“পরিবেশ অধিদপ্তরের নানা অপকর্ম, লুটপাটের মহোৎসব, ঘুষ দূর্ণীতিতে নিমজ্জিত সরকারী এই প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশরাই ঘুষ ছাড়া কিছুই বুঝেন না বলে চাউর রয়েছে পুরো নগর জুড়ে। বিশেষ পেশার কয়েকজন নির্দিষ্ট দালালের মাধ্যমে বিশেষ বিশেষ অভিযান নামক নাটক মঞ্চায়ণ করে উর্ধতন কর্মকর্তাদের চোখে ধূলো দিয়ে কি পরিমাণ অপরাধে নিমজ্জিত তা কেউ সহজেই অনুধাবন করতে পারবে না।
প্রতিমাসেই এমন লোক দেখানো নাটক মঞ্চায়নের পর নারায়ণগঞ্জ পরিবেশ অধিদপ্তরের অসাধু কর্মকর্তা কর্মচারীরা পরিবেশ সংশ্লিষ্ট সকল দপ্তরের প্রতিটি খাতে বিশেষ বিশেষ ক্যাশিয়ার নিয়োগ করে মাসোযারা আদায় করেই যাচ্ছে । নারায়ণগঞ্জের অবৈধ ইটভাটা, নিষিদ্ধ পলিথিনের কারখানাসহ সর্বত্র চষে বেড়ায় শুধু মাসোয়ারা আদায় করতে ।
এমন অসংখ্য অপরাধের খবরের পর এবার রূপগঞ্জের সাংবাদিক রাসেল আহমেদ তুলে এনেছেন ইটভাটার এক ভয়ংকর চিত্র। যা সংবাদ আকারে দৈনিক বাংলায় প্রচারের পর নারাযণগঞ্জে ব্যপক সমালোচনার ঝড় উঠেছে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা কর্মচারীদের অপকর্মের বিষয়ে কেউ কেউ মন্তব্য করে বলেছেন, নারায়ণগঞ্জ পরিবেশ অধিদপ্তরের অসাধু কর্মকর্তা কর্মচরীরা যেখানে সোনারগাঁয়ের অজোপাড়া গাঁয়ের ছোট্ট নিষিদ্ধ পলিথিনের দোকান থেকে নিয়মিত মাসোয়ারা গ্রহণ করেন, সেখানে ইটভাটা থেকে কি পরিমাণ চাঁদাবাজি করে তার হিসাব কেউ অনুমান করতেও পারবে না । উৎকোচ আদায়কারীদের দূর্ণীতির লাগাম টেনে না ধরতে পারলে নারায়ণগঞ্জের পরিবেশ আরো দিন দিন মারাত্মক আকার ধারণ করবে।
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার দাউদপুর ইউনিয়ন। সবজির ভাণ্ডারখ্যাত এ ইউনিয়ন এখন যেন ইটভাটার রাজ্য। মাত্র ২৭ দশমিক ৫ বর্গকিলোমিটারের এ ইউনিয়নে রয়েছে ৬৪টি ইটভাটা। এর মধ্যে মাত্র চারটির বৈধতা রয়েছে। গত প্রায় দুই যুগ ধরে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা এসব ইটভাটার কারণে সেখানে আর আগের মতো ফসল হয় না।
সরেজমিন দাউদপুর ইউনিয়ন ঘুরে দেখা যায়, দিগন্তজোড়া ফসলের মাঠ। নদ-নদীর তীর যেদিকে চোখ যায়, শুধুই সারি সারি ইটের ভাটা। স্থানীয় নুরুন্নেসা স্কুল অ্যান্ড কলেজ, দেবই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কাজীরবাগ মাদ্রাসা ও খাস কামালকাঠি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ আশপাশের বাড়িঘর ঘেঁষেও রয়েছে ইটভাটা। সেখানকার বিষাক্ত ধোঁয়া ও ধুলাবালিতে মারাত্মকভাবে দূষিত হচ্ছে পরিবেশ। আর বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে কৃষিজমি।
এদিকে ইটখোলার মাটি বহনকারী ট্রাক্টর চলাচলের কারণে এলাকার রাস্তাঘাট ভেঙে ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে গেছে। ইটভাটাগুলোর সামনে কাঠ ও টায়ারের স্তূপ। আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে এসব পোড়ানো হয় সেখানে। এতে বাতাস দূষিত হয়ে শ্বাসকষ্ট, চর্ম ও হাঁপানিসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন স্থানীয়রা। আবার লোকালয় ও নদী থেকে অন্তত তিন কিলোমিটার দূরে ইটখোলা করার নিয়ম থাকলেও কেউই তা মানছেন না। কৃষি জমিতে ইটখোলা তৈরিতে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও তারও তোয়াক্কা করছেন না কেউ।
উপজেলা প্রশাসন, উপজেলা কৃষি ও পরিসংখ্যান অফিস, পরিবেশ অধিদপ্তর ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, দাউদপুর ইউনিয়নে ১ হাজার ১২০ হেক্টর আবাদি জমি রয়েছে। প্রায় ৬০ হাজার জনসংখ্যার এ ইউনিয়নের অধিকাংশ মানুষ কৃষির ওপর নির্ভরশীল। অথচ কৃষিকাজের জন্য গুরুত্বপূর্ণ শীতলক্ষ্যা নদের তীর ঘেঁষে গড়ে উঠেছে অবৈধ সব ইটভাটা। উপজেলা প্রশাসনের তালিকায় এ ইউনিয়নে ৪০টি ইটভাটা রয়েছে। আর তালিকার বাইরে আছে আরও ২৪টি। এসবের মধ্যে মাত্র চারটির বৈধতা রয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, পরিবেশ আইন লঙ্ঘন করে প্রশাসনের নাকের ডগায় একের পর এক ইটখোলা গড়ে উঠলেও কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না প্রশাসন। স্থানীয়রা জানান, প্রশাসন, থানা পুলিশ, পরিবেশ অধিদপ্তর ও এলাকার মাস্তানদের ‘ম্যানেজ’ করেই এসব ইটভাটা চালাচ্ছে মালিক পক্ষ। প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তর মাঝেমধ্যে অভিযান চালালেও কয়েক দিন পর আবারও চালু হয়ে যায় ইটখোলাগুলো।
উপজেলা প্রশাসন জানায়, গত বছর দুয়ারা এলাকার অভিযান চালিয়ে ছয়টি ইটভাটা থেকে ১৫ লাখ টাকা জরিমানা আদায় করে পরিবেশ অধিদপ্তর। আর গত নভেম্বরে তিনটি ইটভাটাকে দেড় লাখ টাকা জরিমানা করে জেলা প্রশাসন। এ ছাড়া গত ৪ থেকে ৬ নভেম্বর এবং ১২ থেকে ১৪ নভেম্বর পর্যন্ত দুই ধাপে মোট ছয় দিনের অভিযানে লক্ষ্যা শিমুলিয়া, বেলদী ও খৈসাইর এলাকায় প্রায় ৩০টি ইটভাটার অবৈধ স্থাপনা গুঁড়িয়ে দেয়া হয়।
স্থানীয়রা বলছেন, দাউদপুরে একসময় প্রচুর শাকসবজি ও ফলমূল উৎপাদন হতো। কিন্তু বর্তমানে ইটভাটার বিষাক্ত কালো ধোঁয়ায় এখানকার আবাদি জমির উর্বরতা নষ্ট হয়ে গেছে। এ ছাড়া মাত্রাতিরিক্ত পরিবেশ দূষণে গাছেও ফল ধরছে না। এতে হুমকির মুখে পড়েছে জনস্বাস্থ্য।
খৈশাইর এলাকার কৃষক ফকির আলী বলেন, ‘ইটখোলার কারণে আমাগো খেত-খামারে আগের মতন ফলন অয় না। গাছে ফল আহে না। আগে নারিকেল গাছে ডাবের কাঁদি ঝুইলা থাকত। অহন ডাবগুলান ছিট পইড়া যায়গা।’
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ফাতেহা নূর বলেন, ইটভাটাগুলোর কারণে দাউদপুরের ফসলি জমির ক্ষতি হচ্ছে। আগে বিঘায় এখানে ধান উৎপাদন হতো বিঘায় ৩০ মণ। এখন বিঘায় ২৫ মণ উৎপাদন হয়।
খাস কামালকাঠি এলাকার শিক্ষক রতন বসাক বলেন, ‘একসময় দাউদপুরে বইত নির্মল বাতাস। চারদিকে ছিল সবুজের সমারোহ। এখন যেদিকে চাইবেন ইটভাটা আর ইটভাটা। ধোঁয়া আর ধুলায় একাকার। এসবের বিরুদ্ধে অভিযান চলে, এরপর আবার শুরু হয়।’
একই কথা জানান পুটিনা এলাকার মাহমুদুল ইসলাম। আর ওই এলাকার গৃহবধূ আয়েশা খানম বলেন, ‘ইটভাটার ধুলা আর ধোঁয়ার কারণে আমাদের ছেলেমেয়েরা শ্বাসকষ্টসহ নানা রোগে ভোগে। এভাবে চললে দাউদপুরে বাস করা অসম্ভব হয়ে উঠবে।’
রূপগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. আইভী ফেরদৌস বলেন, ইটভাটার বিষাক্ত ধোঁয়া জনস্বাস্থ্যের ওপর তাৎক্ষণিক ও দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। লোকজন শ্বাসতন্ত্র, ফুসফুস ও স্নায়ুতন্ত্রের রোগে আক্রান্ত হয়। অতিরিক্ত দূষিত বায়ু সেবনে গর্ভে থাকা শিশুর মৃত্যুও হতে পারে।
তবে ইটভাটার মালিকদের বক্তব্য ভিন্ন। দুয়ারা এলাকার ইটভাটার মালিক হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘ইটভাটার কারণে এলাকার মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে। সাধারণ মানুষ কাজ করে খাচ্ছেন। আমরা তো ক্ষতি করছি না।’
একই কথা জানিয়ে আরেক মালিক মজিবুর রহমান বলেন, ‘আমরা সবার সঙ্গে কথা বলেই ইটভাটা চালাচ্ছি।’
নারায়ণগঞ্জ পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘আমরা অবৈধ ইটভাটা উচ্ছেদে বেশ কয়েকবার অভিযান পরিচালনা করেছি। সামনে আবারও অভিযান চলবে।’
রূপগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফয়সাল হক বলেন, ‘এক মাস আগে ইটভাটার মালিকদের নিয়ে বৈঠকে বলে দেয়া হয়েছিল, যাদের লাইসেন্স আছে কেবল তারাই ইটভাটা চালাতে পারবেন।’
রূপগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এ এফ এম সায়েদ বলেন, ‘প্রশাসন অবৈধ ইটভাটা উচ্ছেদে অভিযান পরিচালনা করলে পুলিশ সহায়তা করতে প্রস্তুত রয়েছে।’
Discussion about this post