ঘটনা সাত দিন পূর্বের । অর্থ্যাৎ পহেলা সেপ্টেম্বর (বৃহস্পতিবার)। চিরাচরিত দিনের মতোই সকালের রোদ ছিলো ঝলমলে। সকাল ৮ টার মধ্যেই নগরীর নয়ন সুপার মার্কেটের পিছনের বিল্ডিংয়ে একটি হোসিয়ারী কারখানায় আগুণ। শত শত নারী পুরুষ শ্রমিক সড়কের নেমে আসে আগুণের ভয়ে। এই আগুণ নিভলেও কিছুক্ষনের মধ্যে বিএনপির রাজনৈতিক আগুণে নারায়ণগঞ্জ মহানগরীর ২নং রেল গেইট অর্থাৎ ডায়মন্ড হল চত্বর রণক্ষেত্রে পরিণত হয়।
একদিকে পুলিশের সাথে বিএনপির নেতাকর্মীদের ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া অপরদিকে পুলিশের সঙ্গে বিএনপির সাথে এমন সংঘর্ষ নগরবাসীর মাঝে চরম আতংকের সৃষ্টি হয় । পাল্টে যায় চিরচেনা ব্যস্ত নগরী নারায়ণগঞ্জ কর্মচাঞ্চল্য । এ সময় পুলিশের সাথে বিএনপির নেতাকর্মীদের ধাওয়ায় পিছু হটে পুলিশের সকলেই ।
এক পর্যায়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায় শাওন নামের এক যুবদল কর্মী । শাওনের লাশ নিয়ে চলে রশি টানা টানি, আলোচনা সমালোচনা। একদিকে শাওনকে যুবদল কর্মী আরেক দিকে শাওন যুবলীগ কর্মী বানানোর প্রতিযোগতায় লাশ মর্গে রেখে নিহতের পরিবারের সাথে চলতে থাকে তামাশা।
এরই মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচার হতে থাকে, চাইনিজ রাইফেল দিয়ে গুলি করতে দেখা যায় একজনকে। পরের দিন অর্থৎ শুক্রবার সকল গণমাধ্যমে রাইফেল ব্যবহারের ছবিও ছাপা হয়। চাইনিজ রাইফেল দিয়ে গুলি করা ব্যক্তির নাম মাহফুজুর রহমান কনক বলে জানায় পুলিশ । তিনি জেলা গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) উপ পরিদর্শক (এসআই) তিনি। ভোলা জেলা পুলিশের আর ওয়ান হিসেবে কর্মরত থাকাবস্থায় নারায়ণগঞ্জে নতুন পুলিশ সুপার বদলী হওয়ার সাথে সাথে নারায়ণগঞ্জে বদলী হয়ে চলে আসেন মাহফুজুর রহমান কনক।
মাহফুজুর রহমান কনক যে রাইফেল দিয়ে গুলি করেছেন সেটি কি তার ছিলো ? এমন শ্রশ্ন উঠে সর্বত্র ।
একাধিক ভিডিও চিত্রে দেখা গেছে, সংঘর্ষের আগে মাহফুজুর রহমান কনক অন্য ডিবি পুলিশদের সাথে শোভাযাত্রার দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। তখন তার ডান হাতে একটি লাঠি রয়েছে আর বাম হাতে ছিলো ওয়ারলেস। ওই ভিডিওর আরেক অংশে দেখা যায়, ২নং গেট এলাকায় পুলিশ বক্সের পাশেই মাহফুজের হাতে চাইনিজ রাইফেল। পাশ থেকে পুলিশের পোশাক পরিহিত আরেকজন তাকে গুলির ছুড়া এগিয়ে দিচ্ছেন আর তিনি রাইফেলে গুলি ভরছেন। তাদের পাশে আরও কয়েকজন পুলিশ সদস্য দাঁড়িয়ে ছিলেন। তাদের মধ্যে একজনের মাথা ফেটে রক্ত পড়ছিলো। এরপর সেই রাইফেল দিয়ে গুলি করে করেন মাহফুজ রহমান কনক।
জেলা পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, পুলিশের সঙ্গে বিএনপি নেতাকর্মীদের সংঘর্ষের ঘটনার সময় ডিবি পুলিশের উপ পরিদর্শক (এসআই) মাহফুজ কনক যে চাইনিজ রাইফেল দিয়ে গুলি করেছে সেটি অন্য কারো দায়িত্বে ছিলো। মাহফুজ ঘটনার দিনের চার থেকে পাঁচদিন আগে ভোলা জেলা থেকে নারায়ণগঞ্জে বদলি হয়ে এসেছেন।
ডিবি পুলিশের একজন ইন্সপেক্টর জানান, শর্টগান ও রাইফেল থাকে কন্সষ্টেবলদের কাছে। উপ পরিদর্শক (এসআই) এর কাছে থাকে পিস্তল। তবে কারো কারো কাছে শর্টগান থাকে।
তাহলে কার রাইফেল গুলি গুলি ছুরলেন মাহফুজ ? এমন প্রশ্নের উত্তর মিলেছে। জেলা পুলিশ লাইনের একাধিক পুলিশ সদস্য নিশ্চিত করেছেন ঘটনার সময় তাকে যিনি রাইফেল ও গুলি দিয়েছেন তার নাম লিটন। তিনি পুলিশ লাইনে রিজার্ভ ফোর্সের ১৮ তম ব্যাচে আছেন।
নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আমির খসরু গণমধ্যম কে জানান, নারায়ণগঞ্জে প্রথমে কি পরিস্থিতি ছিলো তা সকলে দেখেছে। আমরা প্রায় ১ ঘন্টা পর সেখানে গিয়েছি তখনো দেখেছি পুলিশ বক্সের ভেতরে ইটপাটকেল ও বিএনপি নেতাকর্মীরা সড়কে। তাদের হামলায় আমাদের ২০ জন পুলিশ সদস্য আহত। এই পরিস্থিতিতে পুলিশ রাবার বুলেট ও টিয়ারশেল ছুড়তে পারে।
যেখানে পরিস্থিতি ছিলো তা গুলি না করে অন্যভাবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা যেত কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, একটি নিয়ে একটি তদন্ত হবে। তবে কখন এ তদন্ত শুরু হবে তার সিদান্ত জানাবেন পুলিশ সুপার।
এক জনের রাইফেল নিয়ে আরেকজন কি গুলি করতে পারে এমন প্রশ্নের উত্তর জানতে নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার গোলাম মোস্তফা রাসেলে মুঠোফোনে একাধিক বার কল করা হয়। তবে তিনি ফোন ধরেনি।
মানবাধিকার কমিশনের নারায়ণগঞ্জের সভাপতি অ্যাডভোকেট মাহাবুবুর রহমান মাসুম সাংবাদিকদের বলেন, বিএনপি শোভাযাত্রা বের করেছে পুলিশ লাঠিচার্জ করলো এটা সহনীয় ছিলো। কিন্তু এরপর সেথানে একাধারে গুলি করা হলো। একটা ছেলে মারা গেলে। এটি আমার ভাষায় একটি হত্যাকান্ড। এখানে যে চাইনিজ রাইফেল ব্যবহার করা হয়েছে সেটি দিয়ে গুলি করার অনুমতি দিলো কে ? এখানে গুলি করার মতো পরিস্থতি শুরুতে ছিলো না। পুলিশ পুরো বিষয়টি গুলাটে করেছে। এটি তদন্ত করা প্রয়োজন।
নারায়ণগঞ্জ নাগরিক কমিটির সভাপতি অ্যাডকেট এ বি সিদ্দিক বলেন, বলেন, নারায়ণগঞ্জে কে এই পরিস্থিতি সৃষ্টি করলো। যা গত এতো বছরেও হয়নি। গণতান্ত্রিক দেশে এগুলো আশা যায় না। আর এক জনের রাইফেল নিয়ে আরেকজন গুলি করে এটা কি মেনে নেয়া যায়। অবশ্যই তদন্ত করে পুলিশ কর্মকর্তাদের এর ব্যবস্থা নিতে হবে।
গত বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ১টা থেকে দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জে বিএনপির নেতা-কর্মীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে একজনের মৃত্যু ছাড়াও পথচারী-নারীসহ গুলিবিদ্ধ হন আরও অনেকে। পাল্টাপাল্টি ধাওয়া, ইটপাটকেল নিক্ষেপ ও লাঠিপেটায় আহত হয়েছেন পুলিশের সদস্যসহ অর্ধশতাধিক মানুষ। এ সময় ডিআইটি বাণিজ্যিক এলাকা ও ২ নম্বর রেলগেট এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয় ।
মাহফুজুর রহমান কনকের এমন গুলির ঘটনায় নারায়ণগঞ্জের ন্যয় সারাদেশে সমালোচনার ঝড় উঠেছে । খোদ পুলিশর কেউ কেউ কঠোর সমালোচনা করে বলেন, এই গুলির ঘটনার নেপথ্যে ভোলা জেলার বিতর্কিত আর ওয়ান মাহফুজুর রহমান কনক নারাযণগঞ্জে বদলী হয়েই কোন দূরভিসন্ধি উদ্দেশ্য নিয়ে এমন কান্ড ঘটালেন কিনা তা তদন্ত করা জরুরী।
Discussion about this post