পৃথিবীতে ইতিহাস নিজের পায়ের চিহ্ন সবসময় এঁকে দিয়ে যায়। সময়ের ব্যবধানে সেই ছাপ খানিকটা ফিকে হতে পারে ঠিকই, কিন্তু ইতিহাস কখনো মুছে যায় না। প্রাচ্যের ড্যান্ডি খ্যাত নারায়ণগঞ্জের কোণায় কোণায় মিশে আছে নানা ইতিহাস। রসনাবিলাসি কোনো পাতা উল্টালে প্রথমে আসবে ‘বোস কেবিন’-এর নাম। ৯৮ বছর আগে এখানে চায়ের কাপে ঝড় ওঠা শুরু হয়। অনেক বছর পেরিয়ে গেলেও এখানকার কড়া লিকার চা আগের মতোই আছে।
বর্তমানে বোস কেবিনের কর্ণধার নৃপেন বসুর নাতি তারক চন্দ্র বসু। দোকানে খুব বেশি সময় থাকেন না। আগে থেকে যোগাযোগ করে যাওয়ায় তিনি সে সময়ে ছিলেন। পরিচয় দিতেই বললেন, ‘আপনারাই তাহলে কাগজের লোক।’ তারপর তিনি বলে গেলেন একের পর এক গল্প। জানা গেল শুরুর দিকের দিনগুলোর কথাও। ১৯২১ সালে সামান্য একচিলতে চালাঘরে এর যাত্রা শুরু হয়। সেসময় দোকানে মিলত লিকার চা, লাঠি বিস্কুট এবং বাটার বিস্কুট। ধীরে ধীরে এর জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। তার সঙ্গে বাড়ে কলেবরও।
শুরু থেকেই টং ঘরটি জনপ্রিয় হতে থাকে। এভাবেই একদিন ভুলু বাবুর টং ঘরটি একটি রেস্তোরাঁয় পরিণত হয়। নাম হয়ে যায়ে নিউ বোস কেবিন। শুরু থেকেই বোস কেবিনের খাবারের মান নিয়ে কোনোরকম আপোস নেই বলে জানালেন ব্যবস্থাপক সুজিত সাহা। তবে তারক চন্দ্র বসু বলেন, ‘চাইলে এখানে অনেক বড় চকচকে রেস্তোরাঁ বানানো যেতে পারে। কিন্তু ইতিহাসের কথা মাথায় রেখে বোস কেবিনের নির্মাণ যতটা সম্ভব একই রাখার চেষ্টা করা হয়েছে।’
বোস কেবিনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে নানা ইতিহাস। এখানে অনেক বিখ্যাত ব্যক্তির পায়ের ধুলো পড়েছে। নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর কথা আগেই বলেছি। তারক চন্দ্র বসুর কথায়, ‘দাদুর মুখেই শোনা ঘটনাটি। একবার নারায়ণগঞ্জে আসেন নেতাজি। পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। দাদু খবর পেয়ে নেতাজির প্রিয় কড়া এবং হালকা লিকার চা বানিয়ে দুটি কেটলিতে করে থানায় নিয়ে গিয়ে নেতাজিকে খাওয়ান । চা খেয়ে অত্যন্ত খুশি হয়েছিলেন তিনি । দাদুর মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদও করেন নেতাজি ।’
তারপর থেকে নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু যদি এ অঞ্চলে আসতেন, বোস কেবিনে একবার তার পায়ের ধুলো পড়তোই। এখানকার কড়া লিকার চা তার খুবই প্রিয় ছিল। শুধু নেতাজি ? এছাড়াও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়, পশ্চিবঙ্গের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু প্রমুখ আসেন এই দোকানে।
ইতিহাসের ছোঁয়া পেতে এখনও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ, শহরের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিরা নারায়ণগঞ্জের বোস কেবিনে নিয়মিত আসেন। এ সময় দেখা ও কথা হয় বোস কেবিনে প্রায় ৬২ বছর ধরে আড্ডা দেওয়া এম তরিকত হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘১৯৫৮ সালে কলেজে ভর্তি হই। সেসময় দুই আনা দিয়ে চা খাওয়া শুরু করেছি। সেই যে প্রেমে পড়লাম বোস কেবিনের। এখন এক কাপ চা ১৫ টাকা।’
এই সময়ের মেন্যু
কেবিনের মেন্যুতে এবার নজর দেওয়া যাক। সকালের নাস্তায় পরোটা, ডাল ও হালুয়া। পরোটা ৫ টাকা, ডাল ও হালুয়া ১০ টাকা। ডিমের ৬ রকমের পদ। এছাড়া রয়েছে খাসি ও মুরগির মাংস। দুপুর ১২টা থেকে পাওয়া যায় আলুর চপ, দাম ১৫ টাকা। পোলাও ৪০ টাকা। মোরগ পোলাও ৮০ টাকা। কারি ৮০ টাকা। চিকেন কাটলেট ৭০ টাকা। বোস কেবিনের চায়ের খুব নাম। যে চা নেতাজি খেয়েও প্রশংসা করেছিলেন সেই কড়া লিকারের দুধ চা বড় বড় কাপে পান করতে পারেন বর্তমানে ১৫, আর রং চা ১০ টাকায়। সারাদিনই এখানে চা পাওয়া যায়। বোস কেবিন খোলা থাকে প্রতিদিন সকাল ৭টা থেকে রাত সাড়ে ৯টা পর্যন্ত। শুরু থেকেই এই নিয়মে চলছে।
(সূত্র : ইত্তেফাক)
Discussion about this post