মাদক, অস্ত্র ও জাল টাকা রাখার অভিযোগে র্যাবের করা পৃথক তিনটি মামলায় নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার কায়েতপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য এবং চনপাড়া এলাকার ডনখাত শীর্ষ অপরাধী দুই ডজন মামলার আসামী বজলুর রহমান ওরফে বজলুকে ছয় (৬) দিনের রিমান্ড শেষে অত্যান্ত গোপনীয়তার সাথে সোমবার (২৮ নভেম্বর) সন্ধ্যায় গদবাধা প্রতিবেদন দাখিলের মাধ্যমে আদালতে পাঠানোর পর সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কাউছার আলম কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন এই অপরাধীকে।
রূপগঞ্জের চাঞ্চল্যকর এই অপরাধী চনপাড়ার সকল অপরাধ সাম্রাজ্যের ডনখ্যাত বজলুকে গ্রেফতারের পর নানা নাটকীয়তার পর আদালতে তিনটি মামলায় ৬ দিনের রিমান্ডে নেয় পুলিশ। আদালত থেকে রিমান্ড শুনানী শেষে হাজতখানায় নেয়ার পথে হাস্যেজ্জল ভঙ্গির কারণে অনেকের দৃষ্টি ছিলো রূপগঞ্জ থানা পুলিশের আচরণের প্রতি। রোববার (২০ নভেম্বর) নারায়ণগঞ্জের সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কাউছার আলম এ রিমান্ড মঞ্জুরের পর রূপগঞ্জ থানায় হস্তান্তর করে কোর্ট পুলিশ। এরপর রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদের নামে জামাই আদরের অভিযোগ উঠে পুলিশের বিরুদ্ধে।
বুয়েট ছাত্র ফারদিন হত্যার পর পুরো চনপাড়ায় অপরাধ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় র্যাবসহ অন্যান্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থা । অথচ যেই থানা পুলিশ বজলু কে রিমান্ডে এনে এতো অপরাদের তথ্য উদঘাটনের চেষ্টা করেছে সেই রূপগঞ্জ থানা পুলিশের অসংখ্য কর্মকর্তা চনপাড়ার বজলুর অপরাধের আস্তানায় বসে আপ্যায়িত হন প্রতিনিয়তঃ । সেই পুলিশ রিমান্ডে এনে বজলুর সাথে কি আচরণ করবে তা কারো অজানা নয়।
এমন মন্তব্য করে রূপগঞ্জ থানার একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র বলেন, “কি হচ্ছে রূপগঞ্জে তা কারোর ই অনুমানের বাইরে । আর বজলু তো সামান্য নশ্বি বিষয়। বড় বড় রাঘববোয়াল এই খুনি বজলু কে রক্ষায় তদিবর করে যাচ্ছেন। খেজ নেন কারাগারে কোথায় রাখা হয়েছে এই বজলু কে ।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়, চনপাড়ায় এক বা দুদিনে অপরাধের সাম্রাজ্য গড়ে তুলেনি ডন খ্যাত বজলু। দীর্ঘদিন ধরেই তিনি এই অপরাধ সাম্রাজ্য চালিয়ে আসছিলেন। একটি প্রভাবশালী পরিবারের ছত্রচ্ছায়ায় থেকে তিনি ছিঁচকে চোর থেকে হয়েছেন ‘ডন’। এতটা বছর প্রশাসনও ছিল নীরব ভূমিকায়। যার কারণে দুর্দান্ত প্রতাপশালী হয়ে উঠেছিলেন তিনি।
সাম্প্রতিক সময়ে এই ডন বজলু গ্রেফতার হলেও তাকে যারা সৃষ্টি করেছেন, আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে আজকের অবস্থানে নিয়ে এসেছেন, সেই গডফাদারকে কেন আইনের আওতায় আনা হচ্ছে না কিংবা বজলুকে ডনে রূপান্তরিত করার অপরাধে তাকে আইনের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে কিনা, সে নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন।
সুধি সমাজ বলছেন, বজলু গ্রেফতার হয়েছে। বজলু অধ্যায় হয়তো শেষ হবে। কিন্তু বজলু যাদের জন্য সৃষ্টি । যাদের স্বার্থে বজলুকে ছিঁচকে চোর থেকে ডন বানানো হয়েছে। তারা কি নতুন করে আরও এক বজলুকে তৈরি করবে না ! এই নিশ্চয়তা কে দিবে ? এই নিশ্চয়তা তখনই মিলবে যখন, বজলু সৃষ্টির কারিগরকেও আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে। তবে সেটি আদতে সম্ভব কিনা, এ নিয়েও রয়েছে সন্দিহান। কেননা, বজলুকে যিনি বা যারা সৃষ্টি করেছেন তারা সরকার সংশ্লিষ্ট। প্রভাবশালী। আর এ কারণে চনপাড়া এলাকা আপাতত বজলুমুক্ত হলেও এই গডফাদারদের রাহুরগ্রাসমুক্ত হবে না বলেই মনে হচ্ছে।
চনপাড়ার আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নোয়াপাড়া এলাকায় জামদানি পল্লীতে নলভরার কাজ করার সময় সে চনপাড়া পূর্নবাসনের স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তার রাজনীতির হাতেখড়ি বিএনপি দিয়ে শুরু। ওই সময় স্থানীয় জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীদের সঙ্গে তার সুসম্পর্ক গড়ে উঠে। সেই জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীরা এখন তার হাত ধরেই আওয়ামী লীগে প্রবেশ করেছে।
বিএনপির একটি সূত্র জানায়, স্বেচ্ছাসেবক দল করার সময় বজলু যুবদলে প্রবেশ করতে চাইলে বাধা হয়ে দাঁড়ান যুবদল নেতা সূর্য। পরে নারী ঘটিত অভিযোগ তুলে পর্দার অন্তরালে থেকে সূর্য হত্যায় কলকাঠি নাড়ে বজলু। সূর্য হত্যার অভিযোগের তীর বজলুর দিকেই তাক করেন স্থানীয়রা।
বিএনপি ক্ষমতা থেকে চলে গেলে বজলু আওয়ামী লীগ নেতা তাহের মিয়া ও মালেক মাষ্টারের কাছে গিয়ে প্রাণ ভিক্ষা দাবি করে আওয়ামী লীগে যোগদান করে। তাদের হাত ধরেই থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান ভূঁইয়ার সঙ্গে পরিচিত হন। এক পর্যায়ে নানা কুটকৌশলে প্রবীণ এই দুই নেতাকে কোনঠাসা করে ফেলে। পরে বজলু হয়ে উঠেন আওয়ামী লীগের হর্তাকর্তা। বিগত ৯৬ সালের আওয়ামী লীগের শাসনামলে বজলু শাহজাহান ভূঁইয়াকে পল্টি দিয়ে সাবেক সংসদ সদস্য জেনারেল শফিউল্লাহর পক্ষে কাজ করেন। সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের কারণে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের শেষের দিকে সাবেক সংসদ সদস্য জেনারেল শফিউল্লাহ বজলুকে গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দেন। চতুর বজলু এলাকায় ফিরে নিজের বাহিনী নিয়ে জেনারেল শফিউল্লাহকে চনপাড়ায় অবাঞ্চিত ঘোষণা করেন।
স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা বলেন, বজলু তার স্বার্থের জন্য ক্ষণে-ক্ষণে রূপ বদলাতে পারেন। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেও সে একেকবার একেকজনের সঙ্গে সম্পর্ক গড়েছেন। ক্ষণে এই গ্রুপ, ক্ষণে ওই গ্রুপ। তবে বর্তমানে একটি প্রভাবশালী পরিবারের ছত্রচ্ছায়াতে চনপাড়া এলাকাতে বজলুই হচ্ছেন আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ নেতা। তার দাপট একজন এমপির থেকেও কোনো অংশে কম নয়। তার কারণে আওয়ামী লীগের বহু ত্যাগী নেতাকর্মী কোণঠাসা। অনেকের মধ্যে রয়েছে নানা ক্ষোভ। কিন্তু প্রভাবশালী ওই পরিবারের কারণে কেউ বজলুর বিরুদ্ধে টু-শব্দটি পর্যন্ত করতে পারে না।
বজলুকে নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে আতঙ্কের অন্যতম কারণ গত এক দশকে ঘটে যাওয়া একাধিক হত্যাকাণ্ড। চনপাড়া বস্তির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিহত হয়েছেন আওয়ামী লীগ নেতা চান মিয়া, ইউপি সদস্য বিউটি আক্তার কুট্টি ও তার স্বামী হাসান মুহুরী, ফিরোজ সরকার, ফারুক মিয়া, পুলিশের এএসআই হানিফ মিয়া, ফালান মিয়া, আব্দুর রহমান, র্যাব সোর্স খোরশেদ মিয়া, প্রজন্ম লীগ নেতা মনির হোসেন, আসলাম হোসেন, যুবলীগ সভাপতি আনোয়ার হোসেন, সজল, সামসুর মতো অনেকে। প্রায় প্রতিটি হত্যাকাণ্ডেই কোনো না কোনাভাবে নাম এসেছে বজলুর। তার বিরুদ্ধে হত্যাসহ একাধিক মামলাও রয়েছে রূপগঞ্জ থানায়। তবু আইনের ফাঁক গলে বহালতবিয়তে নিজের কার্যক্রম চালিয়ে গেছেন তিনি। যদিও বেশ কয়েকবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বজলুর বিরুদ্ধে অ্যাকশন নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু প্রভাবশালী একজন জনপ্রতিনিধির কারণে প্রশাসন আর এগুতে পারেনি।
Discussion about this post