রূপগঞ্জে আরআইসিএল রোলিং কারখানায় লোহার ভাট্টি বিস্ফোরণে পাঁচজন শ্রমিক নিহতের পর কারখানার গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। বিস্ফোরণের কারণ তদন্তে গঠন করা হয়েছে তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি।
শুক্রবার বিকেলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফয়সাল হকের নেতৃত্বে উপজেলা প্রশাসন ওই কারখানা পরিদর্শনে গিয়ে গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে।
তদন্ত কমিটিতে আহবায়ক করা হয়েছে ভুলতা পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ ইন্সপেক্টর মুস্তাফিজুর রহমানকে, সদস্য সচিব করা হয়েছে কাঞ্চন ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের স্টেশন অফিসার মো. রফিকুল ইসলামকে এবং সদস্য করা হয়েছে নারায়ণগঞ্জ পল্লী বিদ্যুৎ-২ এর প্রকৌশলী আলতাফ হোসেনকে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফয়সাল আলম বলেন, কারখানা কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব অবহেলার কারণে এ দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিস্ফোরণের পর তিন ঘণ্টা পার হয়ে গেলেও ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার জন্য কারখানা কর্তৃপক্ষ স্থানীয় প্রশাসন ও ফায়ার সার্ভিসকে অবহিত করেনি।
তিনি জানান, কারখানা কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দেখাতে না পারায় তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার আগ পর্যন্ত এবং সরকারি সিদ্ধান্ত না হওয়া পর্যন্ত গ্যাস এবং বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন থাকবে।
কারখানার কয়েকজন শ্রমিক জানান, তিন মাস আগে কারখানাটি চালু করা হয়। কারখানাটিতে বর্তমানে ২০-২৫ জন শ্রমিক কাজ করছে। তবে কারখানার ভেতরে কোনও প্রকার অগ্নিনির্বাপন সামগ্রী রাখা হয়নি। কাজ করার জন্য শ্রমিকদের দেওয়া হয়নি কোনও প্রকার সুরক্ষা সামগ্রী।
শ্রমিকরা জানান, তারা মালিকপক্ষকে অগ্নিনির্বাপন ব্যবস্থা ও ঝুকিপূর্ণ কাজের সুরক্ষা সামগ্রী প্রদান করার কথা বলে আসলেও মালিকপক্ষ তাদের কথায় কর্নপাত করেনি।
রূপগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এএফএম সায়েদ বলেন, এখন পর্যন্ত নিহতদের পরিবারের পক্ষ থেকে কেউ কোন ধরনের লিখিত অভিযোগ দেননি। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারদের পক্ষ থেকে অভিযোগ না দিলে পুলিশ বাদী হয়ে এই ঘটনায় দোষীদের অভিযুক্ত করে মামলা করা হবে।
বৃহস্পতিবার বিকেল তিনটার দিকে গোলাকান্দাইল ইউনিয়নের সাওঘাট এলাকায় রাহিমা ইন্ডাস্ট্রিয়াল কোম্পানি লিমিটেড (আরআইসিএল) কারখানায় ভাট্টি বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে।
এসময় ঘটনাস্থলেই মারা যান এক শ্রমিক। দগ্ধ আরো ছয়জনকে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন এন্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনসটিটিউটে ভর্তি করা হলে সেখানে আরো চার জন শ্রমিকের মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় এখনও চিকিৎসাধীন দুই জনের অবস্থাও আশঙ্কাজনক।
তথ্য সূত্রে জানা যায়, কারখানা কর্তৃপক্ষ গত বছর লোহা গলানো ও তৈরির অনুমতি চেয়ে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের কাছে দুই দফা আবেদন করে। অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা দুইবার পরিদর্শন করে এবং নির্দেশ দিয়েও শ্রমিকদের যথাযথ নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য কর্তৃপক্ষকে বাধ্য করাতে পারেনি।
অনুমতি ছাড়াই ছয় মাস ধরে উৎপাদনে থাকা কারখানাটির চুল্লিতে বৃহস্পতিবার বিকট বিস্ফোরণে পাঁচ শ্রমিককে প্রাণ দিতে হয়েছে।
বিস্ফোরণের পর কারখানা কর্তৃপক্ষ ‘রহস্যজনক কারণে’ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স এবং পুলিশ প্রশাসনকে খবর দেয়নি বলে অভিযোগ উঠেছে। এমনকি সেখানে অগ্নিনির্বাপণের কোনো ব্যবস্থাও দেখতে পাননি ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা।
এসব ব্যাপারে জানতে চাইলে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর নারায়ণগঞ্জ জেলা কার্যালয়ের উপ মহা পরিদর্শক রাজীব চন্দ্র দাস শুক্রবার গণমাধ্যম কে বলেন, “নিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকায় তাদের ছাড়পত্র দেওয়া হয়নি ৷ কারখানা কর্তৃপক্ষকে যথাযথ নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করার জন্য নোটিস দেওয়া হয়েছিল ৷ নিরাপত্তা জোরদার না করেই তারা চুল্লিতে লোহা গলানোর কাজ শুরু করেন৷ এ অবস্থায় দুর্ঘটনা ঘটেছে ৷”
তবে শ্রমিকদের নিরাপত্তার ‘যথাযথ ব্যবস্থা’ ছিল দাবি করে রহিমা ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স লিমিটেডের (আরআইসিএল) তত্ত্বাবধায়ক (সুপারভাইজার) শফিকুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, তারা ছয় মাস ধরে লোহা গলানোর কাজ চালাচ্ছেন ৷
কারখানাটির অবস্থান রূপগঞ্জের ভুলতার গোলাকান্দাইল ইউনিয়নের সাওঘাট এলাকায়। ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের পাশেই প্রায় এক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে কমপ্লেক্সটির অবস্থান। কমপ্লেক্সের ভেতরে অনেকগুলো অবকাঠামো রয়েছে।
ফটক থেকে বেশ কিছুটা দূরে একটি বড় টিন শেডের মধ্যে লোহা গলানোর চুল্লি। সেখানে প্রায় অর্ধশত শ্রমিক কাজ করেন।
এ কারখানার মালিক সাইফুর রহমান কারখানার ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) দায়িত্বে রয়েছেন। অভিযোগের বিষয়ে তার বক্তব্য জানা যায়নি।
গত বছর ছাড়পত্রের জন্য আবেদন করে আরআইসিএল কারখানা কর্তৃপক্ষ৷ আবেদনের প্রেক্ষিতে দুইজন পরিদর্শক কারখানাটি পরিদর্শন করে কারখানার শ্রেণি ও কাজের ধরন অনুযায়ী পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকার কথা জানান। শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পর ছাড়পত্র দেওয়ার কথা বলেন তারা৷
গত মার্চেও সরেজমিনে কারখানা পরিদর্শন করেন অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা ৷ এ সময় কারখানার মেশিন লে-আউট, শ্রমিকদের কর্ম পরিবেশ, শ্রমিকদের নিরাপত্তা পোশাক যথাযথ না হওয়ায় তারা প্রথমে মৌখিক ও পরে লিখিতভাবে নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য কারখানা কর্তৃপক্ষকে তাগিদ দেন।
তারপরও শ্রমিকদের পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত না করে উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ লোহা গলানোর কারখানাটিতে উৎপাদন কার্যক্রম চলছিল৷
এর মধ্যেই বৃহস্পতিবার বিকালে লোহা গলানোর সময় চুল্লির ভেতরে বিস্ফোরণে সাত শ্রমিক দগ্ধ হন ৷ তপ্ত লোহা শরীরে পড়ে ঘটনাস্থলেই একজনের মৃত্যু হয়। বাকি ছয়জনকে রাজধানীর শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়। শুক্রবার সেখানে আরও চারজন মারা যান।
এখন সেখানে যে তিনজন চিকিৎসাধীন আছেন তাদের অবস্থাও আশঙ্কাজনক বলে জানিয়েছেন ইনস্টিটিউটের আবাসিক সার্জন আইউব হোসেন ৷
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী কারখানার স্টোর হাউজের কর্মকর্তা আল আমিন সাংবাদিকদের বলেন, তার অফিসের পেছনেই চুল্লিটির অবস্থান। বিকালে বিকট শব্দে বিস্ফোরণের পর তিনি দৌড়ে সেখানে গিয়ে দেখেন দুর্ঘটনা ঘটেছে এবং কয়েকজন শ্রমিক আহত হয়েছেন।
তিনি বলেন, “চুল্লিটি ঠিক আছে। হয়তো ভিতরে কোনো কিছুর বিস্ফোরণ ঘটেছে। তারপর গরম লোহা এসে শ্রমিকদের গায়ে পড়েছে।“
কারখানার অবস্থানগত ছাড়পত্র ছিল বলে জানিয়েছেন কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের নারায়ণগঞ্জ জেলার উপ-পরিচালক (ডিডি) আব্দুল্লাহ আল মামুন ।
তিনি বলেন, “কারখানার উৎপাদনে যেতে হলে এনভায়রনমেন্টাল ইমপেক্ট অ্যাসেসমেন্ট প্রতিবেদন দাখিল করতে হয়। তারা সেটি দাখিল করেনি। যার কারণে তাদেরকে উৎপাদনে যাওয়ার জন্য চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়নি।
অধিদপ্তরের এনফোর্সমেন্ট টিম এখন চাইলে কারখানাটির অবস্থানগত ছাড়পত্র বাতিল করে দিতে পারে, জরিমানাও করতে পারে বলে জানান উপ-পরিচালক।
কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের পরিদর্শক মেহেদী হাসান বলেন, “কারখানা চালু করার অন্তত ১৫ দিন আগে আমাদের অবহিত করতে হয় ৷ কিন্তু কারখানা কর্তৃপক্ষ তা করেননি ৷ নিরাপত্তা ব্যবস্থা কেমন আছে, কারখানার অবকাঠামো, লে-আউট ঠিকমত আছে কিনা এসব বিষয়ের ওপর নির্ভর করে ছাড়পত্র দেওয়া হয়৷ তারা ছাড়পত্র ছাড়াই কার্যক্রম চালাচ্ছিল ৷”
পরীক্ষামূলকভাবে চুল্লিতে লোহা গলানোর কাজ চলছিল বলে জানিয়েছেন রাজীব চন্দ্র দাস।
কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর নারায়ণগঞ্জ জেলা কার্যালয়ের এই উপমহাপরিদর্শক বলেন, “যদিও এই কাজও তারা করতে পারেন না ৷
দুর্ঘটনার পর এবং শুক্রবার দুদফায় কারখানা পরিদর্শন করেছেন জানিয়ে রাজীব বলেন, “সেখানে নিরাপত্তা ব্যবস্থার ঘাটতি পেয়েছি৷ এটা আমরা আমাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করব এবং এ বিষয়ে তদন্তের পর আইনত ব্যবস্থা নেওয়া হবে৷”
আরআইসিএল কারখানার তত্ত্বাবধায়ক শফিকুল ইসলামের কাছে ছাড়পত্র ছাড়া কার্যক্রম চালানোর প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “এই বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারব না ৷”
ফায়ার সার্ভিসকে না জানানো ‘রহস্যজনক’
কোনো কারখানায় দুর্ঘটনা ঘটলে কর্তৃপক্ষ প্রথমেই জানায় ফায়ার সার্ভিসকে। অথচ রহিমা ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স লিমিটেডের চুল্লিতে বিস্ফোরণের পর ফায়ার সার্ভিস বা পুলিশ প্রশাসনকে জানানো হয়নি।
বিকালে দুর্ঘটনা ঘটলেও বিভিন্ন মাধ্যম থেকে খবর পেয়ে সন্ধ্যায় আড়াইহাজার ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের একটি দল কারখানায় যায়৷
স্টেশনের সাব-স্টেশন অফিসার শহীদ আলম বলেন, “বিস্ফোরণের পর রহস্যজনক কারণে প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে পুলিশ কিংবা ফায়ার সার্ভিসকে জানানো হয়নি৷ বিভিন্ন সূত্রে খবর পেয়ে কারখানা পরিদর্শনে যায় একটি দল৷
“পরিদর্শনে কারখানাটিতে কোনো অগ্নিনির্বাপন যন্ত্র দেখা যায়নি ৷ কাজের সময় শ্রমিকদের নিরপত্তার জন্য যে ধরনের নিরপত্তা সরঞ্জাম থাকার কথা সেসবও ব্যবহার করা হয়নি বলে অভিযোগ পেয়েছি ৷”
ফায়ার সার্ভিসের এ কর্মকর্তা বলেন, “বিস্ফোরণের কারণ নিশ্চিত করা যায়নি ৷ তবে লোহা গলানোর চুল্লিটি অক্ষত আছে। ধারণা করছি, চুল্লির ভেতরেই কিছু বিস্ফোরিত হয়েছে ৷ পরে গরম লোহা শ্রমিকদের গায়ে এসে পড়েছে ৷”
নারায়ণগঞ্জ ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের উপ-সহকারী পরিচালক মো. আলমগীর বলেন, “এটি একটি লোহা তৈরির কারখানা৷ কারখানাটিতে তাদের পুরোপুরি উৎপাদন কাজ শুরু হয়নি ৷ তারা লোহা গলানোর চুল্লিটি চালাচ্ছিলেন ৷ তাদের ফায়ার সেইফটির জন্য যথাযথ ব্যবস্থা এবং কাগজপত্র ছিল কি-না এ বিষয়ে তদন্ত করা হচ্ছে৷”
কেন ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে ফায়ার সার্ভিসকে জানানো হয়নি এ ব্যাপারে চেষ্টা করেও রহিমা ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স লিমিটেডের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
‘সব স্টিল মিলেই এইরকম চলে’
নারায়ণগঞ্জে তালিকা অনুযায়ী মোট ৯০টি রি-রোলিং ও স্টিল মিল রয়েছে বলে জানিয়েছে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর। কারও মতে, এই সংখ্যা আড়াই শতাধিক। এর মধ্যে মাত্র তিন-চারটি কারখানায় শ্রমিকদের নিরাপত্তার সরঞ্জাম ও পরিবেশ রয়েছে। বাকি সবগুলো কারখানাতেই নিরাপত্তা ব্যবস্থা খুবই দুর্বল ৷
লোহা গলানোর এসব কারখানা উচ্চঝুঁকিপূর্ণ হলেও শ্রমিকদের জন্য ন্যূনতম নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয় না বলে অভিযোগ রয়েছে শ্রমিক ও শ্রমিক সংগঠনের নেতাদের ৷
নিয়ম অনুযায়ী, কারখানা কর্তৃপক্ষের সেইফটি জ্যাকেট, জুতা, হেলমেট, গ্ল্যাভস সরবরাহ করার কথা৷ কিছু কারখানায় এসব সরঞ্জাম সরবরাহ করা হলেও তা অতি নিম্নমানের থাকে বলে অভিযোগ তাদের ৷
রহিমা ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স লিমিটেড (আরআইসিএল) কারখানায় কাজ করার সময় নিরাপত্তা সরঞ্জাম সরবরাহ না করার কথা জানান কারখানার শ্রমিকরাও ৷
একজন শ্রমিক বলেন, “সেইফটি জ্যাকেট সবসময় দেওয়া হয় না৷ সব স্টিল মিলেই এইরকম চলে ৷”
আরেকজন শ্রমিক বলেন, “শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিয়া কারখানার লোকজনের অত ভাবার টাইম আছে ? আমরাও অমনেই কাজ করি ৷”
নারায়ণগঞ্জে আরআইসিএল কারখানায় যেদিন বিস্ফোরণ ঘটে, সেদিন ঢাকার শ্যামপুরের একটি স্টিল মিলে কাজ করতে গিয়ে আহত হন শ্রমিক জাকির হোসেন। তিনি থাকেন ফতুল্লার পাগলা এলাকায় ৷
জাকির হোসেন বলেন, “আমাদের সেইফটি জ্যাকেট তো দূরের কথা, ঠিকমতো বুটও (জুতা) পাই না৷ মাঝে মাঝে জ্যাকেট দেয়৷ কিন্তু সবসময় দেয় না ৷ কোম্পানির কোনো চিন্তা নাই আমাদের নিয়া৷ হেলমেট না পাইয়া মাথায় গামছা বাইন্ধা কাজ করি ৷ গায়ে মোটা জিন্সের কাপড় বাইন্ধা লই ৷
“গতকাল বুট পাই নাই কারখানায়৷ খালি পায়ে কাজ করার সময় পায়ে লোহা পইড়া গেছে ৷ ঠাণ্ডা লোহা ছিল, কিন্তু যে ব্যথা পাইছি তাতে আগামী ১৫ দিন কাজে যাইতে পারমু না৷ এমন ঘটনা প্রায়সময় হয় আমাদের ৷”
রি-রোলিং স্টিল মিলস শ্রমিক ফ্রন্টের নারায়ণগঞ্জ জেলার সাধারণ সম্পাদক এস এম কাদির বলেন, নারায়ণগঞ্জে অন্তত আড়াইশ রি-রোলিং ও স্টিল মিল আছে ৷ স্টিল মিলের সংখ্যাই শতাধিক ৷ সরাসরি লোহা গলানোর মত অতিঝুঁকির এ কাজে কোনো সেইফটি ব্যবস্থা শ্রমিকদের জন্য থাকে না৷ হাতে গোনা কয়েকটা কারখানায় সেইফটি সরঞ্জাম প্রোভাইড করলেও তা অতি নিম্নমানের ৷
“সেইফটি ইক্যুইপমেন্ট না পেয়ে পুরান জিন্সের কাপড়, গামছা ব্যবহার করেন শ্রমিকরা৷ রি-রোলিং বা স্টিল মিলে কাজ করেন কিন্তু আহত হননি– এমন কোনো শ্রমিক খুঁজে পাবেন না ৷”
শ্রমিকদের নিরাপত্তার ব্যাপারে বারবার বললেও কর্তৃপক্ষ কর্ণপাত করেন না অভিযোগ করে এই শ্রমিক ইউনিয়ন নেতা বলেন, “তদারকি করার জন্য সরকারি যেসব সংস্থা আছে তারা আর্থিক সুবিধা নিয়ে কোনো ব্যবস্থা নেন না ৷ প্রতিমাসে একবার কারখানায় পরিদর্শন করা দরকার৷ কিন্তু অসাধু সরকারি কর্মকর্তারা পরিদর্শনে গিয়ে টাকা নিয়ে পরে চুপ থাকেন ৷
“এমনকি কারখানার অধিকাংশ শ্রমিকের নিয়োগপত্র, পরিচয়পত্র দেওয়া হয় না৷ হতাহত হলে আইন অনুযায়ী ক্ষতিপূরণ পাওয়ারও সুযোগ থাকে না৷”
কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের নারায়ণগঞ্জের উপমহাপরিদর্শক রাজীব চন্দ্র দাস বলেন, “আমরা প্রায় সময় এসব কারখানা ভিজিট করে তাদের নোটিস দিই ৷ নোটিসের পরও ব্যবস্থা না নিলে তাদের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হয় ৷ কিন্তু কারখানা কর্তৃপক্ষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে সবসময়ই উদাসীন থাকে।“
Also Read: নারায়ণগঞ্জে লোহা গলানোর কারখানায় চুল্লিতে বিস্ফোরণ, শ্রমিকের মৃত্যু
Also Read: নারায়ণগঞ্জে লোহা গলানোর চুল্লি বিস্ফোরণে মৃত্যু বেড়ে ৪
শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংস্থা সেইফটি অ্যান্ড রাইটসের তথ্য বলছে, গত বছর সারাদেশে কর্মক্ষেত্রে বিস্ফোরণে ৮৪ জন নিহত হয়েছেন।
কারখানায় বিদ্যুৎ বন্ধ, মামলা হয়নি
বিস্ফোরণ ও নিহতের ঘটনার পর আরআইসিএল কারখানায় বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ করে দিয়েছে রূপগঞ্জ উপজেলা প্রশাসন। এ ছাড়া এ ঘটনায় তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
এদিকে বিস্ফোরণের এক দিন পরেও কোনো মামলা হয়নি৷
রূপগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফয়সাল হক বলেন, “কী কারণে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে এবং এ বিষয়ে পরবর্তী সময়ে কী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে সে সিদ্ধান্ত নিতে কমিটি গঠন করা হয়েছে৷ তারা দ্রুতই প্রতিবেদন দেবেন৷
“আমরা কারখানাটির উৎপাদন কার্যক্রম চালানোর অনুকূলে কোনো প্রকার কাগজ এখনও পাইনি৷ তদন্তের পর সামগ্রিকভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হবে৷ আপাতত কারখানার বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ রাখা হয়েছে৷”
মামলা ব্যাপারে রূপগঞ্জ থানার ওসি এ এফ এম সায়েদ বলেন, “ভিকটিমের পরিবারের পক্ষ থেকে এখনও মামলা করা হয়নি৷ তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে৷ ভিকটিমের পক্ষ থেকে মামলা না করলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে পুলিশ আইনগত ব্যবস্থা নেবে।“
এ ঘটনায় নিহত চারজন হলেন- শংকর (৪০), ইলিয়াস আলী (৩৫), আলমগীর (৩৩) এবং লিয়ন (২০)।
আহত যারা চিকিৎসাধীন, তাদের মধ্যে ইব্রাহিমের শরীরের ২৮ শতাংশ, মো. জুয়েলের শরীরের ৯৭ শতাংশ, গোলাম রাব্বির শরীরের ৯৯ শতাংশ পুড়ে গেছে।
Discussion about this post