রাত পোহালেই স্বপ্ন পূরণ হচ্ছে নারায়ণগঞ্জ – বন্দর বাসীর প্রাণের শীতলক্ষা সেতুর। বহুল আকাঙ্খিত এই সেতুর জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে দীর্ঘ ১২ বছর।
এমন দীর্ঘ অপেক্ষার পর নারায়ণগঞ্জের সদর ও বন্দর উপজেলাকে সংযুক্ত করা তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতু উদ্বোধন হচ্ছে সোমবার (১০ অক্টোবর)। এদিন দুপুর ১২টায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বীর মুক্তিযোদ্ধা এ কে এম নাসিম ওসমানের নামে নামকরণ করা সেতুটির উদ্বোধন করবেন। সেতুটি নারায়ণগঞ্জের পাশাপাশি দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্য সম্ভাবনার নতুন দ্বার উন্মোচন করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
প্রকল্প কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের যানবাহন ও যাত্রীরা যাত্রাবাড়ী-পোস্তগোলা ব্রিজ হয়ে অথবা চাষাঢ়া -সাইনবোর্ড রুটে চট্টগ্রামে যান। এখন শীতলক্ষ্যা সেতু দিয়ে যানবাহনগুলো ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ শহরকে বাইপাস করে গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবে। এতে রাজধানী ও নারায়ণগঞ্জ শহরের ওপর চাপ কমবে, তীব্র যানজটের ভোগান্তি থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে।
প্রকল্প সংশ্লিষ্ট সূত্র আরো জানায়, ২০১০ সালের নভেম্বরে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর সদরের সৈয়দপুর থেকে বন্দরের মদনগঞ্জ এলাকা পর্যন্ত শীতলক্ষ্যা নদীর উপর দিয়ে একটি সেতু নির্মাণের জন্য একটি প্রকল্প হাতে নেয়। প্রায় ৩৭৮ কোটি টাকা ব্যয়ে তিন বছরের মধ্যে এই প্রকল্প শেষ করার কথা থাকলেও পরামর্শক ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দিতেই সময় লেগেছে অন্তত ৬ বছর।
২০১৫ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেতুটির ভিত্তিপ্রস্তর উদ্বোধন করলেও কাজ শুরু হয় ২০১৭ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি। মাত্র ১২শ’ মিটার দৈর্ঘ্যরে এই সেতুটি নির্মাণে অতিরিক্ত সময়ের পাশাপাশি ব্যয় বেড়েছে প্রায় ৬১ শতাংশ। ৬০৮ কোটি ৫৬ লাখ টাকা ব্যয়ে এই সেতুটি নির্মাণে ৩৪৫ কোটি ২০ লাখ টাকা ঋণ সহায়তা দিয়েছে সৌদি সরকার। বাকি অর্থ দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। সেতু নির্মাণ করেছে ‘সিনোহাইড্রো করপোরেশন লিমিটেড’ নামে একটি চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।
তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতু নির্মাণ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক (পিডি) শোয়েব আহমেদ বলেন, ছয়লেনের সেতুটি শিল্প ও বন্দর নগরী হিসেবে খ্যাত নারায়ণগঞ্জ জেলা সদরের সাথে সড়কপথে সোনারগাঁ ও বন্দর উপজেলার সরাসরি সংযোগ স্থাপন করবে। এছাড়া ঢাকা শহরের যানজট নিরসনে বিকল্প সড়ক যোগাযোগও সৃষ্টি করবে এই সেতু। সেতুটি খুলে দেওয়ার পর দেশের তিনটি প্রধান জাতীয় মহাসড়ক ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-সিলেট ও ঢাকা-মাওয়া-খুলনা সরাসরি সংযুক্ত হওয়ার দ্বার উন্মোচিত হবে।
ফলে দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল এবং পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের সরাসরি সড়ক যোগাযোগ নিশ্চিত হবে। এই সেতু ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাড়কের সঙ্গে পদ্মা সেতুর দূরত্ব কমাবে অন্তত নয় কিলোমিটার। এতে সময়ও সাশ্রয় হবে। সেতুটি সার্বিকভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা-সংস্কৃতি প্রসার ও জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখবে।
জেলা সড়ক ও জনপথ অফিসের নির্বাহী প্রকৌশলী শাহানা ফেরদৌস বলেন, এই সেতুর মাধ্যমে শুধু নারায়ণগঞ্জবাসীই উপকৃত হবে না, দক্ষিণবঙ্গের সাথে চট্টগ্রামের যাতায়াতও খুব সহজ হবে। পদ্মা সেতু দিয়ে মুন্সিগঞ্জ হয়ে শীতলক্ষ্যা ব্রিজ দিয়ে মদনপুর হয়ে চট্টগ্রাম যাওয়া যাবে। এটি জাতীয় পর্যায়ে খুবই গুরুত্বপূর্ণ সেতু।
বন্দর এলাকার অনেকেই বলছেন, শীতলক্ষ্যা নদীটি জেলা সদরের সাথে বন্দর ও সোনারগাঁ উপজেলাকে পৃথক করে রেখেছে। এই দু’টি উপজেলার সাথে জেলা সদরের সরাসরি যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকায় কাঁচপুর (শীতলক্ষ্যা সেতু-১) হয়ে দীর্ঘ ৩০ কিলোমিটার পথ ঘুরতে হয়। এছাড়া বন্দর উপজেলার মদনপুর থেকে মদনগঞ্জ পর্যন্ত অন্তত তেরোটি খেয়াঘাট রয়েছে। সাধারণ জনগণ ও বিভিন্ন পেশাজীবী ও কর্মজীবী মানুষ এই ঘাটগুলো দিয়ে নদীপথে ঝুঁকিপূর্ণ জলযানে যাতায়াত করেন। তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতু এই ভোগান্তি থেকে মুক্তি দেবে।
তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতুর নামকরণ করা হয়েছে নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের প্রয়াত সাংসদ বীর মুক্তিযোদ্ধা একেএম নাসিম ওসমানের নামে। ২২ দশমিক ১৫ মিটার প্রশস্ততা বিশিষ্ট এই সেতুতে ধীরগতির গাড়ি (রিকশা-সাইকেল) চলাচলের জন্য আলাদা দু’টি লেন রাখা হয়েছে। হেঁটে পারাপারের জন্যও রয়েছে ফুটপাত।
এদিকে সেতু খুলে দেওয়া হলেও সহসাই সুবিধা পাবেন না বলে জানান পরিবহন শ্রমিকরা। তারা বলছেন, সেতুর পূর্বপাড় অর্থ্যাৎ মদনগঞ্জ থেকে মদনপুরের ১১ কিলোমিটারের সড়কটি খুবই সংকীর্ণ। এই পথে প্রায়সময়ই যানজট লেগে থাকে। সেতুটি চালু হলে যানবাহনের চাপ বাড়বে, তাতে সড়কে যানজট আরও বাড়বে। এদিকে সড়কটির প্রশস্ততা বাড়ানোর জন্য নারায়ণগঞ্জের সড়ক ও জনপথ বিভাগ উদ্যোগ নিলেও কাজ শেষ হতে আগামী বছরের জুন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
এদিকে সেতুর পূর্বপাড়ে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। বিশাল স্থানজুড়ে শামিয়ানা টানিয়ে পাঁচ হাজার মানুষের আসন ব্যবস্থা করা হয়েছে। স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরা আনন্দ মিছিলেরও প্রস্তুতি নিচ্ছেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী (বীর প্রতীক), নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী, নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য একেএম শামীম ওসমান, নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের সংসদ সদস্য একেএম সেলিম ওসমান প্রমুখ।
জেলা প্রশাসক মঞ্জুরুল হাফিজ বলেন, “সেতুর পূর্বপাড়ে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী, সিটি মেয়র, স্থানীয় সাংসদসহ প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন। অনুষ্ঠানস্থলে এলইডি স্ক্রিন স্থাপন করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী ভার্চুয়ালি সংযুক্ত হয়ে সেতুটি উদ্বোধন করবেন।”
এদিকে, সোমবার রাত পোহালেই খুলে দেয়া হচ্ছে এই স্বপ্নের সেতু। একই অনুষ্ঠানে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে নড়াইলে নির্মিত দেশের প্রথম ছয় লেনের মধুমতি সেতু উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) অর্থায়নে ৬৯০ মিটার দীর্ঘ সেতুটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ৯৬০ কোটি টাকা।
Discussion about this post