ত্বকী হত্যার সপ্তম বর্ষকে সামনে রেখে বুধবার (৪ মার্চ) রাতে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে অবস্থিত র্যাব-১১ ব্যাটালিয়ানের সদর দপ্তরে সংস্থাটির সিনিয়র সহকারী পরিচালক আলেপ উদ্দিন বেশ কয়েকটি গণমাধ্যম ও টিভি চ্যানেলকে দেয়া এক সংক্ষিপ্ত সাক্ষাৎকারে এ আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
তবে মামলাটির চার্জশিট প্রদানে বিলম্বের বিষয়ে উপস্থিত সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে র্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, এর আগে বেশ কয়েকজন তদন্ত কর্মকর্তার হাত ঘুরে মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয় র্যাবকে। ফের নতুন করে তদন্ত করতে গিয়ে বিভিন্ন বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে খতিয়ে দেখতে হয়েছে বিধায় কিছুটা বিলম্ব হয়েছে।
তবে কালক্ষেপণ হলেও বর্তমানে মামলাটির তদন্ত অনেকটাই অগ্রগতি হয়েছে উল্লেখ করে আলেপ উদ্দিন আশা প্রকাশ করে বলেন, যতো দ্রুত সম্ভব তদন্তকাজ সম্পন্ন করে চার্জশিট প্রদানের ব্যাপারে আন্তরিকতার সাথে চেষ্টা করা হচ্ছে। এবং খুব শিগগিরই এ মামলাটির চার্জশিট আদালতে দাখিল করার ব্যাপারে তিনি আশাবাদী।
এর আগে হত্যাকাণ্ডের এক বছর পর ঢাকায় র্যাবের সংবাদ সম্মেলনে উপস্থাপিত খসড়া চার্জশিটটি নিয়ম বহির্ভূতভাবে কি করে মামলার বাদীর হাতে এলো এবং গণমাধ্যমে তা প্রকাশ পেলো সে ব্যাপারে সাংবাদিকরা জানতে চাইলে আলেপ উদ্দিন বলেন, এ বিষয়টি আমার জানা নেই। তাই আমি কিছু বলতে পারব না।
তদন্তের বর্তমান অগ্রগতি কি পর্যায়ে আছে এবং যাদেরকে অভিযুক্ত করা হয়েছে আদৌ তারা হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিল কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে র্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, তদন্তের স্বার্থে আগাম কোন কিছুই এখন বলা সম্ভব নয়।
এদিকে আগামীকাল (৬ মার্চ) হত্যাকান্ডের ছয় বছর পেরিয়ে সপ্তমবর্ষ শুরু হতে চললেও র্যাব এখন পর্যন্ত মামলাটির অভিযোগপত্র দাখিল করতে না পারায় বরাবরের মতো হতাশা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন নিহত ত্বকীর পরিবারসহ সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা। হত্যায় অভিযুক্তরা প্রভাবশালী হওয়ায় বিচার প্রক্রিয়া বিলম্বিত হচ্ছে বলে দাবি করছেন নিহত ত্বকীর পরিবার।
তবে সরকারের ভাবমূর্তি সমুন্নত রাখতে আলোচিত এই হত্যাকান্ডের বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়া খুবই জরুরি বলে মনে করছেন সাধারণ মানুষসহ নাগরিক সমাজের নেতারা। সময় সংবাদের প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে এ বিষয়গুলো তুলে ধরে প্রতিক্রিয়া জানান তারা।
মামলার বাদী নিহত ত্বকীর বাবা সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রফিউর রাব্বি এ প্রসঙ্গে সময় নিউজকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ত্বকী হত্যার পেছনে রাজনৈতিক প্রভাবশালীরা জড়িত রয়েছে। রাজনৈতিক প্রভাবের কারণেই র্যাব খসড়া চার্জশিট প্রকাশ করেও চূড়ান্তভাবে সেটি দাখিল করতে পারলো না।
রফিউর রাব্বি দুঃখ ও হতাশা প্রকাশ করে বলেন, আমাদের দেশে বর্তমানে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, বড় কোনো ঘটনার ব্যাপারে সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে সিদ্ধান্ত দিলে তা বাস্তবায়ন হয়। সিদ্ধান্ত না দিলে বাস্তবায়ন হয় না। তেমনি আমাদের প্রধানমন্ত্রী চাইলে ত্বকী হত্যার বিচার হবে। তিনি না চাইলে বিচার হবে না।
প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে রফিউর রাব্বি বলেন, আমাদের প্রধানমন্ত্রী দেশের সমস্ত শিশু হত্যার সুষ্ঠু বিচারের ব্যাপারে কঠোর নির্দেশনা দিয়েছেন। সেই ধারাবাহিকতায় আমি আশা করি ত্বকী হত্যার বিচারও তিনি করবেন।
সমস্ত নারায়ণগঞ্জবাসী তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে।
সন্ত্রাস নির্মূল ত্বকী মঞ্চের সদস্য সচিব কবি হালিম আজাদ বলেন, রাষ্ট্রীয়ভাবে ত্বকী হত্যার বিচার না হলেও সামাজিকভাবে বিচার হচ্ছে। নারায়ণগঞ্জবাসী জানে কারা ত্বকীকে হত্যা করেছে। তাদের প্রতি সবাই ঘৃণা প্রকাশ করছে। এটাই সামাজিক বিচার।
হালিম আজাদ বলেন, বিচার হয়নি বলে আমরা হতাশ নই। আমরা এখনো আশাবাদী। রাষ্ট্রীয়ভাবে ত্বকী হত্যার বিচার একদিন না একদিন হবেই। আমরা সেই প্রত্যাশায় থাকবো।
বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী ও নারায়ণগঞ্জ প্রেসক্লাবের সভাপতি এ্যাডভোকেট মাহাবুবুর রহমান মাসুম বলেন, ত্বকী হত্যার বিচার না হওয়াটা দেশ ও জাতির জন্য অত্যন্ত লজ্জার ব্যাপার। কোনো গণতান্ত্রিক সভ্য দেশে এমন একটি হত্যাকাণ্ডের বিচার প্রক্রিয়া বছরের পর বছর থেমে থাকতে পারে না। এতে প্রমাণ হয়, দেশে এখনো সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হয় নি। ত্বকী হত্যাকাণ্ডে প্রভাবশালী সন্ত্রাসী গডফাদাররা জড়িত থাকায় এর বিচার হচ্ছে না দাবি করে তিনি বলেন, আমরা আশা করছি সরকার ত্বকী হত্যার সুবিচার করে দেশে সুশাসনের দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে।
গত ২০১৩ সালের ৬ মার্চ নারায়ণগঞ্জ শহরের পুরাতন কোর্ট এলাকা থেকে অপহরণের পর হত্যা করা হয় ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবিসি ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের মেধাবি শিক্ষার্থী তানভীর মুহাম্মদ ত্বকীকে। দুইদিন পর ৮ মার্চ পুলিশ ত্বকীর লাশ উদ্ধার করে শহরের চারারগোপ এলাকায় শীতলক্ষ্যা নদীর কুমুদিনী খাল থেকে। এ ঘটনার পর ওইদিনই নিহত ত্বকীর বাবা রফিউর রাব্বি সদর থানায় বাদি হয়ে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করে লিখিত অভিযোগ দেন।
এর দশদিন পর ১৮ মার্চ রফিউর রাব্বি সংসদ সদস্য শামীম ওসমান, তার ছেলে অয়ন ওসমান, তৎকালীন জেলা ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান সুজন, সহ-সভাপতি রাজীব দাশ, সালেহ রহমান সীমান্ত ও রিফাতকে আসামী করে সম্পূরক এজাহার দায়ের করেন। ওই মামলার তদন্ত সংস্থা ডিবি পুলিশের তদন্ত সন্তোষজনক না হওয়ার মামলার বাদী রফিউর রাব্বি উচ্চ আদালতে রিট করলে আদালতের নির্দেশে মামলাটি পুনঃতদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয় র্যাবকে।
হত্যাকাণ্ডের এক বছরের মাথায় তদন্ত সংস্থা র্যাব তদন্ত করতে গিয়ে ত্বকী হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সাংসদ শামীম ওসমান ও তার ছেলে অয়ন ওসমানসহ উল্লেখিত ছয়জনের কোন সংশ্লিষ্টতা না পেয়ে নতুন করে প্রাক প্রস্তুতিমূলক একটি আসামির তালিকা তৈরি করে। তাতে উল্লেখ করা হয় শামীম ওসমানের বড় ভাই সাংসদ নাসিম ওসমানের ছেলে আজমেরী ওসমানের নেতৃত্বেই ত্বকীকে হত্যা করা হয়।
র্যাবের ওই তালিকায় আজমেরী ওসমান, তার সহযোগী ইউসুফ হোসেন লিটন, সুলতান শওকত ভ্রমর, শিপন জামশেদ ও কালাম শিকদারসহ ১১ জনের নাম উঠে আসে। এদের মধ্যে র্যাব এখন পর্যন্ত পাঁচজনকে গ্রেফতার করলেও বর্তমানে তারা জামিনে এবং অন্যরা পলাতক রয়েছে। তবে গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে সুলতান শওকত ভ্রমর ও ইউসুফ হোসেন লিটন আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিলেও তাদের বক্তব্য দুই রকম হওয়ায় এ নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়।
এ ছাড়াও তদন্তকালে শহরের কলেজ রোড এলাকায় কথিত টর্চারসেল নামে আজমেরী ওসমানের ব্যক্তিগত কার্য্যালয়ে অভিযানে যুবকের রক্তমাখা জামাকাপড় উদ্ধার হলে র্যাব সেটি ত্বকীর বলে জানালে আরেক বিতর্কের সৃষ্টি হয়। কারণ, কুমুদিনী খাল থেকে শার্ট প্যান্ট পড়া অবস্থাতেই ত্বকীর লাশ উদ্ধার হয়েছিল। ত্বকীর পোশাক পরিহিত লাশের সেই ছবিসহ এ নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হলে বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেয়, তাহলে ত্বকী হত্যায় মূলত কারা জড়িত?
পরে র্যাব ত্বকী হত্যার বিষয়ে ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন করে ওই খসড়া চার্জশিটের বিষয়টি গণমাধ্যম কর্মীদের কাছে প্রকাশ করে শিগগিরই চূড়ান্ত চার্জশিট দাখিল করার কথা জানায়। এরপর ছয় বছর অতিবাহিত হলেও তদন্ত সংস্থাটি এখন পর্যন্ত এই হত্যা মামলার অভিযোগপত্র দাখিল করতে পারেনি।
হত্যাকান্ডের সপ্তম বর্ষ উপলক্ষে প্রতি বছরের মতো এবারও খুনিদের বিচার দাবি করে ত্বকী স্মরণে ৬ মার্চ থেকে শিশু সমাবেশ, শিশু-কিশোরদের চিত্রাংকন ও রচনা প্রতিযোগিতা, পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান এবং সুশীল সমাজের বিশিষ্টজনদের নিয়ে গোলটেবিল বৈঠকসহ চারদিন ব্যাপী নানা কর্মসূচির আয়োজন করেছে সন্ত্রাস নির্মূল ত্বকী মঞ্চ।
Discussion about this post