নারায়ণগঞ্জ নিউজ আপডেট :
সড়ক পথ বন্ধ, পুরো এলাকা বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন করে শহরের কিল্লারপুল এলাকার হাজীগঞ্জ দুর্গের চারপাশে উচ্ছেদ করা হয়েছে । ছোট-বড় প্রায় ১৮টির অধিক গোডাউনসহ স্থাপনা গুড়িয়ে দেওয়া হয় উচ্ছেদে। উচ্ছেদ চলাকালীন সময়ে এলাকাবাসী ছাড়াও চরাচলরত লোকজন চরম ভোগান্তির শিকার হতে হয়েছে ।
প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ, জেলা প্রশাসন ও নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের সমন্বয়ে গঠিত টিম বৃহস্পতিবার (২৪ অক্টোবর) সকাল থেকেই এই উচ্ছেদ অভিযান শুরু করে।
উচ্ছেদ করা প্রতিষ্ঠানগুলো হলো রকি প্রিন্ট-১ ও ২, রাসেল ওয়াশিং-১ ও২, আনোয়ার এন্ড ব্রাদার্স, নিলিমা কটন, ব্রাইট প্যাকেজিং, সোনালি, বিসমিল্লাহ ও আশরাফ প্যাকেজিংসহ আরো বেশ কয়েকটি অবৈধ স্থাপনা।
জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হাসান বিন মুহাম্মাদ আলী বলেন, মহামান্য হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী এই অভিযানটি প্রত্নতত্ব বিভাগ, জেলা প্রশাসন, সিটি করপোরেশনসহ আরো বেশ কয়েকটি দপ্তরের সমন্বয়ে চালানো হয়েছে। আমাদের দায়িত্ব ছিলো শুধুমাত্র আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যাতে স্বাভাবিক থাকে সেটি দেখভাল করার। অভিযানে কতখানি উচ্ছেদ করা হবে তা আমরা বলতে পারবোনা।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর আগারগাঁও আঞ্চলিক কার্যালয়ে পরিচালক রাখী রায় বলেন, হাজীগঞ্জ দুর্গটি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আওতাধীন। মহামান্য হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী এখানে অভিযান পরিচালিত হবে জেনে এখানে পরিদর্শন করতে আমরা এসেছি। অভিযানে যাতে প্রত্নতত্ত্ব সম্পদের কোন ক্ষতি না হয় এব্যাপারে আমরা দেখভাল করছি।
নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা আবুল হোসেন বলেন, আমরা শুধু অভিযানে সহযোগিতা করছি। এরবেশি কিছু বলতে পারছিনা।
এদিকে উচ্ছেদ হওয়া একটি গোডাউন আনোয়ার এন্ড ব্রাদার্সের সত্ত্বাধিকারী নুরুল ইসলাম চৌধুরীর দাবি এই উচ্ছেদ সম্পর্কে তারা ওয়াকিবহাল নন। তিনি বলেন, এখানে মোট ৭৮২ শতাংশ জমি নিয়ে হাইকোর্টে রীট আবেদন করা রয়েছে।আমরা গোডাউন মালিকরা এই সম্পত্তি বাংলাদেশ জুট করপোরেশন (বিজেসি) থেকে ক্রয় করে নিয়েছি, টাকা-পয়সা দেওয়াও ক্লিয়ার। মালিকানা সংক্রান্ত মামলাটি হাইকোর্টে রয়েছে। আজ হঠাৎ বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তারা এসে ১২টি গোডাউনে উচ্ছেদ চালিয়েছেন।
হাজীগঞ্জ দুর্গের চতুর্দিকে সমন্বিত অভিযানে স্বস্তি প্রকাশ করেছেন এলাকাবাসী । তারা জানান, রাত নামলেই এই এলাকাটিতে অপরাধী আর নেশাখোরদের অভয়ারণ্যে হয়ে ওঠে। নানা সময় অনেক দুর্ঘটনা ঘটে। হাজীগঞ্জ দুর্গের মতো ঐতিহাসিক জায়গাটি এতোদিন অবহেলায় পড়ে ছিলো। মানুষজন ঘুরতে যেতেও সাহস পেতনা। জায়গাটি যদি পরিচ্ছন্ন করে সুন্দর করে গড়ে তোলা যায় তবে দূর-দুরান্ত থেকে লোকজন এই ঐতিহাসিক জায়গাটি দেখতে আসবেন। এলাকার পরিবেশটিও অনেক সুন্দর হবে।
এদিকে অভিযানের সময় চাষাঢ়া-শিমরাইল সড়কে যানচলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ভোগান্তিতে পড়েছে মানুষ। হাজীগঞ্জ-নবীগঞ্জ ঘাট এলাকা পর্যন্ত এসেই গাড়িগুলোকে থেমে যেতে হয়। উল্টোদিকে ড্রেজার পরিদপ্তরের সামনে এসেই চাষাঢ়া থেকে শিমরাইলগামী গাড়িগুলো থামতে দেখা গেছে। এতোটুকু রাস্তা সাধারণ মানুষ গাড়ি থেকে নেমে হেঁটে পার হন। এতে ভোগান্তিতে পড়েন সাধারণ মানুষ। তবে উচ্ছেদ অভিযানকে সাধুবাদ জানিয়েছেন তারা।
উইকিপিডিয়ায় পাওয়া তথ্যমতে, হাজীগঞ্জ দুর্গ মুঘল আমলে নির্মিত একটি জল দুর্গ। নারায়ণগঞ্জের সিটি করপোরেশন ১১নং ওয়ার্ডের হাজীগঞ্জ এলাকায় শীতলক্ষ্যা নদীর পশ্চিম তীরে অবস্থিত। এটি খিজিরপুর দুর্গ নামেও পরিচিত। ঢাকা শহরকে রক্ষা করতে সপ্তদশ শতকের আগে পওে যে তিনটি জল দুর্গকে নিয়ে ত্রিভূজ জল দুর্গ বা ট্রায়াঙ্গাল অব ওয়াটার ফোর্ট গড়ে তোলা হয়েছিল তারই একটি হলো এই হাজীগঞ্জ দুর্গ। সম্ভবত মুঘল সুবাদার ইসলাম খান কর্তৃক ঢাকায় মুঘল রাজধানী স্থাপনের অব্যবহিত পরে নদীপথে মগ ও পর্তুগীজ জলদস্যুদের আক্রমণ প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে দুর্গটি নির্মিত নির্মিত হয়।
প্রাচীন কালে বুড়িগঙ্গা নদী এসে শীতলক্ষ্যা নদীর সাথে এই স্থানে মিলিত হত। কোন লিখিত প্রমাণ না থাকায় এটি ১৬৫০ সালে নির্মিত হয়েছিল বলে অনুমান করা হয়ে থাকে। এটি কে নির্মাণ করেছেন তা নিয়ে মতপার্থক্য রয়েছে। লেখক মুন্সি রহমান আলী তার এক গ্রন্থ থেকে পাওয়া যায়, মীর জুমলা ১৬৬০-১৬৬৩ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে দুর্গটি নির্মাণ করেন। এছাড়া অন্যান্য লেখকদের মতে, যেমন হাসান (১৯০৪), তালিস (১৯৮৫) এবং আহমেদ (১৯৯১), দুর্গটির নির্মাতা হলেন মীর জুমলা। অন্যদিকে অন্যান্য লেখকদের মতে, যেমন দানি (১৯৬১) ও তাইফুর (১৯৫৬), এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ ভিন্ন মত পোষণ করেন। আহম্মাদ হাসান দানি তার মুসলিম আর্কিটেকশ্চার ইন বেঙ্গল গ্রন্থে লিখেছেন, ইসলাম খান ১৬১০ খ্রিস্টাব্দে ঢাকায় রাজধানী স্থাপন করার পর এটি নির্মাণ করেন।
মুগল সেনাপতি মির্জা নাথান তার বাহারিস্তান-ই-গায়বীতে উল্লেখ করেন, সে তার বিশাল সৈন্য বাহিনী সহকারে খিজিরপুরে (বর্তমান হাজীগঞ্জ) প্রধান ঘাটি স্থাপন করেন। নদী তীরবর্তী স্থানে সেনাদের ছাউনি স্থাপন করেছিলেন। তিনি ১৬১০ সালে মুগল রাজধানী রাজমহল থেকে ঢাকায় স্থানান্তর করার পূর্বেই ‘ভূঁইয়াদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে এই এলাকাটিকে কৌশলগতভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন।
অভিযানে প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর আগারগাঁও আঞ্চলিক কার্যালয়ের পরিচালক রাখী রায়, উপ-পরিচালক লাভলী ইয়াসমিন, জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হাসান বিন মুহাম্মাদ আলী, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা আবুল হোসেন, বাজার কর্মকর্তা জহিরুল ইসলামসহ বিপুল সংখ্যক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ও হাজীগঞ্জ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সদস্য ও নাসিকের পরিচ্ছন্নকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।
Discussion about this post