নারায়ণগঞ্জের সর্বত্র যেন ইজি বাইক নৈরাজ্য চলছেই। পেটের দায়ে ভাগ্য বদলের আশায় অনেকে বন্ধন বাস ড্রাইভার কিংবা দূরপাল্লার হেভী লাইসেন্সধারী ট্রাক ড্রাইভারও কোন ধরণের লাইসেন্সবিহীন তিন চাকার ইজিবাইক চালাতে এসে নানা বিপাকে পরছে প্রতিনিয়তঃ। সড়ক কিংবা মহাসড়কে ইজিবাইক পুরোপুরি নিষিদ্ধ থাকলেও আইনশৃংখলা বাহিনীর অসাধুদের নিয়মিত মাসোয়ারা দিয়ে চলছে লাখ লাখ ইজিবাইক নামক তিন চাকার যানবাহন টি ।
নারায়ণগঞ্জে প্রায় সাড়ে আট হাজার গণপরিবহণ বৈধতা ছাড়াই নারায়ণগঞ্জের সড়ক মহাসড়ক ছাড়াও বীরদর্পে দাবড়ে বেড়াচ্ছে রাজধানীর রাজপথেও। নেপথ্যে সর্বত্র ঘুষ নামক মাসোযারা । আর আইনশৃংখলা বাহিনীর উচ্ছিষ্টভোগি অসাধু কর্মকর্তারা তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে নির্লজ্জের মতো বলেন, “আইনশৃংখলা পরিস্থিতি ভালো আছে। ঘুষ নেয়ার কোন প্রশ্নই উঠে না। ঘুষ বা চাঁদাবাজি কেউ করে থাকলে কঠোরভাবে ব্যবস্থা নেয়া হবে।” ব্যাস এভাবেই চলছে বিরামহীন অপরাধ কর্মকান্ড।
“নারায়ণগঞ্জ শহরের প্রধান ব্যস্ততম চাষাড়ায় কি হচ্ছে ? প্রতিদিন শুধু চাষাড়াতেই ৩ (তিন) শত অটো রিক্সা আটক করে এক হাজার টাকা করে রেকার বিল নামক চাঁদা আদায়ের পর তা ছাড়া হয় । এমন সংবাদ প্রকাশের পর কৌশলে রাজনীতিবেদদের সাথে আঁতাত করে একজন প্রবীন সাংবাদিক / সম্পাদকের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দায়ের করে আইনশৃংখলা বাহিনীর শীর্ষ কর্তারা।”
শুধু মাত্র চাষাড়ায় তিন চাকার এই ইজিবাইক থেকে প্রতিদিন চাঁদাবাজির এই তিন লাখ টাকা কোথায় যায় ? নগরীর কালীর বাজারে ট্রাফিক পুলিশের দায়িত্ব পালনের নামে একজন কন্সষ্টেবল প্রকাশ্যেই ২০ টাকা করে চাঁদা আদায়ের দৃশ্য ধারণ করেন একজন সংবাদ কর্মী। এমন ভিডিও ধারণকালে চাঁদা আদায়কারী ওই কন্সষ্টেবল জোড়ালো সূরেই বলেন, “আমার ভিডিও করলেন ২০ টাকা নিতাছি বইল্লা। যান চাষাড়া যান । প্রতিদিন তিন লাখ টাকার চাঁদা কে খায়, দেখেন, লেখেন ? পারলে ভিডিও করেন ? আমি ছোট চাকরী করি ছোট মানুষ, আমার নামটা লিখলে ওই কর্তারা আমার ক্ষতি কইরা দিবো । খোজ নিয়ে লেখেন। আর আপনাদের সাংবাদিকরা যে ষ্টিকার লাগিয়ে এই চাঁদাবাজির ব্যবসা করতেছে তাি কে লিখবো ? আর প্রতিদিন তিন লাখ টাকার চাঁদা হালাল করতেই সাংবাদিক নামধারী অপরাধীদের সুযোগ দিচ্ছে অটো রিক্সা ১৫ শত টাকা করে চাঁদাবাজি করতে । আর এই চাঁদাবাজি ছাড়াও খুন, অপহরণ, মাদক বহণসহ সকল ধরণের অপরাধ করতে ওই নির্লজ্জ সাংবাদিক নামধারী প্রতারকদেরকে নিয়মিত মাসোয়ারা দেয় অটো চালকরা । আর ওই সাংবাদিক নামধারী প্রতারকদের কাছেই জিম্মি ট্রাফিক পুলিশের কর্তারা।” এভাবেই ক্ষোভ প্রকাশ করে এমন মন্তব্য করেছেন ২০ টাকা করে চাঁদা আদায়কারী ওই কন্সষ্টেবল।
এমন চিত্রের পাশাপাশি দৈনিক বাংলার রূপগঞ্জের সাংবাদিক রাসেল রাসেল আহমেদ তুলে এসেছেন ইজিবাইক ঘিরে ভয়ংকর অপরাধী চক্র বিস্তর তথ্য। যা হুবহু তুলে ধরা হলো
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার নগরপাড়া এলাকার আমজাদ হোসেন দিনমজুর হিসেবে কাজ করতেন। সচ্ছলতার আশায় ভাড়ায় ইজিবাইক চালাতে শুরু করেন। কিন্তু ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়নি তার। ছিনতাইকারীরা তাকে অজ্ঞান করে ইজিবাইকটি নিয়ে যায়। পরে সালিশের সিদ্ধান্তে ৪০ হাজার টাকা ধার-দেনা করে জরিমানা দিতে হয় ইজিবাইক মালিককে।
একই উপজেলার কেওডালা গ্রামের সাগর মিয়া। ঘরে পঙ্গু বাবা আর ছোট ছোট দুই ভাই-বোন। ছোটবেলায় তাদের ছেড়ে চলে যান মা। ভাই-বোনের লেখাপড়ার খরচসহ সংসার চালাতে ভাড়ায় ইজিবাইক চালানো শুরু করেন সাগর। ভাগ্য ফেরানোর বদলে সেই ইজিবাইক বয়ে আনে দুর্ভাগ্য। ২০২০ সালে ৩০০ ফুট সড়কে তাকে গলা কেটে হত্যা করে ইজিবাইক নিয়ে যায় ছিনতাইকারী চক্র। এখন সাগরের দাদি সাহারা বানুর শ্রমে কোনোমতে চলছে সংসার।
বাগবাড়ি গ্রামের মতিন মিয়া ইজিবাইক চালিয়ে পাঁচজনের সংসারে খাবার জোগাড় করতেন। ঋণের টাকায় কেনা ইজিবাইকটি ছিল তার পরিবারের উপার্জনের একমাত্র মাধ্যম। ছিনতাইকারী চক্রের শিকার হয়ে মতিন মিয়াকেও হারাতে হয় সেই হাতের পাঁচ। সেটি আর ফেরত পাননি। পরে অবশ্য জমি বিক্রি করে আবারও ইজিবাইক কিনেছেন। সেটিও কত দিন চালাতে পারবেন, সেই অনিশ্চয়তার মধ্যেই থাকতে হচ্ছে মতিন মিয়াকে।
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ, আড়াইহাজার, সিদ্ধিরগঞ্জ ও সোনারগাঁ উপজেলা ছাড়াও সদর থানা এলাকায় আরো অধিক হারে সক্রিয় ভয়ংকর ছিনতাইকারী চক্রের হাতে নিজেদের কিংবা ভাড়া নিয়ে চালানো ইজিবাইক খুইয়েছেন আমজাদ, সাগর, মতিনের মতো অনেকেই। এই চক্রটি এতটাই ভয়ংকর যে ইজিবাইক ছিনতাই করতে গিয়ে চালককে হত্যা করতেও তাদের কোনো দ্বিধা কাজ করে না। থানা পুলিশ, গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি), পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) ও স্থানীয় পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের তথ্য বলছে, গত পাঁচ বছরে নারায়ণগঞ্জের এই চার উপজেলায় ছিনতাইকারীদের হাতে এভাবে খুন হয়েছেন ৪৮ জন ইজিবাইকচালক। একই সময়ে ছিনতাই হয়েছে ৩৩৮টি ইজিবাইক। টচার উপজেরা ছাড়াও সদর উপজেলার ফতুল্লা ও সদর থানা এলাকায় এমন খুন ও ছিনতাইয়ের চিত্র ভয়াবহ ।
সূত্রগুলো বলছে, চলতি বছরের ১৮ মে রূপগঞ্জের নোয়াপাড়া এলাকার ইজিবাইকচালক কুরবান আলী ছিনতাইকারীদের হাতে খুন হন। এর আগে, ১১ জানুয়ারি পরশি এলাকার মজুরউদ্দিন ও ২৩ মার্চ পশ্চিমগাঁও এলাকার আমির হোসেন বাবুও একইভাবে খুন হন। অন্যদিকে গত ১৫ জানুয়ারি আড়াইহাজারের উচিৎপুরা এলাকার নাজিমউদ্দিন নাজু, ১৪ মার্চ খিরদাসাদী এলাকার সবুজ হত্যার শিকার হন। একই ঘটনার জেরে গত ২৪ এপ্রিল খুন হন সোনারগাঁয়ের সোহান। সিদ্ধিরগঞ্জের মিজমিজি এলাকার সুজন মিয়া খুন হন গত ৭ অক্টোবর।
ইজিবাইকের চালকরা জানান, ব্যাটারিচালিত রিকশা ও অটোরিকশার লাইসেন্স না থাকায় ছিনতাই করে সেটি রং বদলে সহজেই যে কারও কাছে ভালো দামে বিক্রি করা যায়। ইঞ্জিন ও চেচিস নম্বর না থাকায় মালিকানাও প্রমাণ করা যায় না। তাই পেশাদার খুনিদের একটি অংশ চালককে হত্যা করে অটোরিকশা ছিনতাইয়ে সক্রিয় দীর্ঘদিন ধরেই। পুলিশ ও পিবিআইয়ের তদন্তেও ইজিবাইক ছিনতাইয়ের পেছনে এই বিষয়টিই প্রধান কারণ হিসেবে উঠে এসেছে।
নগরপাড়া এলাকার চালক আমজাদ হোসেন, বেলদী এলাকার আক্তার মিয়া ও তালাশকুর এলাকার সোলায়মান মিয়ার মতো ইজিবাইকচালকদের আশঙ্কা, যানটির ইঞ্জিন ও চেচিস নম্বর না দিলে আগামীতে ছিনতাই ও খুনের ঘটনা আরও বাড়বে।
তিন ধাপে ছিনতাই
জেলায় ইজিবাইক ছিনতাই পরিস্থিতি ভয়ংকর রূপ নিয়েছে মন্তব্য করেছেন নারায়ণগঞ্জ পিবিআইয়ের উপপরিদর্শক (এসআই) মাজহারুল। তিনি জানান, ছিনতাইয়ের সময় সংগঠিত খুনের ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে মিলছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। প্রতিটি থানাতেই ভিন্ন ভিন্ন ছিনতাইকারী গ্রুপ রয়েছে। এসব গ্রুপ তিন দলে বিভক্ত হয়ে ছিনতাই করে থাকে।
পিবিআইয়ের এই কর্মকর্তার তথ্য বলছে, ছিনতাইকারী চক্রের প্রথম দল চালককে টার্গেট করে তার বাসা-বাড়ি ও গাড়ির গ্যারেজ রেকি করে। এরপর চালকের ফোন নম্বর সংগ্রহ করে দ্বিতীয় দলকে দেয়। এই দলটি গাড়ির গ্যারেজের আশপাশে অবস্থান নেয়। দিনভর গাড়ি চালিয়ে চালক রাতে গাড়ি গ্যারেজে জমা দিতে যাওয়ার সময় দলটির সদস্যরা যাত্রীবেশে গাড়িতে চড়েন। লোভনীয় ভাড়ার কথা বলে নির্জন এলাকায় নিয়ে যান। সেখানে গলায় গামছা পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ কিংবা ছুরিকাঘাতে চালককে হত্যা করে। এরপর মরদেহ রাস্তার পাশে ফেলে গাড়ি নিয়ে পালিয়ে যায় তারা।
চালককে হত্যার পর চক্রের তৃতীয় দলটি পৌঁছায় গাড়ি কাছে। তারা গাড়ির রং পাল্টে আনুষঙ্গিক কিছু সাজ-সরঞ্জাম পরিবর্তন করে সেটি বিক্রি করে দেয়। বিক্রির পর অর্ধেক টাকা যায় দ্বিতীয় দলটির কাছে, বাকি টাকা চক্রের অন্য সদস্যরা সমানভাবে ভাগ করে নেন।
পিবিআইয়ের এসআই মাজহারুল বলেন, নারায়ণগঞ্জে ইজিবাইক ছিনতাইয়ের ২০-২৫টি চক্র রয়েছে। এক এলাকা থেকে ইজিবাইক ছিনতাই করে বিক্রি করা হয় অন্য এলাকার গ্যারেজে। রূপগঞ্জে ছিনতাই হওয়া ইজিবাইক বিক্রি করা হয় সোনারগাঁ কিংবা ফতুল্লায়। আবার সোনারগাঁয়ে ছিনতাই হওয়া ইজিবাইক বিক্রি করা হয় রূপগঞ্জ কিংবা আড়াইহাজারে।
পিবিআইয়ের আরেক এসআই তৌহিদ বলেন, রূপগঞ্জ, আড়াইহাজার ও সোনারগাঁয়ে অনেক দুর্গম এলাকা রয়েছে। ওই সব এলাকায় ছিনতাইকারীরা ওৎ পেতে থাকে। অনেক ঘটনা ঘটে। কিন্তু ঝামেলা মনে করে অনেকে পুলিশের কাছে অভিযোগও করেন না।
সাম্প্রতিক সময়ে পুলিশ সক্রিয় হয়ে ওঠায় ইজিবাইক ছিনতাইয়ের ঘটনা নিয়ন্ত্রণে এসেছে বলে মনে করছে পুলিশ। রূপগঞ্জ থানার ওসি এ এফ এম সায়েদ জানান, তার উপজেলায় গত চার মাসে ইজিবাইক ছিনতাইয়ের কোনো ঘটনা ঘটেনি। আড়াইহাজার থানার ওসি আজিজুল হকও জানালেন, গত পাঁচ মাসে তার থানায় কোনো ইজিবাইক ছিনতাই হয়নি।
ইজিবাইকের চালকদের সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়ে ওসি আজিজুল হক বলেন, ‘চালকদের খুব সাবধান থাকতে হবে। রাত ১০টার পর বা রাত ১২টায় গাড়ি চালানোর প্রয়োজন নেই। যেখানে-সেখানে কিংবা কোনো নীরব-নির্জন জায়গায় যাওয়াও ঠিক না।’ চালকদের একই পরামর্শ দেন সোনারগাঁ থানার ওসি মাহবুব আলম ও সিদ্ধিরগঞ্জ থানার ওসি মশিউর রহমানও।
জানতে চাইলে পিবিআইয়ের এসপি মো. মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা ইজিবাইক ছিনতাইয়ের বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখছি। বেশ কিছু কাজ এরই মধ্যে করেছি। তবে নিরাপত্তার বিষয়ে চালকদেরও সজাগ থাকতে হবে।’
নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপার গোলাম মোস্তফা রাসেল বলেন, ‘আমরা নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছি। সংবাদপত্রসহ বিভিন্ন মাধ্যমে চালকদের সচেতন করছি। অপরাধীদের গ্রেপ্তারে চেষ্টা চলছে। এরই মধ্যে দুটি ঘটনায় দুটি চক্রকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আশা করছি, ইজিবাইক ছিনতাই শূন্যের কোঠায় নেমে আসবে।’
Discussion about this post