গৌতম সাহা :
হারিয়ে যাওয়া বাংলার ঐতিহ্যবাহী মসলিন শাড়ি এখনো তৈরি হচ্ছে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ নোয়াপাড়ায়। দেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বিক্রি হচ্ছে নানা ডিজাইনের এই মসলিন শাড়ি। আর এটি নতুন করে বাংলাদেশের মধ্যে একমাত্র আল আমিন তাঁতি তৈরি করছেন দাবি তার। এই মসলিন শাড়ির ঐতিহ্য ধরে রাখতে স্বপ্ন বুনছেন এই তাঁতি। এটি সম্প্রসারণে সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা তার। মসলিন নিয়ে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে থাকতে চান তিনি।
জানা যায়, আঠারো শতকের শেষার্ধে বাংলায় মসলিন তৈরি বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে এই মসলিন পুনরুদ্ধারে ২০১৮ সালে সরকারিভাবে প্রকল্প চালু করা হলেও বর্তমানে সেটি বন্ধ রয়েছে। শীতলক্ষ্যা নদীর আবহাওয়ায় মসলিন শাড়ি তৈরি ভালো হয়। এক সময় এই নদীর পাড়েই গড়ে উঠেছে এই মসলিন শাড়ি। আর এই মসলিন শাড়ি এখন তৈরি করছেন নদীর তীরবর্তী নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার নোয়াপাড়া বিসিক জামদানি পল্লি এলাকার আল আমিন তাঁতি (কারিগর)।
তার প্রতিষ্ঠান ঘুরে দেখা গেছে, সেখানে ‘বেঙ্গল মসলিন কেন্দ্র’ নামে ছোট্ট একটি কক্ষে মসলিন কাপড়ের ইতিহাসসহ মসলিন কাপড়ের তৈরি রুমাল ও কাপড়ের প্রদর্শনী করা হয়েছে। আর সেখানেই তৈরি করছেন এই মসলিন শাড়ি। ৩০০ থেকে ৪০০ কাউন্টের সুতা দিয়ে এ পর্যন্ত ৯টি মসলিন শাড়ি তৈরি করেছেন বলে দাবি করেন তিনি।
আরও জানা যায়, ২০১৩ সালে বাংলাদেশ দৃক গ্যালারির সিইও সাইফুল ইসলামেরর মাধ্যমে অনেক তাঁতিকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। এটি কষ্টসাধ্য হওয়ায় কোনো তাঁতি সে সময় সফল হতে পারেনি। ওই সময় ভারতের মুর্শিদাবাদ থেকে সাইফুল ইসলাম আল আমিনের কাছে চিকন সুতা নিয়ে আসেন এবং মসলিন শাড়ি বোনার কথা বলেন। এরপর ফুটি কার্পাস তুলা থেকে তৈরি হওয়া সুতা দিয়ে চেষ্টা শুরু হয় তার। তবে সূক্ষ্ম সুতা ও আর্দ্রতার কারণে সুতা ছিড়ে যাওয়ায় শাড়ি বুনতে বারংবার বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছে তাকে। এতো ঝামেলার কারণে অনেকে মসলিন শাড়ি তৈরির কাজ বন্ধ করার পরামর্শও দিয়েছিল। তারপরও তিনি ধৈর্য্য ধরে চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। অবশেষে কয়েকবার চেষ্টা চালিয়ে একটি মসলিন শাড়ি তৈরি করতে সফল হন তিনি। ৩০০ কাউন্টের সুতা দিয়ে শাড়িটি তৈরি করা হয়। আল আমিনের হাতে তৈরি প্রতিটি শাড়ির দৈর্ঘ্য ৬ গজ এবং প্রস্থ ৪৭ ইঞ্চি এবং ওজন প্রায় আড়াইশ গ্রাম। যা একটি আংটির ভিতরে অনায়াসে আনা নেওয়া করা যায়। শাড়ির ডিজাইন ও সুতার কাউন্টের ওপর নির্ভর করে দাম কম-বেশি হয়ে থাকে। তবে আনুমানিক প্রত্যেকটি শাড়ি তৈরিতে ৩ থেকে ৪ লাখ টাকা খরচ হয়।
মসলিন শাড়ি তৈরির কাজ কিভাবে শুরু করলেন এ প্রসঙ্গে আল আমিন তাঁতী বলেন, মসলিন শাড়িটি তো প্রায় ২০০ বছর আগে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এর কোনো তাঁতি আর ওস্তাদ কেউই বেঁচে নাই। ছোট থাকতেই আমি জামদানি শাড়ির কাজ করি। জামদানির ভিতর ভালো মন্দ কাজ আছে। আমি সব সময় ভালো কাজটাই করতে পছন্দ করি। যখন মসলিনের কাজ করার অর্ডার আসলো তখন থেকেই এটি নিয়ে কাজ করার প্রবল ইচ্ছা হলো। একটি মসলিন শাড়ি তৈরি করতে যখন সফল হলাম এবং আমাকে পুরস্কৃত করা হলো, তখন থেকেই আমার ভিতর ইচ্ছাশক্তি আরও বেড়ে গেল। এটা নিয়ে আমাকে আরও সামনে এগিয়ে যেতে হবে।
তিনি আরও বলেন, ২০১৩ সালে মসলিন শাড়ি তৈরির কাজ শুরু করি। ওই সময় বাংলাদেশ দৃক গ্যালারির সিইও সাইফুল ইসলামের মাধ্যমে অনেক তাঁতীকে প্রশিক্ষণদেওয়া হয়েছিল। এটি কষ্টসাধ্য ও কঠিন হওয়ায় তখন কোনো তাঁতীই সফল হতে পারেনি। যখন আমার কাছে মসলিনের চিকন সুতা নিয়ে আসেন তিনি। দৃক গ্যালারির সাইফুল ইসলাম সর্বপ্রথম ভারতের মুর্শিবাদের এই ৩০০ ও ৪০০ কাউন্টের সুতার সন্ধান দিয়েছিলেন। সেখান থেকে ৩০০ কাউন্টের সুতা ১৫ হাজার রুপি ও ৪০০ কাউন্টের সুতা ২০ হাজার রুপি দিয়ে কিনে আনা হয়। আমি ছয় মাস চেষ্টার সময় সূক্ষ্ম সুতা ও আর্দ্রতার কারণে সুতা ছিড়ে যাওয়ায় শাড়ি বুনতে আমার বারংবার বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছে। অনেকেই তখন কাজটি ছেড়ে দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিল। কিন্তু আমি চেষ্টা চালিয়ে গেছি এবং একটি মসলিন শাড়ি তৈরি করতে সফল হই। এই তৈরি মসলিন শাড়ি ২০১৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকার শাহবাগের জাদুঘরে এক্সিবিশন করা হয় এবং আমাকে সেখানে পুরস্কৃত করা হয়। তখন ওই অনুষ্ঠানে আসা দেশ-বিদেশের অনেক লোকজনের কাছে থেকে বহু শাড়ির অর্ডার পেয়েছি। কিন্তু একটি শাড়ি তৈরিতে যেহেতু ৯ মাস লেগে যায় তাই অর্ডার নেওয়া সম্ভব হয়নি। তারপরও ধারাবাহিকভাবে আমি এই মসলিন শাড়ি নিয়ে আছি এবং এটি নিয়েই থাকবো। দেশের বাইরে অনেক চাহিদা রয়েছে এটির।
দেশের বাইরে এই মসলিন শাড়ির চাহিদা প্রসঙ্গে আল আমিন তাঁতী বলেন, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, ভারত ও সিঙ্গাপুর এসব দেশ থেকে অনেক অর্ডার পেয়েছি। বিশেষ করে ইংল্যান্ডে বেশি চায় এই মসলিন শাড়িগুলো। এখন পর্যন্ত ৩০০ কাউন্টের ৯টি মসলিন শাড়ি তৈরি করা হয়েছে। এর মধ্যে ২ পিছ ৪০০ কাউন্টের তৈরি করা হয়েছে। এই মসলিন ৫-৬ লাখ টাকায় বিক্রি করেছি। বাংলাদেশ সহ বহির্বিশ্বে আমার তৈরি মসলিন শাড়ি বিক্রি করেছি এবং আরও বিক্রির কথা চলছে। বাংলাদেশে বর্তমানে আমি ছাড়া কেউ এই মসলিন শাড়ি তৈরি করতে পারে না। এক সময় সরকারি প্রকল্প ছিল। কিছুদিন চলছিল, বর্তমানে সেটি বন্ধ আছে। বাংলাদেশের রূপগঞ্জের ভিতরে আমি একা, আর কেউ পারেন না।
সরকারি সহযোগিতা প্রসঙ্গে আল আমিন বলেন, সরকারিভাবে আমি মসলিন নিয়ে এখনো কোনো সহযোগিতা পাইনি। ‘সাধারণত ২৫০ কাউন্ট থেকে শুরু করে ১২০০ কাউন্টের সুতা দিয়ে মসলিন শাড়ি তৈরি হয়ে থাকে। সরকারিভাবে মসলিনের জন্য ৭০০ কাউন্ট সুতা তৈরি হয়েছে। সে বিষয়ে আমার সঙ্গে তাদের কথা হয়েছে। এখন যদি সরকারের কাছ থেকে এই ৭০০ কাউন্টের সুতা পাই তাহলে মসলিন তৈরি করতে পারবো। যা বাংলাদেশের জন্য একটা গর্বের বিষয়। আসলে এটি তৈরি কষ্টসাধ্য ও ধৈর্য্য লাগে তাই এই কাজ করতে কেউ আসতে চায় না। আমার অধীনে বর্তমানে একজন কারিগরকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। তার সঙ্গে একজন সহযোগীও রয়েছে। তারা আমার সাথে কাজ করছেন।
আসন্ন ঈদে মসলিন শাড়ি বিক্রির সম্ভবনা প্রসঙ্গে আল আমিন বলেন, ঈদের ভিতর ৪-৫টা মসলিন শাড়ি বিক্রির জন্য আমার সঙ্গে কথা চলছে। আশা করি এবার ঈদে প্রায় ২৫ লাখ টাকার মসলিন শাড়ি বিক্রি হবে। ঈদের পর থেকে ৫০০ কাউন্ট দিয়ে শাড়ি তৈরি করা শুরু করবো। সব মিলিয়ে বছরে প্রায় ৫০ লাখ টাকার শাড়ি বিক্রি করে থাকি।
আল আমিন বলেন, আমরা ইতিহাসে শুনেছি মসলিনের যে কারিগর ছিল তার হাত কেটে ফেলছে। এখন কারিগরও নেই এবং ওস্তাদও নেই। শত শত বছর আগে একটা ইতিহাস ছিল এবং এটি চলে গেছে। বাংলাদেশের একটা গর্ব এই মসলিন শাড়ি নিয়ে আবার একটা ইতিহাস হোক। নিজে নিজে চেষ্টা থেকেই যেহেতু আমি কাজ করতে পেরেছি। তাই আমি চাই এই মসলিন শাড়িটি দিয়ে বাংলাদেশে ইতহাস ধরে রাখতে। এখনো আমি চিন্তা করি মসলিন আরও কিভাবে ভালো হয় এবং আরও কিভাবে সূক্ষ্ম করা যায়। এখনো আমি এটা নিয়ে স্বপ্ন দেখছি এবং ভাবছি। যাতে করে বাংলাদেশে আরেকটি ইতিহাস হোক।
এই মসলিনের ঐতিহ্য ধরে রাখতে এবং সম্প্রসারণে করণীয় প্রসঙ্গে আল আমিন বলেন, এই মসলিন নিয়ে সরকারিভাবে বড় আকারে অনেক তাতীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা যায়। যেহেতু এটি এক সময় শীতলক্ষ্যা নদীর পাড়ে গড়ে উঠেছিল। এই রকম একটি জায়গায় যেখানে প্রচুর গাছ আছে তেমন জায়গায় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। কারন এই মসলিন তৈরির জন্য একটা আদ্রতা ও ঠান্ডা আবহাওয়ার ব্যাপার রয়েছে। যদি সরকারিভাবে বড় জায়গা দেওয়া যায় এবং তাতীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া যায় তাহলে এই মসলিন সম্প্রসারণ করা সম্ভব। এ ব্যপারে আমি সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করছি। সরকারি সুযোগ-সুবিধা পেলে মসলিন শাড়ি তৈরির শিল্পকে বাণিজ্যিকভাবে বিপ্লব ঘটানো সম্ভব।
রুপগঞ্জ বিসিকের একাধিক তাতী ও স্থানীয় বাসিন্দা জানায়, বই পুস্তকে আমরা মসলিন শাড়ি সম্পর্কে জেনেছি। কিন্তু এটি একমাত্র আল আমিন তাঁতির কাছ থেকে দেখেছি। ওনিই এখন একমাত্র মসলিন তৈরি করছেন। আল আমিন তাঁতি আমাদের গর্ব। এটি তৈরি করতে কষ্টসাধ্য ও অনেক ধৈর্য্যের প্রয়োজন হয় তাই কেউ কাজ করতে চায় না। একমাত্র আল আমিন তাতীই এই মসলিনের কাজ ধরে রেখেছে। আমাদের দাবি থাকবে তাকে যেন সরকারের পক্ষ থেকে সহযোগিতা করে এই মসলিনের সম্প্রসারণ করে দেশের হারানো ঐতিয্য ধরে রাখে।
মসলিন শাড়ি বর্তমানে শুধুমাত্র নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে তৈরি করা হয়। এর মধ্যে সরকারিভাবে গড়ে ওঠা মসলিন শাড়ি তৈরির প্রকল্প বন্ধ হয়ে গেছে।
এ প্রসঙ্গে নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক মাহমুদুল হক বলেন, আমরা সরকারি পৃষ্টপোষকতায় মসলিন শিল্পীর সংখ্যা বাড়ানোর চেষ্টা করছি। যাতে বাংলাদেশে এই ঐতিহ্যবাহী মসলিন শিল্পটা বৃদ্ধি পায় এবং এটা ফিরিয়ে আনতে পারে। আল আমিন এবং তার সঙ্গে আরও কয়েকজন এই মসলিন তৈরিতে কাজ করেন। অবশ্যই আমরা আল আমিনকে সরকারিভাবে সহযোগিতা করবো। সরকারিভাবে ঋণের ব্যবস্থা করবো। এই শিল্পটাকে প্রসার করার জন্য অবশ্যই আমরা কাজ করবো।
তিনি বলেন, মসলিন সম্প্রসারণের জন্য একটি সরকারি প্রকল্প করা হয়েছিল। ইতোমধ্যে এই প্রকল্প পরিচালকের সঙ্গে কথা হয়েছে। তাদের টেকনিক্যাল সাপোর্ট ও জেলা প্রশাসকের আর্থিক সহযোগিতায় এটি সম্প্রসারণে কাজ করে যাবো আমরা।
মাহমুদুল হক আরও বলেন, আমরা যখন রূপগঞ্জের বিসিকে পরিদর্শনে গিয়েছি তখন দেখলাম আল আমিনের তৈরি একটি মসলিন শাড়ি একটি আংটির ভিতর দিয়ে অনায়াসে প্রবেশ করানো যায়। যা একসময় আমরা বই পুস্তকে পড়েছি। এটি দেখে বিষয়টি সত্যিই আমাদের বিমোহিত করেছে।
সূত্র : কালবেলা
Discussion about this post