নারায়ণগঞ্জ নিউজ আপডেট :
কবি জসিম উদ্দিনের বিখ্যাত ”মামার বাড়ি“ কবিতায় “ঝড়ের দিনে মামার বাড়ি আম কুড়াতে সুখ “ এই অংশটি এখন সকলের মুখে উচ্চারিত হচ্ছে । বিশেষ করে রাজধানীর পুরান ঢাকা চুড়িহাট্টা এবং বনানীতে আগুনের ঘটনায় যখন তোলপাড় তখন নারায়ণগঞ্জের ফায়ার সার্ভিসের ইন্সপেক্টর ও ফায়ারম্যানদের অনেকেই যেন বিশাল বাণিজ্যে মেতে উঠেছে ।
এ যেন “ঘর পোড়ার মধ্যে আলু পোড়া দেয়ার” মতো অবস্থা বলেও অনেকেই মন্তব্য করেছেন । নারায়ণগঞ্জ ফায়ার সার্ভিসের অসাধু প্রায় ২০ জন ইন্সপেক্টর ও ফায়ারম্যান ছাড়াও খোদ ফায়ার সার্ভিসের দারোয়ান রাজ্জাকের শ্যালক মাহিনের মাধ্যমে জেলার প্রতিটি মিল, ফ্যাক্টরী, কল কারখানা ও বিভিন্ন বিপনী বিতানসহ সকল বহুতল ভবনে অগ্নি নির্বাপক লাইসেন্স করে দেয়ার নাম করে কোটি কোটি টাকার বিশাল বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে ।
ব্যাপক অনুসন্ধ্যান চালিয়ে জানা যায়, সারাদেশের ন্যয় নারায়ণগঞ্জের ফায়ার সার্ভিসের যে কোন অগ্নিকান্ডের ঘটনায় নিরলসভাবে কাজ করে তাদের সুণাম অক্ষুন্ন রেখেছে সারা বছর জুড়েই । কিন্তু কোন বড় ধরণের দূর্ঘটনার পর দেশে তোলপাড়ের সৃষ্টি হলে ফায়ার সার্ভিসের ফায়ারম্যান ও ইন্সপেক্টরদের যেন ঈদের দিনের আনন্দ তৈরী হয় । রাজধানীর চুড়িহাট্টায় ও বনানীতে আগুণের ঘটনায় শতাধিক ব্যক্তির করুন মৃত্যুর পর নারায়ণগঞ্জের অগ্নিঝুকিপূর্ণ ভবনের তালিকা তৈরীতে উঠেপরে মাঠে নামে ফায়ার সার্ভিসের ফায়ারম্যান ও ইন্সপেক্টররা । আর এই অসাধু ফায়ারম্যান ও ইন্সপেক্টরদের নানাভাবে সহযোগিতা করে দারোয়ান রাজ্জাকর শ্যালক মাহিন উদ্দিন।
রাজধানীর অগ্নিকান্ডের পর নানা আইন দেখিয়ে অসাধূ মাহিনচক্র নারায়ণগঞ্জ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে বলেও অভিযোগ উঠেছে খোদ ফায়ার সার্ভিসের কয়েকজন কর্মকর্তাদের কাছ থেকে ।
নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করে এক কর্মকর্তা বলেন, নারায়ণগঞ্জ তো মামার বাড়ি। এখানে ঝড় উঠলেই আম কুড়াতে খুব ষুখ পায় ভাগিনারা ! নারায়ণগঞ্জের ফায়ার সার্ভিসের দারোয়ান রাজ্জাকের শ্যালক মাহিন এই ফায়ার লাইসেন্স, ছাড়পত্রসহ গ্রাহকদের নানা অগ্নি নির্বাপক সরজ্ঞামাদি সরবরাহ করে মাহিন উদ্দিন প্রতিমাসে কোটি কোটি টাকা লুটপাট করে নিয়ে যাচ্ছে । একই সাথে নারায়ণগঞ্জের ফায়ার সার্ভিসের ৬/৭ জন ইন্সপেক্টর এককটি লাইসেন্সের বিপরীতে নিম্নে ১০ হাজার আর উর্দ্ধে লাখ টাকাও ঘুষ নিচ্ছে প্রকাশ্যেই । মাহিন দারোয়ানের শ্যালক হলেও সে সনজেকে ফায়ার কর্মকর্তাপরিচয় দিয়ে এবং ফায়ারের মটর সাইকেল ও ওয়াকিটকি ব্যবহার করে নিজেকেই সকল কাজের কাজি দাবী করে চালিয়ে যাচ্ছে অপকর্ম।
সূত্রটি আরো জানায়, সারাদেশের সবচেয়ে ব্যবসা সমৃদ্ধ জেলা নারায়ণগঞ্জের ফায়ার সার্ভিসের একজন ইন্সপেক্টর বদলী হয়ে আসতে ৮/১০ লাখ টাকা ঘুষ দিতে হয় । এই ঘুষের টাকা আদায় করতে সকল মিল, ফ্যাক্টরী, কল কারখানা, হাইরাইজ বিল্ডিংসহ ফায়ার সংশ্লিষ্ট সকল স্থাপনায় হানা দিয়ে নানা ছল ছাতুরী ও আইনের ফাঁক ধরিয়ে ঘুষ বাণিজ্য শুরু করে সারা বছর জুড়েই । আর এই ঘুষ বাণিজ্যের পুরো চক্রের হোতা দারোয়ান রাজ্জাক শ্যালক মাহিন উদ্দিন । ফায়ার সার্ভিসের সকল ধরনের অপকর্ম করে মাহিন বর্তমানে কোটি কোটি টাকার মালিক । জেলার প্রায় সকল ফায়ার লাইসেন্স, ছাড়পত্র তৈরী করতে বিশাল বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে বছর জুড়ে। একটি ২শ স্কয়ার ফিটের কারখানার ফায়ার লাইসেন্স করতে সরকারী ফি ব্যাংকের মাধ্যমে জমা দিতে হয় ১৪২৫ থেকে ১৪৭৫ টাকা । এই লাইসেন্স করে দেয়ার নাম করে মাহিন উদ্দিন প্রত্যেক গ্রাহকের কাছ থেকে আদায় করছে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা । অপরদিকে হাইরাইজ বিল্ডিংয়ের ছাড় পত্র করাতে ১০/১৫ হাজার টাকা সরকারী ফি থাকলেও প্রায় সকল বিল্ডিংয়ের মালিকদের কাছ থেকে নানা ভয়ভীতি দেখিয়ে মাহিন উদ্দিন ও ফায়ার ম্যানদের অনেকেই ইন্সপেক্টরদের সহযোগিতায় দেড় থেকে দুই লাখ টাকা করে আদায় করছে ।
নারায়ণগঞ্জ ফায়ার সার্ভিসের দালাল মাহিন উদ্দিন যেন এক আতংকের নাম । নানা আইনী জটিলতার কারণে দারোয়ান শ্যালক মাহিনের বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুলতে সাহস করে না । মাহিনের সাথে অবৈধ এমন কর্মকান্ডের সাথে যুক্ত ফায়ারম্যান, ইন্সপেক্টরসহ ফায়ার সার্ভিসের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সাথে রয়েছে গভীর সখ্যতা। মাহিনের বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুললেই যে কোন সময় চাকুরীর ক্ষেত্রে নানা ঝামেলা করার ক্ষমতা রাখে মাহিন ।
ফায়ার সার্ভিস সূত্রে আরো জানা যায়, জেলায় ঝুঁকিপূর্ণ যে সব মার্কেকের তালিকা করেছে ফায়ার সার্ভিস । নগরীর সিরাজদ্দৌল্লা রোডের সোহেল টাওয়ার, বঙ্গবন্ধু রোডের সোনার বাংলা সমবায় মার্কেট, ভুলতার গাউছিয়া মার্কেট, কালিরবাজারের সখিনা মঞ্জিল, নওয়াব প্লাজা, আলিম প্লাজা, কালিরবাজারের হক প্লাজা, সিরাজদৌল্লা রোডের সিকদার ম্যানশন, লাল মিয়া মার্কেট, সুরুজ আলী মার্কেট, কাজী ভবন, ফাতেমা টাওয়ার, ফ্রেন্স মার্কেট, এসএম মালেহ রোডের হাবিব শপিং কমপ্লেক্স, নয়ামাটির অর্চনা মার্কেট, বঙ্গবন্ধু সড়কের নুর ভিলা মার্কেট, সিরাজউদ্দোল্লা রোডের জামির আহমেদ মার্কেট, মহিম গাংগলী রোডের আল জয়নাল অলংকার প্লাজা।
এছাড়াও অগ্নি ঝুঁকিতে রয়েছে শহরের লঞ্চঘাটের ডিআইটি মার্কেট, বঙ্গবন্ধু রোডের সমবায় নিউ মার্কেট, বেলী টাওয়ার, খাজা সুপার মার্কেট, শান্তনা মার্কেট, চাষাড়ার সিটি করপোরেশন মার্কেট, লুৎফা টাওয়ার, জামান টাওয়ার, আল হাকিম সেন্টার, হক প্লাজা, দেওভোগ এল এন রোডের হৃদম প্লাজা, কালিরবাজারের শ্রী শ্রী জয় কালী মন্দির মার্কেট, এসএম মালেহ রোডের রিভার ভিউ কমপ্লেক্স, ফারজানা টাওয়ার, রিভার ভিউ কমপ্লেক্স, বিবি রোডের ডিআইটি মার্কেট, গুলশান মার্কেট, আজহার সুপার মার্কেট, মালেহ রোডের হাশেম ট্রেড সেন্টার, বিবি রোডের পানোরামা প্লাজা, সায়াম প্লাজা, কে এফ টাওয়ার, নয়ন সুপার মার্কেট, জলিল সুপার মার্কেট, গুলশান সিনেমা হল মার্কেট, নারায়ণগঞ্জ ক্লাব মার্কেট, নিউ জামির মার্কেট, এফ রহমান সুপার মার্কেট, ওয়ালী সুপার মার্কেট, দেওভোগের সোহরাওয়ার্দী মার্কেট, বিবি রোডের জনতা সুপার মার্কেট, রিয়াজ সুপার মার্কেট, করিম মার্কেট, জে এস সুপার মার্কেট, হাজী আব্দুল মোতালেব সুপার মার্কেট, হাকিম মার্কেট, বর্ষন সুপার মার্কেট, স্বপ্ননীড় ফাতেমা পয়েন্ট, আলী আহমেদ চুনকা সড়কের শেরে বাংলা মার্কেট, বিবি রোডের গ্রীন সুপার মার্কেট,ডায়মন্ড সিনেমা হল মার্কেট, বিনোদন সুপার মার্কেট ও থানা পুকুরপাড় মসজিদ মার্কেট।
শহরতলীর মার্কেট গুলোর মধ্যে রয়েছে বন্দর ফায়ার সার্ভিস রোডের সুরুজ্জামান টাওয়ার, বন্দরের এমএম শাহা রোডের শেখ গফুর প্লাজা, মোরগড়াপাড়ার আম্বিয়া মার্কেট, সোনারগাঁ শপিং কমপ্লেক্স, জালার টাওয়ার, রহমান ম্যানশন, র্যালী বন্দরের চৌধুরী প্লাজা, রূপসী বাস স্ট্যান্ডের হাজী জুলহাস ভূইয়া শপিং কমপ্লেক্স, মোগড়াপাড়া চৌরাস্তার নুর সুপার মার্কেট, আইয়ুব প্লাজা ও মেঘনাঘাটের নিউ টাউন শপিং কমপ্লেক্সসহ জেলার সকল ভবনে হাা দিচ্ছে মাহিন চক্রের সদস্যরা । এমন তালিকা তৈরী করে বিশাল বাণিজ্য নিয়ে মাঠে নেমেছ ফায়ার সার্ভিসের দূর্ণীতিবাজ চক্রটি ।
আইন অনুযায়ী দুর্ঘটনা রোধে মার্কেটের অবস্থান, ব্যবহৃত ফ্লোরের আয়তন, সাধারণ সিঁড়ির প্রশস্ততা, অগ্নিনির্বাপণ কাজে সিঁড়ির ব্যবস্থা, জরুরি প্রস্থানের সিঁড়ির সংখ্যা, প্রতি তলায় সেফটি লবির ব্যবস্থা নিশ্চিত করার কথা। এ ছাড়া ছাদে ওঠার সিঁড়ির সংখ্যা বেশি থাকা, ছাদের দরজা খোলা রাখা, বহির্গমন দরজার সংখ্যা বেশি রাখা, আন্ডারগ্রাউন্ড ওয়াটার রিজার্ভ ট্যাংক মজুদ (৫০ হাজার গ্যালন) রাখা, ১০ হাজার গ্যালনের ওভার হ্যাড ওয়াটার ট্যাংক থাকা বাধ্যতামূলক। একই সঙ্গে বৈদ্যুতিক তারে কনসিল ওয়্যারিং থাকা, বৈদ্যুতিক মেইন সুইচ বক্স ও ডিমান্ড বক্সের নিরাপদ অবস্থানে থাকা এবং প্রতি পয়েন্টে ৫ কেজি পরিমাণের সিওটু ফায়ার এক্সটিংগুইসার সংরক্ষণ করা, স্মোক ও হিট ডিটেক্টর রাখা এবং মার্কেটের ব্যবসায়ী ও কর্মীদের নিয়মিত অগ্নি দুর্ঘটনা প্রতিরোধে প্রশিক্ষণ করানোর কথা। কিন্তু এসব নিয়ম কেউ মানছেন না আর মানার জন্য আইন প্রয়োগও হচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে । এমন আইন দখিয়ে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের মালিকদেরকে ঢেকে এনে নানা ভয়ভীতি দেখিয়ে রমরমা বাণিজ্য শুরু করেছে মাহিন চক্র ।
এমন অভিযোগের বিষয়ে ফায়ার সার্ভিসের বিখ্যাত দালাল দারোয়ান রাজ্জাকের শ্যালক মাহিন উদ্দিনের মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে তিনি নারায়ণগঞ্জ নিউজ আপডেটকে বলেন, আমার এটি ব্যবসা। বিশাল বাণিজ্য করার বিষয়ে মাহিন উদ্দিন এমন তথ্য কে দিয়েছে বলে বারবার জানতে চান ।
ফায়ার সার্ভিসের অনেক সূনামের মধ্যে একজন মাহিন উদ্দিনের এমন দৌড়াত্ম সম্পর্কে জানতে নারায়ণগঞ্জ জেলা ফায়ার সার্ভিসের উপ পরিচালক আবদুল্লাহ আল আরেফিন প্রতিবেদককে বলেন, এমন অভিযোগের বিষয়টি অবশ্যই আমি খতিয়ে দেখবো।
Discussion about this post