নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে নাসিক মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী ও সংসদ সদস্য শামীম ওসমানের বিরোধ দীর্ঘদিনের। তাদের এ বিরোধপূর্ণ সম্পর্কের কথা সারা দেশবাসীর অজানা নয়। কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগও এ বিষয়ে জ্ঞাত রয়েছেন। সবশেষ গত কয়েকদিন আগেও তারা একে অপরকে উদ্দেশ্য করে তীর্যকমূলক বক্তব্য দিয়েছেন। তাদেরকে সচরাচর এক মঞ্চে বসতে দেখা যায় না। মাঝে মধ্যে বসে থাকলেও কোনো কথা হয় না।
শনিবার (৩ সেপ্টেম্বর) দুপুরে সোনারগাঁ উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনকে কেন্দ্র করে শামীম ওসমান ও ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী বসেছিলেন একমঞ্চে। তবে এদিনও তাদের মাঝে কোনো কথা হয়নি। সোনারগাঁ আওয়ামী লীগের সম্মেলনে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত হয়েছিলেন কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক এমপি।
সম্মেলনে উপস্থিত নেতাদের সূত্রে জানা গেছে, নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী ও নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য শামীম ওসমান একমঞ্চে এক সারিতে বসেছিলেন। তবে দুইজন দুই কর্ণারে বসা ছিলেন। তাদের একে অপরের সাথে কোনো কথা হয়নি।
এ বিষয়ে সোনারগাঁ উপজেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি অ্যাডভোকেট সামসুল ইসলাম ভূইয়া বলেন, আমাদের সম্মেলনকে কেন্দ্র করে মেয়র আইভী ও শামীম ওসমান এক টেবিলেই বসেছিলেন। তবে তাদের মাঝে কোনো কথা হয়নি। সম্মেলনের কাজ শেষ হওয়ার পর দুইজন দুইজনের মতো চলে গেছেন।
এর আগে চলতি বছরের ১৮ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশ লাইনসে পুলিশ প্রশাসনের উদ্যোগে আয়োজিত ইফতার মাহফিলে এবং গত ২০ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে আয়োজিত ইফতার মাহফিলে এক টেবিলে বসেছিলেন। তবে সেদিনও তাদের মাঝে কোনো কথা হয়নি।
স্থানীয় রাজনীতিবিদরা বলছেন, ১৯৭৩ সাল থেকে আইভীর বাবা পৌর পিতা আলী আহম্মেদ চুনকা ও শামীম ওসমানের বাবা সামসুজ্জোহা থেকে বিরোধী শুরু। বর্তমানেও তারা সেই বিরোধীতার ধারাবাহিকতা ধরে রেখেছেন।
আইভী ও শামীমের বিরোধ মেটানোর জন্য কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ থেকে অনেকবারই চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু কোনো সময়ই তারা সফল হতে পারেননি। কিছুদিন নিরব থাকলেও ফের তারা সেই বিরোধপূর্ণ অবস্থানে চলে যান।
খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ডেকে নিয়ে এই দুই নেতার ঐক্যবদ্ধ রাজনীতির জন্য আদেশ দিলেও এখনো কেউ কারো নামটি সহ্য করতে পারেন না ।
সবশেষ গত ৩০ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস ও ২১ আগস্ট সকল শহীদদের স্মরণে আলোচনা সভা ও দোয়া মাহফিলে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী। এসময় তিনি শামীম ওসমানকে ইঙ্গিত করে বলেন, আপনি পেট্রোনাইজ করেন জামায়াত বিএনপিকে। এগুলো বন্ধ করেন, অন্যথায় এর পরিণতি খুব খারাপ হবে। আপনি টাকার বিনিময়ে মানুষকে দলে নিয়ে আসেন, আবার টাকার বিনিমনে মানুষকে আপনি ক্ষতি করেন। এই কাজগুলি থেকে বিরত থাকুন। আপনার ভয়ে অনেকে আমাদের সাথে এসে কাজ করতে সাহস পায় না। দলের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিভেদ তৈরি করেন আপনি।
প্রসঙ্গত, ২০১১ সালে প্রথম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আইভীর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে লক্ষাধিক ভোটে পরাজিত হয়েছিলেন শামীম ওসমান। এরপর থেকে তাদের বিরোধী এক ধাপ এগিয়ে যায়। ২০১৩ সালে চাঞ্চল্যকর ত্বকী হত্যায় এই বিরোধ বেড়ে যায় বহুগণ। পরবর্তীতে ২০১৬ সালে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের দ্বিতীয় নির্বাচনে প্রকাশ্যেই আইভীর মনোনয়ন বিরোধীতা করে মাঠে নামেন শামীম ওসমান। এই নির্বাচনে জয়ী হয়েছিলেন আইভী। সর্বশেষ ২০২২ সালের নির্বাচনেও আইভীর বিরোধীতা করেছিলেন শামীম ওসমান। এ ছাড়াও ফুটপাত থেকে হকার উচ্ছেদকে কেন্দ্র করে হামলার শিকার হয়েছিলেন আইভী। সেই হামলার ইন্ধনদাতা হিসেবে অভিযোগের আঙুল শামীম ওসমানের দিকেই তুলেছিলেন আইভী।
সোনারগাঁয়ের আজকের (৩ সেপ্টোম্বর) আওয়ামী লীগের সম্মেলনে প্রথমে নাসিক মেয়র ডাক্তার সেলিনা হায়াৎ আইভী তার জ্বালাময়ী বক্তব্যে সোনারগাঁয়ের রাজনীতিতে এক নেতার এক দেশ নারায়ণগঞ্জ হয়ে গেছে। জাতীয় পাটির এমপি কেন ? এখনে কেন ভাইয়েদের রাজনীতি চলে । আমরা কোন ভাইয়েদের কতৃত্ব চাই না। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের প্রথম বৈঠক হয়েছিলো পাইকাপাড়ার মিউচ্যুয়াল ক্লাবে।
মেয়র আইভী আরো বলেন, সোনারগাঁয়ে কি এতই আওয়ামীলীগ নেতার ঘাটতি হয়ে গেছে যে বারবার জাতীয় পাটির হতে সোনারগাঁ তুলে দিতে হবে ? নারায়ণগঞ্জ ৫ আসন নিয়ে দীর্ঘদিন ষড়যন্ত্র চলছে । সে টা না হয় কারণ ছিলো যে জোহা চাচার ছেলে এমপি হয়েছে । কিন্তু সোনারগাঁয়ে কেন ? যার নাম ছিলো না নিশানা ছিলো না সেই রকম একজনকে এমপি করতে হবে । এখনে জাতীয় পাটি মেনে নেয়া যায় না । বিগত ১০ বছরে এখানে স্থানীয় আওয়ামীলীগে কে ধ্বংস করেছে । সব ভাই ভেসে যাবেন শেখ হাসিনা না থাকলে। নারায়ণগঞ্জের হস্তক্ষেপের কারণে স্থানীয় আওয়ামী লীগ দাড়াতে পারেন না। বিভিন্ন ভাইদের নামে শ্লোগান দেয়া বন্ধ করেন । শ্রোগান দেন শেখ হাসিনার নামে।
একই সম্মেলনে সংসদ সদস্য শমীম ওসমান, বলেন সোনারগাঁয়ে আওয়ামীলীগের ক্যান্টনমেন্ট করতে হবে । ওরা আমাদেরকে হুমকি দেয়। এখনো আমাদের পরীক্ষা নেয়ার কথা বলেন । অবস্থান পরিস্কার করেন । বিএনপি জামায়াত আর ওই সুশীলদের বিষয়ে অবস্থান পরিস্কার করতে হবে । বড় কথা বলেন, কোন পরিবারের কয় জন গ্রেফতার হয়েছে ?
এ সময় মেয়র আইভীসহ সকল নেতাদেরকে আগামী ২৪ জানুয়ারী পর্যন্ত ঐক্যবদ্ধ হতে আহবান জানান শামীম ওসমান।
অনুষ্ঠিত সোনারগাঁ আওয়ামীলীগের সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক, কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক স্থায়ী কমিটির সভাপতি অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম, আইন বিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট নবিউল্লাহ হিরু, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র সেলিনা হায়াত আইভী, নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য একেএম শামীম ওসমান, মুন্সীগঞ্জ-৩ আসনের সংসদ সদস্য মৃণাল ক্রান্তি দাস, নারায়ণগঞ্জ-২ আসনের সংসদ সদস্য নজরুল ইসলাম বাবু, নারায়ণগঞ্জ-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য কায়সার হাসনাত, সোনারগাঁ উপজেলা চেয়ারম্যান শামসুল ইসলাম, নারায়ণগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল হাই, সাধারণ সম্পাদক আবুল হাসনাত শহিদ মোঃ বাদল, নারায়ণগঞ্জ মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আনোয়ার হোসেন, সাধারণ সম্পাদক খোকন সাহা, নারায়ণগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের শিল্প বিষয়ক সম্পাদক এস এম জাহাঙ্গীর, নারায়ণগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য আনিসুর রহমান দিপুসহ প্রমুখ।
Discussion about this post