নারায়ণগঞ্জ নিউজ আপডেট :
এখন থেকে ঠিক ৫ বছর আগের ২৭ এপ্রিল সকাল ১১ টা থেকে ১১ টা ৩০ মিনিটে নারায়ণগঞ্জ আদালত পাড়ায় পুলিশ সুপার সৈয়দ নূরুল ইসলাম, ফতুল্লা থানার ওসি আক্তার হোসেনসহ পুলিশ বাহিনীর সকলেই অবস্থান নিয়েছেন আদালতের আদেশক্রমে প্রায় কয়েক কোটি টাকার মাদকসহ জব্দকৃদ মালামাল ধ্বংস করার জন্য । পুলিশ সুপার সৈয়দ নূরুল ইসলাম আইনজীবী সমিতির সামনে সকলের সাথে খোশগল্প করার সময় দৌড়ে এসে কয়েকজন আইনজীবী ও সহকারীরা বলতে থাকে “দাড়ি টুপিওয়ালা জেএমবি দল কাউন্সিলর নজরুল কে অস্ত্র ঠেকিয়ে তুলে নিয়ে যাচ্ছে ।“
এমন খবরে ওসি আক্তার আগে এবং পিছনে এসপি সৈয়দ নূরুল ইসলাম দৌড়ে গিয়ে জানতে পারে কাউন্সিলর নজরুল ও তার সাথের লোকজন হামলাকারী দুইজনকে পাকড়াও করে কোর্ট পুলিশের কাছে হস্তান্তর করেছে ।
এ সময় সামনেই অবস্থান করা প্রতিবেদক নিজেই জানতে পারে র্যাবের দুইজন সদস্য কে আটক করে কোর্ট পুলিশের কাছে হস্তান্তর করেছে নজরুল ও তার সাথের লোকজন । পরে আটককৃতরা নিজেদের পরিচয় দিয়ে শেষ পর্যন্ত আদালত প্রাঙ্গনে থেকে বের হয়ে যায় কাউন্সিলর নজরুলের উপর হামলাকারী র্যাবের দুই সদস্য ।
র্যাবের অসাধু কর্মকর্তা ও তৎকালীন সময়ের সিদ্ধিরগঞ্জের আরেক দন্ডমূন্ডের কর্তা নূর হোসেনের গভীর পরিকল্পনায় ঘটনো য়ে সাত খুনের মতো লোমহর্ষক ঘটনা । সাত জনকে হত্যার ঘটনা যে কোন নৃসংশ হত্যাকান্ডকেও হার মানিয়েছে । লাশ উদ্ধারের পর ময়না তদন্ত চলাকালে নারায়ণঞ্জে জেনারেল হাসপাতালের মর্গের দায়িত্বরত ডোম দর্পন এমন হত্যাকান্ড দেখে আঁতকে উঠে মন্তব্য করেছে, ”আমি এতো লাশ কেটেছি এমন মার্ডার দেখি নাই ।“
গ্রেফতারকৃতদের জবানবন্দি থেকে প্রকাশ :
এ মামলায় ১৭ জন র্যাব সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁরা প্রত্যেকেই দোষ স্বীকার করে জবানবন্দি দেন। তাঁদের জবানবন্দিতেই এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায়।
র্যাবের প্রধান কার্যালয় থেকে গ্রেপ্তারের নির্দেশনা ছিল নজরুল ইসলামকে। কিন্তু তাঁকেসহ সাতজনকে আটক করার পর র্যাব-১১-র অধিনায়ক লে. কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদ ও কম্পানি কমান্ডার মেজর আরিফের নির্দেশে প্রত্যেককে হত্যা করে লাশ গুমের চেষ্টা চলে। অস্ত্র উদ্ধারের মিথ্যা তথ্য দিয়ে মেজর আরিফ র্যাব সদস্যদের অভিযানে নামিয়েছিলেন বলেও জানা যায়। পুরো ঘটনা তদারকি ও নিয়ন্ত্রণ করেন তারেক সাঈদ ও আরিফ।
যাঁরা জবানবন্দি দেন : গ্রেপ্তারের পর স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন লে. কর্নেল (বরখাস্ত) তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, কম্পানি কমান্ডার মেজর (বরখাস্ত) আরিফ হোসেন, লে. কমান্ডার (বরখাস্ত) এম এম রানা, এসআই পূর্ণেন্দু বালা, এ বি আরিফ হোসেন, নায়েক নাজিম, নায়েক দেলোয়ার, ল্যান্স নায়েক হীরা মিয়া, সৈনিক মহিউদ্দিন মুন্সী, সৈনিক আব্দুল আলিম, সৈনিক আলামিন, সিপাহি তৈয়ব, কনস্টেবল সিহাবুদ্দিন, কনস্টেবল আলামিন, হাবিলদার এমদাদ, ল্যান্স নায়েক বেলাল হোসেন, সৈনিক আসাদ, সার্জেন্ট এনামুল, এএসআই বজলু, হাবিলদার নাসির ও সৈনিক তাজুল। তারেক সাঈদ, আরিফ হোসেন ও রানা ছাড়া বাকিরা হত্যাকাণ্ডে সহযোগিতা করেছে বলে জানা যায়।
একজনের কারণে সাতজন খুন :
নজরুল ইসলামকে গ্রেপ্তারের নির্দেশ ছিল র্যাব সদর দপ্তরের। তাঁকে আটকের দৃশ্য অ্যাডভোকেট চন্দন সরকারসহ অন্যরা দেখে ফেলেন। এ কারণে ভীত হয়ে নজরুলসহ সবাইকে হত্যা করা হয়। মেজর আরিফসহ আসামিরা জবানবন্দিতে বলেছেন, নজরুল মেজর আরিফকে চিনে ফেলায় তাঁকে খুনের সিদ্ধান্ত হয়। পরে অন্যদেরও হত্যা করা হয়। আরিফ তাঁর জবানবন্দিতে বলেন, ‘সিও স্যারকে রিপোর্ট করলে তিনি জানান, কোনো প্রত্যক্ষদর্শী রাখা যাবে না। সাতজনকেই গুম করে ফেল। এ আদেশ পেয়ে সবাইকে খুন করে লাশ গুম করা হয়।’
নজরুল ও অন্যদের আটকের আগে ব্রিফিং :
আসামি ল্যান্স নায়েক মো. হীরা মিয়া জবানবন্দিতে বলেন, নজরুল ইসলাম ও চন্দন সরকারসহ সাতজনকে আটকের আগে র্যাব-১১-র আদমজীনগর ক্যাম্পে র্যাব সদস্যদের জড়ো করে একটি ব্রিফিং দেন মেজর আরিফ। সেখানে মেজর আরিফ বলেন, ‘একটি অস্ত্র উদ্ধার অভিযানে যাব। সেখানে অস্ত্র আছে। গোলাগুলি হতে পারে। খুব হুঁশিয়ার থাকবে। আমার কথা ছাড়া কেউ গাড়ি থেকে নামবে না এবং অন্য কারো সঙ্গে কথা বলবে না।’ হীরা মিয়ার এই বক্তব্য সমর্থন করে জবানবন্দি দেন সিপাহি আবু তৈয়ব। তিনি বলেন, ‘স্যার (মেজর আরিফ) বলেন যে আমরা একটি জরুরি অস্ত্র অপারেশনে যাচ্ছি। কিছু সন্ত্রাসী প্রকৃতির লোক আছে। তাদের কাছে সব সময় অস্ত্র থাকে। খুব দুর্ধর্ষ। সাবধান থাকবা। ওরা গুলি করতে পারে। কেউ আমার কথার বাইরে কোনো কাজ করবা না। যে এ রকম চেষ্টা করবে তাদের নাম খরচের খাতায় লিখে দেব। এরপর অভিযানে যাওয়ার জন্য গাড়ি (মাইক্রোবাস) ছাড়ে।’ একই ধরনের জবানবন্দি দেন অন্য আসামিরাও।
মেজর আরিফ অস্ত্র উদ্ধারের কাহিনী বলে র্যাব সদস্যদের নিয়ে অভিযানে যান। নজরুলসহ সাতজনকে আটকও করা হয়। কিন্তু কারো কাছে অস্ত্র পাওয়া যায়নি ।
যেভাবে অপহরণ, হত্যা ও লাশ গুম :
এ মামলায় সিপাহি আবু তৈয়ব ও হাবিলদার এমদাদও আসামি। আবু তৈয়ব জবানবন্দিতে বলেন, ‘ঘটনার দিন র্যাব কার্যালয় থেকে দুটি গাড়ি নিয়ে তাঁরা সাইনবোর্ড এলাকা হয়ে নারায়ণগঞ্জের দিকে যান। অনুমান সকাল ১১টার দিকে নারায়ণগঞ্জ কোর্টের সামনে আসার পর আরিফ স্যার জিজ্ঞাসা করেন আমরা কেউ কমিশনার নজরুলকে চিনি কি না। উত্তরে না বললে তিনি নজরুলের একটি ছবি দেখান। এরপর গাড়িটি ইউটার্ন নিয়ে ১০০ গজ সামনে নিয়ে রাখা হয়। সেখানে আমাকে ও হাবিলদার এমদাদকে নামিয়ে দিয়ে কোর্টে যেতে বলেন তিনি।’
আবু তৈয়ব জবানবন্দিতে আরো বলেন, ‘আমরা কোর্ট চিনি না জানাতে আরিফ স্যার ধমক দেন। বলেন কোর্ট খুঁজে নিয়ে দোতলায় যাবা। সেখানে নজরুল আছে। বের হলেই খবর দিবা। আমরা কোর্টে গিয়ে নজরুলকে দেখি। আরিফ স্যারকে জানাই। তিনি ফলো করতে বলেন। নজরুলের লোকজন আমাদের সন্দেহ করে। ধরে পুলিশে দেয়। আমরা পুলিশকে র্যাব পরিচয় জানাই। বলি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে আমরা ডিউটি করতে এসেছি। আমাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। আমি বিষয়টি আরিফ স্যারকে জানাই। স্যার আমাকে গালিগালাজ করেন এবং সেখান থেকে চলে যেতে বলেন। পরে ল্যান্স নায়েক বেলালকে কোর্টে পাঠান। বিকেল ১টার দিকে আরিফ স্যারের মোবাইলে কল আসে। আমরা গাড়ি নিয়ে রেডি হই। দুটি প্রাইভেট কারের পেছনে পেছনে আমরা ছুটি। এক পর্যায়ে সিগন্যাল দিলে কার দুটি থেমে যায়। দুই গাড়ি থেকে সাতজনকে আমরা আমাদের মাইক্রোবাসে তুলি।’
মেজর আরিফ সাতজনকে আটক করার পর বিষয়টি প্রকাশ না করে তাঁদের হত্যা করতে অধীনস্থ সদস্যদের নির্দেশ দেন। সাতজনকে খুন করার আগে চেতনানাশক ইনজেকশন পুশ করা হয় এবং তাঁদের মেরে ফেলার নির্দেশ দিয়ে তা পালনে বাধ্য করেন। ইনজেকশন পুশ করার পর অপহৃত সাতজনকে নেওয়া হয় ল্যান্ডিং ঘাটে (কাঁচপুর সেতুর কাছে বিআইডাব্লিউটিএর ল্যান্ডিং স্টেশন)। সেখানে পৌঁছার পর সাতজনের মুখে পলিথিন পেঁচানোর নির্দেশ দেন মেজর আরিফ। তিনি নিজেই পলিথিন পেঁচাতে থাকেন এবং ল্যান্স নায়েক হীরা মিয়াকেও এ কাজ করতে বলেন। কিন্তু হীরা মিয়া আপত্তি জানান। এ সময় মেজর আরিফ পিস্তল বের করে তাঁকে হত্যার হুমকি দেন, উত্তেজিত হয়ে গালাগাল করেন। এরপর হীরা মিয়া, ল্যান্স নায়েক বেলাল হোসেন, এসআই পূর্ণেন্দু বালা ও সিপাহি তৈয়ব অপহৃতদের মুখে পলিথিন পেঁচান। এরপর তাঁদের লাশ এবং সেখানে আগে থেকে প্রস্তুত রাখা ইটভর্তি বস্তা ট্রলারে ওঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু র্যাব সদস্যরা এ কাজে আপত্তি জানান। এ সময়ও মেজর আরিফ পিস্তল বের করে গালি দিয়ে বলেন, ‘…তাড়াতাড়ি এগুলো ট্রলারে ওঠা। তা না হলে এদের মতো তোদেরও অবস্থা হবে।’ এরপর সাতজনের লাশ ও ইটের বস্তা ট্রলারে তোলা হয়। রাত আড়াইটার দিকে মেজর আরিফের নির্দেশে শীতলক্ষ্যা নদীতে লাশগুলো ফেলে দেওয়া হয়। আসামি আবু তৈয়বসহ অন্যরা তাঁদের জবানবন্দিতে এ তথ্য জানান।
র্যাব সদস্য আরওজি-১ মো. আরিফ হোসেন জবানবন্দিতে বলেন, ‘লাশ নদীতে ফেলার আগে আরিফ স্যার পিস্তল বের করে হুমকি দিয়ে বলেন, দুই মিনিটের মধ্যে লাশগুলোর সঙ্গে দুটি করে বস্তা বেঁধে নদীতে ফেলতে হবে।’
সিপাহি আসাদুজ্জামান নূর জবানবন্দিতে বলেন, লাশ গুম করার আগে রাস্তায় পাহারা দিতে ও মাইক্রোবাস থেকে ইটের বস্তা নামানোর সময় মেজর আরিফ স্যার রাগারাগি করেন। বলেন, ‘সব কিছু কি আমি একা করব? তোরা কাজ না করলে তোদেরও গুলি করে মারব।’
আসামিদের স্বীকারোক্তি থেকে আরো জানা যায়, সাতজনের লাশ নদীতে ফেলার পর র্যাব সদস্যদের ফলইন করানো হয়। তখন সবাইকে উদ্দেশ করে লে. কর্নেল (বরখাস্ত) তারেক সাঈদ বলেন, ‘… তোমরা যা দেখেছ বা যা করেছ তা সব আমাদের নির্দেশেই করেছ। এ বিষয়ে কাউকে কিছু বলবে না। যদি বলো, তাহলে পরিণতি ভয়াবহ হবে। ভয় নেই। তোমাদের কিছু হবে না।’ এরপর র্যাব-১১-র অভিযানে অংশ নেওয়া সদস্যদের কার্যালয়ের বাইরে যাওয়া বন্ধ করে দেওয়া হয়।
তারেক সাঈদ জবানবন্দি :
আমি র্যাব-১১-র কমান্ডার হিসেবে ২০১৩ সালের নভেম্বরে যোগদান করি। র্যাবের তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রে র্যাব সদর দপ্তরের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। গত মার্চ মাসে (২০১৪ সাল) অধিকারকদের মাসিক সম্মেলন শেষে আমাকে সন্ত্রাসীদের একটি তালিকা দেওয়া হয়। ওই তালিকায় নজরুলের নামও বিশেষভাবে চিহ্নিত ছিল। যার অর্থ নজরুলকে গ্রেপ্তারের পর তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য র্যাব হেডকোয়ার্টারে পাঠাতে হবে। অধিকারকদের সম্মেলনের পরের দিন আমি র্যাব-১১-র কম্পানি কমান্ডারদের সম্মেলনে মেজর আরিফকে নজরুলকে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দিই। ওই সম্মেলনেই আমি লে. কমান্ডার রানাকে (মাসুদ রানা) নজরুলের গ্রেপ্তারের বিষয়ে মেজর আরিফকে সাহায্য করতে বলি।’
সাতজনকে অপহরণের দিন রাতে নজরুলের স্বজনরা তারেক সাঈদের কাছে যান। নজরুলের স্ত্রী তারেককে জানান, তাঁর স্বামীকে নূর হোসেনের লোকজন অপহরণ করে নিয়ে গেছে। ওই সময় লে. কমান্ডার মাসুদ রানা উপস্থিত হন। তারেক সাঈদ তখন মাসুদ রানাকে বলেন, ‘নূর হোসেনকে ধরে আনো।’ র্যাব নজরুলসহ সাতজনকে বিকেলে আটক করে এবং এ কথা তারেক সাঈদ নজরুলের স্বজনদের কাছে গোপন করেন। এরপর রাতে একে একে হত্যা করা হয় সাতজনকে। হত্যার পর লাশ গুমের জন্য প্রত্যেকের পেট কেটে বস্তাবন্দি করে ইট বেঁধে শীতলক্ষ্যা নদীতে ফেলে দেওয়া হয়।
লে. কমান্ডার মাসুদ রানা জবানবন্দি :
‘অধিনায়ক তারেক সাঈদের নির্দেশে এপ্রিলের ১৪/১৫ তারিখে নজরুলকে গ্রেপ্তারের জন্য অভিযান পরিচালনা করি। কিন্তু নজরুল পালিয়ে যাওয়ায় তাঁকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি। গ্রেপ্তারের নির্দেশের সময় তারেক সাঈদ বলেন, নজরুল গ্রেপ্তারের পর আইনি বিষয়টি দেখা হবে।’ মাসুদ রানা আরো বলেন, ‘সাতজনকে আটকের পর তিনি অধিনায়ক তারেক সাঈদকে জানান, আটককৃতদের মধ্যে একজন আইনজীবী রয়েছেন। অধিনায়ক তাঁকে বলেন, ঠিক আছে। পরে দেখা যাবে।’ মাসুদ রানা জবানবন্দিতে বলেন, সাতজনকে হত্যার পর তিনি মেজর আরিফকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘এটি কী করেছেন?’ মেজর আরিফ তাঁকে বলেন, ‘যা করেছি সিও (তারেক সাঈদ) স্যারের নির্দেশে করেছি।’
র্যাব-১১-র কমান্ডার মেজর মো. আরিফ হোসেনকে গত বছর ২২ মে গ্রেপ্তার করা হয়। তিনি ৪ জুন জবানবন্দি দেন। তিনি জবানবন্দিতে বলেন, ‘সিও তারেক সাঈদ আমাকে নজরুলকে টার্গেট হিসেবে দেন। তাঁকে ধরার জন্য সোর্স হিসেবে নূর হোসেনকে ব্যবহার করি। এরপর তিনি ও লে. কমান্ডার রানা একাধিকবার নজরুলকে আটকের চেষ্টা করেন। সর্বশেষ ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল সকালে নূর হোসেনের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে নারায়ণগঞ্জ আদালতে অভিযান পরিচালনা করেন র্যাব-১১-র সদস্যরা। অস্ত্র উদ্ধারের কথা বলেই মেজর আরিফ র্যাবের অপরাপর সদস্যদের অভিযানে নামিয়েছিলেন। এ জন্য নম্বরবিহীন দুটি গাড়ি ব্যবহার করা হয়। নজরুল যাতে পালিয়ে যেতে না পারেন সে জন্য রাস্তায় পাহারা বসানো হয়। র্যাবের উপস্থিতি জানাজানি হয়ে গেলে নজরুল আদালত থেকে তাঁর দলবল নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। কিন্তু তিনি র্যাবের চোখ ফাঁকি দিতে পারেননি। তাঁর গাড়ির পেছনেই র্যাবের গাড়ি ছুটে চলে। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ফটকের কাছে নজরুলের গাড়ি পৌঁছালেই তাঁকে গাড়ি থেকে টেনেহিঁচড়ে বের করা হয়। সঙ্গে নজরুলের সঙ্গীসহ গাড়িচালককে র্যাবের গাড়িতে তোলা হয়। পেছনে আসা আরেকটি প্রাইভেট কার থেকে নেমে চন্দন সরকার চিৎকার করতে থাকেন। লে. কমান্ডার রানার নেতৃত্বে র্যাব সদস্যরা চন্দন সরকার ও তাঁর গাড়িচালককে আটক করে রানার মাইক্রোবাসে তুলে নেন। তারাব পৌঁছে আমি সিও তারেক সাঈদকে ফোনে রিপোর্ট করি যে নজরুলসহ সাতজনকে আটক করা হয়েছে। সিও স্যার বলেন, কোনো প্রত্যক্ষদর্শী রাখা যাবে না। সাতজনকেই গুম করে ফেল।’ এরপরের ঘটনা সবার জানা।
যে কারণে খুন :
বিপুল পরিমাণ অর্থ ও সম্পদের বিনিময়ে নজরুল ইসলামকে গুম করার পরিকল্পনা করেন র্যাব-১১-র অধিনায়ক কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদ ও কমান্ডার মেজর মো. আরিফ হোসেন। তাঁরা দুজনই নূর হোসেনের টাকায় ঢাকায় ফ্ল্যাট কেনেন। চাঞ্চল্যকর সাত খুন মামলার অভিযোগপত্র (চার্জশিট) ও আসামিদের দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।
নূর হোসেনের সঙ্গে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল কমান্ডার মেজর আরিফের। কর্নেল তারেক সাঈদের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠতা ছিল। তাঁরা প্রায়ই নূর হোসেনের কার্যালয়ে যেতেন। নজরুল ইসলাম ও নূর হোসেন দুজনই নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের নির্বাচিত কাউন্সিলর ছিলেন। দুজনই একই ধারার রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। নজরুল প্যানেল মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর সিদ্ধিরগঞ্জ বিদ্যুৎকেন্দ্র ও ইপিজেডের ঠিকাদারি কাজ পাওয়াসহ বিভিন্ন বিষয়ে তাঁদের মধ্যে দ্বন্দ্ব প্রকট হয়ে ওঠে। এ জন্য নজরুলকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য নূর হোসেন র্যাবকে কাজে লাগায়।
লে. কর্নেল তারেক সাঈদের স্বীকারোক্তি থেকে জানা যায়, ঘটনার পর তাঁকে ও মেজর আরিফকে র্যাব প্রধান কার্যালয়ে ডাকা হয়। এ সময় আরিফ স্বীকার করেন তিনি ঢাকায় একটি ফ্ল্যাট কিনেছেন। ফ্ল্যাটের টাকা নূর হোসেনের মাধ্যমে জমা দেওয়া হয়।
মেজর আরিফও তাঁর স্বীকারোক্তিতে নূর হোসেনের টাকা নেওয়ার বিষয়ে ইঙ্গিত দিয়েছেন। কিন্তু অঙ্ক উল্লেখ করেননি।
নূর হোসেনের সহযোগী এ মামলার আসামি রহম আলী তাঁর দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেন, ‘মেজর আরিফ প্রতিমাসে নূর হোসেনের কাছ থেকে ১০ লাখ করে টাকা নিতেন।’
শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত যোগাযোগ নূর হোসেনের সঙ্গে : মামলার চার্জশিটে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল সাত খুনের ঘটনা ঘটে। ৬ এপ্রিল থেকে ওই পর্যন্ত মোবাইল ফোনে মেজর আরিফের কথা হয় নূর হোসেনের সঙ্গে। শুধু ঘটনার দিন নূর হোসেন পাঁচবার ও মেজর আরিফ পাঁচবার একে অপরকে ফোন দেন। নূর হোসেনের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ রক্ষা ছাড়াও মেজর আরিফ বারবার যোগাযোগ করেন লে. কর্নেল তারেক ও মাসুদ রানার সঙ্গে।
চার্জশিটে আরো বলা হয়, নূর হোসেন ঘটনার দিন মেজর আরিফ, তারেক সাঈদ ও মাসুদ রানার মোবাইলে দুবার এসএমএস পাঠিয়ে তাঁদের অফিশিয়াল মোবাইল বহন না করতে সতর্ক করেন। তাঁদের প্রত্যেকের সঙ্গেই নূর হোসেনের সার্বক্ষণিক যোগাযোগ ছিল।
Discussion about this post