অপকর্মের পাল্লা কতটা আর ভারী হলে এতো কিছুর পরে বিচার হবে দৃষ্টান্তমূলক । নারায়ণগঞ্জের কিছু অসাধু উচ্ছিষ্টভোগিদের নিয়মিত মাসোয়ারা দিয়ে এই কুখ্যাত অপরাধী মতিউর রহমান মতি ওরফে মইত্যা খুনি কে নিয়ে এখন আর কেউ কিছু প্রকাশ্যে বলতে সাহস করে না। একদিকে তেলচুরির বিশাল লুটপাটের অংশবিশেষ প্রতিনিয়তঃ আইনশৃংখলা বাহিনীর অসাধু কর্মকর্তাদের নিয়মিত পৌঁছে দিতে তেলচোর আশরাফ প্রধান সেনাপতি হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে । কেউ কিছু অপরদিকে এইপিজেড এর বিশাল বাণিজ্য এক হাতে সন্ত্রাসী কায়দায় নিয়ন্ত্রণ করে যাচ্ছে পুরোদমে। এমন নানা অপরাধের ফিরিস্তি দ্যানিউজনারায়ণগঞ্জ প্রকাশ করেছে
এক সময়ে আদমজী জুট মিলের শ্রমিক ছিলেন মতিউর রহমান মতি। সাত খুন মামলার ফাঁসির দন্ডপ্রাপ্ত আসামী নূর হোসেনের হাত ধরে জাতীয় পার্টি থেকে আওয়ামী লীগে যুক্ত হন। পরে হন থানা যুবলীগের সভাপতি। এর মধ্যে সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর। সবশেষ পরিষদে ছিলেন প্যানেল মেয়র। দুই হাতে টাকা কামিয়েছেন। রয়েছে নানা অভিযোগ। সেই মতি এবার ফাঁসছেন দুর্নীতিতে।
ইতোমধ্যে মতি ও স্ত্রী রোকেয়া রহমানের বিরুদ্ধে প্রায় ২০ কোটি টাকা অবৈধ সম্পদের অর্জন ও আরো জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে। ২২ ডিসেম্বর ওই চার্জশীট দাখিল করা হয়।
মতির বিরুদ্ধে রিফিউজিদের নামে বরাদ্দ দেওয়া জমি জালিয়াতির মাধ্যমে ৫০ কোটি টাকায় বিক্রির অভিযোগ উঠে। জালিয়াতির মাধ্যমে রিফিউজিদের নামে বরাদ্দ দেওয়া জমি বিপুল টাকায় বিক্রিতে সম্পৃক্ত থাকায় মতির পাশাপাশি তার সহযোগীদের কয়েকজনের বিষয়েও খোঁজখবর নিচ্ছে দুদক। তাদেরও কমিশনে তলব করা হবে।
মতি তার সহযোগীদের সহযোগিতায় আদমজী ইপিজেড এলাকায় রিফিউজিদের জন্য বরাদ্দ কয়েক বিঘা জমি জালিয়াতির মাধ্যমে বিক্রি করে দিয়েছেন।
অভিযোগে আরও বলা হয়, একসময় নূর হোসেনের সহযোগী মতি ১৯৯৮ সালে জাতীয় পার্টি থেকে আওয়ামী লীগে যোগ দেন। তিনি আদমজীতে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন। গড়ে তোলেন নতুন বাহিনী। অব্যাহত সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের অভিযোগে মতিকে ২০০৫ সালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আটক করে। ওই সময় এক বিএনপি নেতার মধ্যস্থতায় কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধ’ থেকে বেঁচে যান তিনি। মুচলেকা দেন যে তিনি বা তার বাহিনী কোনো সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে অংশ নেবে না। পরে কিছুদিন এলাকাছাড়া ছিলেন। কিন্তু বছর তিনেক বাদে এলাকায় ফিরেই সুমিলপাড়া, আমদজী ইপিজেড, সোনামিয়ার বাজার, বাগপাড়া, মন্ডলপাড়া, সিদ্ধিরগঞ্জ বিদ্যুৎকেন্দ্র, বাড়ৈপাড়া এবং শীতলক্ষ্যার তীর ও এর আশপাশের এলাকায় বেপরোয়া চাঁদাবাজি শুরু করে মতি ও তার সহযোগীরা।
শ্রমিক আর তেলচোর থেকে গডফাদার
সিদ্ধিরগঞ্জ থানার আইলপাড়া মো, বাদশা মিয়ার পুত্র এলাকার মতিউর রহমান মতি আদমজী পাট কারখানায় একজন সাধারণ শ্রমিক ছিলেন। সে সময়ে আদমজীতে একক কর্তৃত্ব ছিল আওয়ামীলীগের শ্রমিক নেতা রেহান উদ্দিন রেহান ও তার বাহিনীর। ১৯৮৯ সালে আদমজীর আলোচিত সমালোচিত শিল্পপতি ও চলচিত্র ব্যবসায়ী সফর আলীর ভূইয়ার হাত ধরে জাতীয় পার্টিতে যোগ দেয় মতি। মতির এ প্রভাব বিস্তার রেহান গ্রুপের সঙ্গে মতির নিয়মিত রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। পরে রেহানের হাত ধরেই আওয়ামীলীগে যোগ দেয় মতি।
১৯৯৮ সালের ভয়াবহ বন্যায় সরকারী ত্রাণ দেওয়ার দায়িত্ব পায় মতি, জাফর ও রেহানের স্ত্রী সুফিয়া রেহান। রাতারাতি মতির ভাগ্য বদলে যায়। সেসময়ে থানা যুবলীগের আহবায়ক পদ নিয়ে অপর দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী ক্রসফায়ারে নিহত জাফরের সঙ্গে মতির বিরোধ নিয়ে তাদের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। পরবর্তিতে আওয়ামীলীগের সিনিয়র নেতাদের হস্তক্ষেপে মতিকে আহবায়ক ও জাফরকে দেওয়া হয় আদমজী নগর যুবলীগের সহ-সভাপতির পদ। ২০০১ সালের নির্বাচনের আওয়ামীলীগের ভরাডুবির পর দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নেয় মতি। সেখান থেকে চলে যায় দুবাই। পরে প্রায় দুই বছর দক্ষিণ আফ্রিকায় বসবাস করেন। এরই মধ্যে আদমজীর কদমতলী এলাকায় আদমজীর শীর্ষ সন্ত্রাসী ও যুবলীগ ক্যাডার রগ কাটা জাফর র্যাবের সঙ্গে বন্দুক যুদ্ধে মারা যায়। তার বিরুদ্ধে হত্যাসহ বিভিন্ন অপরাধে ১ ডজন মামলা ছিল।
২০০৭ সালের ১৩ মার্চ ইন্টারপোল মতিউর রহমান মতির বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট ইস্যু করে। ইন্টারপোল তাদের ওয়েব সাইটে মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে প্রাণনাশের হুমকি ও সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে অংশ গ্রহনের অভিযোগ তুলে। ওয়েব সাইটে তার সম্পর্কে বিবরণ দিতে গিয়ে জন্ম ১ জুলাই ১৯৭৭ সেই মতে তার বয়স ২৯ বছর, উচ্চতা ১.৭০ মিটার বা ৬৭ ইঞ্চি, ওজন ১৫৪ পাউন্ড বা ৭০ কেজি উল্লেখ করা হয়। ২০১১ সালে ওই ওয়ারেন্ট প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়।
দীর্ঘ আট বছর পলাতক থাকার ২০০৯ সালের জুনে দেশে ফিরে আদালতে আত্মসমর্পন করেন ওই সময়ের ইন্টারপোলের রেড ওয়ারেন্টভুক্ত নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী ও থানা যুবলীগের আহবায়ক মতিউর রহমান মতি। মতির বিরুদ্ধে সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় তিনটি হত্যা সহ ২০টি ও বিভিন্ন মামলায় আরো ৭-৮টি মামলা ছিল। বেশীরভাগ মামলায় তিনি জামিনে রয়েছেন। দীর্ঘ আট বছর ধরে মতি ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা ও দুবাই পলাতক ছিলেন।
আলোচিত ৭ খুনের পর ২০১৪ সালের ১৪ মে সিদ্ধিরগঞ্জ থানা যুবলীগের সভাপতি মতিউর রহমান মতির বাড়িতে অভিযান চালায় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। এরপর দীর্ঘদিন পলাতক ছিল মতি। কয়েকমাস পরে এলাকায় ফিরে সে দখল করে নেয় আদমজী ইপিজেড সহ নানা সেক্টর। ৭ খুনের শুরুতে মজিবুর ও মতির বিরুদ্ধেও নিহত প্যানেল মেয়র নজরুলের পরিবার অভিযোগের আঙ্গুল তুললেও পরবর্তীতে তারা প্রভাবশালী মহলের চাপে আর অভিযোগ করেনি।
এর আগেও মতির বিরুদ্ধে উঠেছিল নানা অভিযোগ সিদ্ধিরগঞ্জ থানা যুবলীগের সভাপতির পদে থাকা যুবলীগ নেতা মতির বিরুদ্ধে। নারায়ণগঞ্জে ৬ নং ওয়ার্ড (এসও রোড) এলাকার ৫ পরিবারের জমিতে নিজের ও তানজিল হোসেন নামে সাইনবোর্ড টানানো হয়। ভুক্তভোগীদের মধ্যে ৪ জন ভয়ে মুখ না খুললেও স্বপন নামের এক ব্যক্তি মতির বিরুদ্ধে থানায় লিখিত অভিযোগ করেছে। অভিযোগে জানা গেছে, বাংলাদেশ রেলওয়ে ঢাকার নিকট হতে ৭৯৫০ বর্গফুট জমি লিজ এবং তার পাশেই আড়াই শতাংশ জমি মোস্তফা কামালের কাছ থেকে স্বপন ক্রয় করে। এরই মধ্যে মতি তার জমিতে সাইনবোর্ড সেটে দেয়। মতি আমজাদ ভুইয়া, কোহিনুর বেগমসহ বেশ কয়েকজনের জায়গায় নিজের নামে সাইনবোর্ড টানিয়ে জমির মালিক বলে দাবি করছে।
এছাড়া সিদ্ধিরগঞ্জে মতিউর রহমান মতির প্রাইভেট কারের চাপায় স্কুল ছাত্র সীমান্ত (১০) নিহত হয়। মতি এলাকাতে প্রভাবশালী নেতা হওয়ায় এলাকাবাসী গাড়িটি আটক করে পুলিশে দেওয়ার সাহস করেনি।
দুদকের চার্জশিট থেকে জানা যায়, নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের ৬ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর মতিউর রহমান মতির বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধান করার পরে সম্পদ বিবরণীর নোটিশ জারী করা হলে তিনি গত বছরের ৭ সেপ্টেম্বর সম্পদ বিবরণী দাখিল করেন। তার দাখিলকৃত সম্পদ বিবরণী অনুযায়ী স্থাবর সম্পদের মূল্য ৫ কোটি ৬৫ লাখ ১ হাজার ২২৪ টাকা ও অস্থাবর সম্পদ ৩ কোটি ৯৭ লাখ ৪০ হাজার ৮০৩ টাকাসহ মোট ৯ কোটি ৬২ লাখ ৪২ হাজার ২৯ টাকার স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ এর ঘোষনা প্রদান করেন।
তদন্তকালে দেখা যায়, মতির স্থাবর সম্পদ ১১ কোটি ৩৫ লাখ ৬৭, হাজার ২৮৩ টাকা এবং অস্থাবর সম্পদ পাওয়া যায় ৩ কোটি ৯৭ লাখ ৪০, হাজার ৮০৩ টাকা যার সর্বমোট মূল্য ১৫ কোটি ৩৩ লাখ ৮ হাজার ৮৬ টাকার সম্পদ অর্জনের তথ্য পাওয়া যায়। যার মধ্যে গোপনকৃত সম্পদের পরিমাণ ৬ কোটি ৬২ লাখ ৮২ হাজার ৭৫৩ টাকা। অন্যদিকে তার ১১ কোটি ৩৫ লাখ ৬৭ হাজার ২৮৩ টাকার জ্ঞাত আয়ের সাথে অসংগতিপূর্ণ সম্পদ অর্জনের তথ্য পাওয়া যায় এবং বিভিন্ন ব্যাংকে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় ৭৪ কোটি ৯৬ লাখ ৪০ হাজার ১১৩ টাকা জমা করে তার থেকে পরবর্তীতে ৭৪ কোটি ১৩ লাখ ৮৮ হাজার ৬৮৮ টাকা উত্তোলন করা সংক্রান্ত তথ্য পাওয়া যায়।
আসামী মতিউর রহমান দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪ এর ২৬ (২) ও ২৭(১) ধারায় এবং মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ এর ৪ (২) ধারার শাস্তিযোগ্য অপরাধ করায় তার বিরুদ্ধে গত ২০ ডিসেম্বর কমিশনের আদেশক্রমে দুর্নীতি দমন কমিশন সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে দাখিল করা হয়।
অন্যদিকে, মতির স্ত্রী রোকেয়া রহমানের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধান করার পরে সম্পদ বিবরণীর নোটিশ জারী করা হলে তিনি গত বছরের ৭ সেপ্টেম্বর সম্পদ বিবরণী দাখিল করেন। তার দাখিলকৃত সম্পদ বিবরণীতে অনুযায়ী স্থাবর সম্পদের মূল্য ১ কোটি ৪৯ হাজার ৮৩০ টাকা ও অস্থাবর সম্পদ ২০ কোটি ২০ হাজার ৮০০ টাকাসহ মোট ১ কোটি ২০ লাখ ৭০ হাজার ৬৩০ টাকার স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ এর ঘোষণা প্রদান করেন।
তদন্তকালে মোট স্থাবর সম্পদ পাওয়া যায় ৫ কোটি ৯২ লাখ ৪৭ হাজার ৩৮৭ টাকা এবং অস্থাবর সম্পদের মধ্যে আয়কর বিভাগে বিশেষ সুবিধায় বৈধ করেছেন ২ কোটি ২২ লাখ ৩৮ হাজার ৫৩২ টাকা ও অন্যান্যভাবে ২০ লাখ ২০ হাজার ৮০০ টাকাসহ মোট ৮ কোটি ৩৫ লাখ ৬ হাজার ৬১৯ টাকা। গোপনকৃত সম্পদের পরিমান ২ কোটি ৪২ লাখ ৫৯ হাজার ৩৩২ টাকা। জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদের পরিমান ৮ কোটি ১৪ লাখ ৮৫ হাজার ৯৯৯ টাকা।
তদন্তকালে প্রাপ্ত তথ্য প্রমাণে আরও দেখা যায় যে, আসামী রোকেয়া রহমান কর্তৃক দাখিলকৃত সম্পদ বিবরণীতে ২ কোটি ৪২ লাখ ৫৯ হাজার ৩৩২ টাকার সম্পদের হিসাব প্রদর্শন না করে মিথ্যা তথ্য সম্বলিত সম্পদ বিবরণী দাখিলসহ ৮ কোটি ১৪ লাখ ৮৫ হাজার ৯১৯ টাকার জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ।
Discussion about this post