার মোবাইল ফোন নম্বর দিলেন। কল দিলে কালু মিয়া দাবি করেন, তাঁর ট্রাকটি পুরোনো হলেও সব ধরনের কাগজপত্র আছে।
নিতাইগঞ্জ ট্রাকস্ট্যান্ডে এমন পুরোনো ও জরাজীর্ণ ১৫টি ট্রাক পাওয়া যায়। কোনোটির নম্বরপ্লেটের আংশিক মুছে গেছে, কোনোটির নম্বরপ্লেটই নেই। যেগুলোর নম্বর আছে, তা সংগ্রহের কিছুক্ষণের মধ্যেই বেশিরভাগ ট্রাক উধাও হয়ে যায় স্ট্যান্ড থেকে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) নারায়ণগঞ্জ কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক সামসুল কবিরের কাছে ১৫টি ট্রাকের নম্বর দিলে যাচাই করে তিনি বলেন, সামসুল ইসলাম ও কালু মিয়ার ট্রাকটিসহ ১৩টি ট্রাকের কাগজপত্রের কোনো তথ্য অফিসের সার্ভারে নেই। কালু মিয়া কাগজপত্র থাকার যে তথ্য জানিয়েছেন, তা সত্য নয়। শুধু নম্বরটি থাকতে পারে। ফিটনেস সার্টিফিকেটসহ অন্যান্য কাগজপত্র থাকলে সার্ভারে দেখা যেত।
একাধিক ট্রাকচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এরশাদ সরকারের শেষ দিকে ১৯৮৮ সালে মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে যাওয়ায় বেশ কিছু জিপ বাতিল করা হয়। এর শতাধিক নারায়ণগঞ্জে এনে এগুলোকে তিন টন ধারণক্ষমতার ছোট ট্রাকে রূপান্তর করা হয়। এগুলোর কোনো বৈধতা দেয়নি বিআরটিএ। সাধারণত সড়কে চলাচলকারী যানবাহনগুলোর জন্য ট্যাক্স টোকেন, ফিটনেস সার্টিফিকেট, রুট পারমিট, ইনকাম ট্যাক্স সার্টিফিকেট প্রয়োজন হয়। এক ট্রাক মালিক কাগজপত্র না থাকার বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, প্রশাসনকে হাত করেই তাঁরা ট্রাকগুলো চালাচ্ছেন। এগুলো প্রায়ই রাস্তায় বন্ধ হয়ে যায়। ফলে যানজট সৃষ্টি হয়। কখনও নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দুর্ঘটনাও ঘটে।
নারায়ণগঞ্জ জেলা ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক শফিউদ্দিন প্রধানের দাবি, ‘এসব ট্রাক আমাদের স্ট্যান্ড থেকে দু-একটির বেশি চলে না। এগুলোর বেশিরভাগ মুন্সীগঞ্জ, নরসিংদীসহ অন্য জেলা থেকে নিতাইগঞ্জের পণ্য পরিবহনের আশায় এখানে অবস্থান করে। কাগজপত্র না থাকায় এরা কম টাকায় পরিবহন করতে পারে।’
নারায়ণগঞ্জের ট্রাফিক ইন্সপেক্টর মোহাম্মদ আব্দুল করিম শেখ (অ্যাডমিন অ্যান্ড প্রসিকিউশন) বলেন, ‘স্ট্যান্ডে গিয়ে আমরা কাগজপত্র চেক করি না। তখন হয়তো তাঁরা (মালিক-শ্রমিক) আমাদের বিরুদ্ধে অন্য রকম অভিযোগ করবেন। তবে রাস্তায় বের হলে সব যানবাহনের কাগজপত্রই নিয়মিত চেক করি।’
সূত্র : সমকাল
Discussion about this post