এটি কি শিক্ষাঙ্গন নাকি টর্চান সেল ? সরকারী আইনি অনুযায়ী কোন শিক্ষার্থীকে মারধর করা যাবে না এমন নির্দেশনা থাকলেও অনেক শিক্ষাঙ্গনেই শিশু নির্যাতনের নির্মম চিত্র উঠে আসে। আবার অনেকে ঘটনা থেকে যায় অপ্রকাশিত। শিশুদের উপন নির্যাতন / বলৎকার / ধর্ষনের মতো গুরুতর অপরাধের খবর প্রকাশের পূর্বেই শিক্ষাঙ্গনের সাথে যুক্ত প্রভাবশালী চক্র নির্যাতিত শিশুদের অভিভাবকদের ডেকে এন ঘটনা ধামাচাপা দেয়ার ঘটনাও রয়েছে অনেক ।
এমন একের পর এক ঘটনায় নগরীতে প্রশ্ন উঠেছে এই অবুঝ শিশুদের নির্যাতন জন্য শিক্ষাঙ্গনের কোন নজরদারী না থাকায় একেকটি শিক্ষাঙ্গন টর্চার সেলে পরিণত হয়েছে। এমন প্রতিষ্টানকে কি শিক্ষাঙ্গণ বলা যায় ? নাকি বলতে হবে চর্টান সেল ! প্রায় প্রতিটি মাদ্রাসার ভিতরে এবংং বাইরে থেকে তালাবদ্ধ করে রাখা হয় নানা অজুহাতে । আর এই অজুহাতের সুযোগ নিয়েই চলে উল্লেখিত পন্থায় নির্মম নির্যাতন । এমন সকল মাদ্রাসায় কঠোর নজরদারীতে আনা জরুরী
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের উত্তর পাশে অবস্থিত এই ক্বওমী মাদরাসাটি মাদানীনগর মাদরাসা বলে অধিক পরিচিত। আবাসিক সুবিধা থাকা এই মাদরাসাটিতে প্রায় সাড়ে তিন হাজার ছাত্র পড়াশোনা করে বলে জানায় মাদরাসা কর্তৃপক্ষ।
সিদ্ধিরগঞ্জে মাদানীনগর এই মাদ্রাসায় মুখস্ত পড়া বলতে না পাড়ায় ১১ বছর বয়সী শিশু ছাত্রকে মেঝেতে উপুড় করে শুইয়ে পশ্চাদ্দেশে বেত দিয়ে নির্মমভাবে পিটিয়েছেন হাফেজ মাওলানা সাইফুল ইসলাম নামে এক মাদ্রাসা শিক্ষক।
বেত্রাঘাতের এই ঘটনা পরিবারের কাউকে জানাতেও নিষেধ করেছিলেন ওই শিক্ষক।
ঘটনার তিনদিন পর বুধবার (১৯ অক্টোবর) দুপুরে বিষয়টি জানাজানি হলে ওই শিক্ষককে বরখাস্তের কথা জানায় মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ। এর আগে গত রোববার ভোরে আল জামিয়াতুল ইসলামিয়া দারুল উলুম মাদানীনগর মদ্রাসায় এই ঘটনা ঘটে।
নির্যাতনের শিকার শিশুটি মাদানীনগর মাদ্রাসার হেফজ বিভাগের ছাত্র। গত ১৩ মাস যাবৎ মাদ্রাসাটির আবাসিক বোর্ডিং এ থেকে পড়াশোনা করছে শিশুটি। তাদের বাড়ি সোনারগাঁ উপজেলার কাঁচপুর এলাকায়।
শিশুটির পিতা বলেন, গত রোববার ফজর নামাজের পর পড়া ভুলে যাওয়ায় হেফজ বিভাগের শিক্ষক হাফেজ মাওলানা সাইফুল ইসলাম তার ছেলেকে বেত দিয়ে বেধরক পিটিয়ে রক্তাক্ত করেন। বেত্রাঘাত করায় তার শিশু ছেলের পশ্চাদ্দেশে রক্ত জমাট বেঁধে কালোসিরা পড়ে গেছে বলে জানান।
তিনি বলেন, ‘নির্মমভাবে এই নির্যাতনের পরও মাদ্রাসা থেকে আমাদের কাউকে জানানো হয়নি। নির্যাতনের ঘটনা কাউকে না জানানোর জন্য ছেলেকেও শাসান ওই শিক্ষক। ভয়ে ছেলেও আমাদের কিছু বলেনি। সপ্তাহে একবার ছেলের সাথে দেখা করার সুযোগ থাকে। গত মঙ্গলবার বিকেলে ছেলের মা মাদ্রাসায় ছেলেকে দেখতে গেলে কান্নাকাটি করে তাকে সব কথা জানায়। পরে আমরা মাদরাসা কর্তৃপক্ষের কাছে এই ঘটনার কারণ জানতে চাই। তখন তারা ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেন।’
বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে চাকুরি করেন আব্দুল হালিম। তার বড়ছেলে বাড়ির কাছে স্থানীয় একটি উচ্চ বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণিতে পড়ে। ছোটছেলেকে শুরু থেকেই মাদরাসায় পড়াচ্ছেন। শুরুতে বাড়ির পাশে একটি মাদ্রাসায় পড়ালেও ১৩ মাস আগে মাদানীনগর মাদ্রাসার হেফজ বিভাগে ভর্তি করান। মাদ্রাসার বোর্ডিং এ থাকতো সে।
শিশুটির পিতা বলেন, ‘বড় ছেলে হাইস্কুলে ক্লাস নাইনে পড়ে। ছোটছেলেকে মাদ্রাসায় পড়তে দিয়েছিলাম। শিক্ষকরা শাসন করতে পারেন কিন্তু যেভাবে আমার শিশু ছেলেটাকে মারা হয়েছে সেইটা কেউ করে না। এর আগেও মারধরের কথা ছেলে আমাদের জানিয়েছে। শিক্ষকরা একটু-আধটু শাসন করবেই ভেবে কিছু বলিনি। কিন্তু এইবার তো সবকিছুর সীমা ছাড়িয়ে গেছে। এমনটা হবে জানলে তো এই মাদ্রাসায় দিতাম না।’
মাদ্রাসার নিয়মিত রুটির অনুযায়ী ফজর নামাজের পর মুখস্ত পড়া বলতে হয়। ঘটনার দিন ভোরে পড়া ভুলে যাওয়ায় মেঝেতে উপুড় করে শুইয়ে পেটানো হয় জানিয়ে নির্যাতনের শিকার শিশু বলেন, ‘ফজরের নামাজের পর হুজুর পড়া ধরেন। ওইদিন শরীরটা একটু অসুস্থ ছিল। পড়া পারি নাই দেখে আমাকে উপুড় করে শুইয়ে মোটা বেত দিয়ে পাছায় অনেকগুলো বাড়ি মারে। অনেক ব্যথা করছে। আমার কাছে নাপা ট্যাবলেট ছিল, ওইটা খাওয়ার পরে ব্যথা একটু কমছে। এখনও ব্যথায় ঠিকমতো বসতে পারি না।’
শিশুটি জানায়, ‘এর আগেও পড়া না পারায় উনি মারছেন। মারধরের কথা কাউকে বলতে নিষেধ করে দেন।’
এই বিষয়ে কথা বলতে মাদ্রাসায় গিয়ে অভিযুক্ত শিক্ষক সাইফুল ইসলামকে পাওয়া যায়নি। তার মুঠোফোনের নম্বরে যোগাযোগের চেষ্টা করেও সংযোগ পাওয়া যায়নি।
পাওয়া যায়নি মাদ্রাসার মুহতামিম (অধ্যক্ষ) হাফেজ মাওলানা ফয়জুল্লাহকেও। মাদ্রাসার পক্ষ থেকে সাংবাদিকদের সামনে কথা বলেন জ্যেষ্ঠ শিক্ষক হাফেজ মাওলানা আবুল ফাতাহ।
তিনি দাবি করেন, ঘটনা রোববার ঘটলেও বিষয়টি মাদ্রাসার কেউ জানতেন না। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় শিশুটির অভিভাবক মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানায়। বুধবার দুপুরে এক জরুরি সভার সিদ্ধান্তে অভিযুক্ত শিক্ষককে বরখাস্ত করেছেন মাদ্রাসার অধ্যক্ষ। একইসাথে এই ধরনের নির্যাতনের ঘটনা যাতে আগামীতে কেউ না করেন সেই ব্যাপারে মাদ্রাসার সকল বিভাগীয় প্রধানকে লিখিতভাবে জানানো হয়েছে।
বিকেলে নির্যাতনের শিকার ওই ছাত্রকে মাদ্রাসা থেকে বাড়িতে নিয়ে যান তার অভিভাবক। শিশুটির পিতা বলেন, ‘আমি ছেলেকে বাসায় নিয়ে যাচ্ছি। শিক্ষকরা যদি দায়িত্ব নেয় তাহলে মাদ্রাসায় আবার পাঠাবো। নাহলে এই মাদ্রাসায় আর পড়াবো না।’
এমন অভিযোগ পেয়ে মাদ্রসায় পরিদর্শন করেছেন সিদ্ধিরগঞ্জ থানা পুলিশ। এই বিষয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মশিউর রহমান বলেন, ‘খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে গিয়েছিল পুলিশ। এই বিষয়ে ভুক্তভোগী শিশুর পরিবারকে লিখিত অভিযোগ দেওয়ার জন্য বলেছি। তারা অভিযোগ দিলে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
Discussion about this post