নারায়ণগঞ্জের লবন ব্যবসার অন্তরালে অসাধু একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট প্রতি বছর প্রায় হাজার কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে সোডিয়াম ক্লোরাইডের অন্তরালে শিল্পকারখানার বিনা শুল্কে দেশে আনা হচ্ছে সোডিয়াম সালফেট । এই বিশাল পরিমাণ সোডিয়াম সালফেট আমদানী করে নারায়ণগঞ্জের এই সিন্ডিকেট প্রশাসনের সকল সেক্টরের অসাধু কর্মকর্তাদের নানাভাবে ম্যানেজ করেচালিয়ে যাচ্ছে রমরমা কারবার । নারায়ণগহ্জ লবন মিল মলিক সমিতির গডপাদার এবং বিশাল রাজস্ব ফাকির মূল হোতা পরিতোষ সাহা নারায়ণগঞ্জ নিউজ আপডেট কে বলেন, ”এই লবন খাত থেকে সরকার নিম্নে ৭০০ কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে ।” এমন অপকর্ম বছরের পর বছর যাবৎ চলমান থাকায় লবণ শিল্প ও জনস্বাস্থ্য দুটিই চরম ঝুকির মধ্যে রয়েছে ।
নারায়ণগঞ্জ নিউজ আপডেট :
২০১৫ সালের ৬ জুলাই দুপুরে নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট শরীফুল ইসলাম কর্তৃক পরিচালিত ভ্রাম্যমাণ আদালত নারায়ণগঞ্জের পুবালী সল্টের গুদাম থেকে অবৈধভাবে আমদানিকৃত ২ হাজার ১শ ৯৯ বস্তা লবণ জব্দ করেছিলো। একই সাথে গুদামটি সীলগালা করে দুই কর্মচারীকে এক বছর করে কারাদণ্ড দেয়ার পর নারায়ণগঞ্জের অসাধু লবন ব্যবসায়ী চক্র জোটবব্ধ হয়ে সকল প্রশাসন ও খোদ শিল্প মন্ত্রণালয়ের অসাধু কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে বিরামহীন ভাবে চালিয়ে আসছে লবনের অনৈতিক কারবার। যা এখনো চলমান রয়েছে দেশের অসাধু রাজনীতিবিদ, প্রশাসনের অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজসে।
তৎকালীন সময়ে কদমতলী এলাকার পুবালী সল্টের গুদামটিতে অভিযান চালানোর পর সামুদা কেমিক্যালের মালিকানাধীন বিপুল পরিমাণ আয়োডিনবিহীন লবণের মজুদের খোঁজ পায় তারা। তাৎক্ষনিকভাবে সিলগালা করে দেয়া হয় গুদামটি। এর পর আর কেউ কোন খোজ নেয় নাই কি লবনের না নারায়ণগঞ্জের অসাধু ব্যবসায়ী চক্র কি খাওয়াচ্ছে দেশবাসীকে। একই সাথে বিশাল পরিমাণ রাজস্ব ফাকির কবষয়টিও নজরে আসে নাই সংশ্লিষ্ঠ কোন কর্মকর্তার ।
নারায়ণগঞ্জের লবন ব্যবসায়ীদের অনেকের অভিযোগ থেকে জানা যায়, ভ্যাট, ট্যাক্স, বিসিক, জেলা প্রশাসন, সিংশ্লিষ্ট কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজসে নারায়ণগঞ্জের লবন ব্যবসায়ী পরিতোষ সাহা, দিলীপ রায় দিলু, আমলাপাড়ার নতুন চারতলার মলিক জাহিদ, কুমিল্লার কমল সাহা, কাশিপুরের সোহাগ,সহ আরো কয়েকজন সিন্ডিকেট করে ডাইং ফ্যাক্টরিতে ব্যবহারের জন্য আমদানি করা ‘ইন্ডাস্ট্রিয়াল সল্ট’কে খাবার লবণ হিসেবে বাজারজাত করছে শক্তিশালী এই সিন্ডিকেট। আমদানীকৃত শিল্প লবণকে সাধারণ খাবার লবণের সঙ্গে মিশ্রনের মাধ্যমে খাবার লবণ হিসেবে বাজারজাত করছে এরা । এই লবন জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি হলেও প্রশাসনে ও রাজনীতিবিদরা নিয়মিত মোটা অংকের মাসোয়ারা গ্রহণ করায় কোন বাবেই থামানো যাচ্ছে না লবণ ব্যবসার নামে অপকর্ম ।
এমন ঘটনা গণমাধ্যমে প্রকাশ হওয়ার পর গত ১০ ফেব্রুয়ারী রোববার নারায়ণগঞ্জ জেলা আইনশৃংখলা বৈঠকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন এমন বিষাক্ত লবনের বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসন ব্যবস্থা নেবেন । কিন্তু নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসনের এমন সিদ্ধান্তের ৭ মাস অতিবাহিত হলেও কোন ব্যবস্থা নেয় নাই অপরাধীদের বিরুদ্ধে ।
এতে করে সাধারণ মানুষ রয়েছে চরম স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে। নারায়ণগঞ্জে থেকে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে সরবরাহ করা এসব লবণ না জেনেই বেশী ব্যবহার করছে ভোক্তারা। অসাধু সিন্ডিকেটের এমন কারসাজিতে দেশে উৎপাদিত লবণের বিক্রি কমে যাচ্ছে। ভরা মৌসুমেও নারায়ণগঞ্জের লবণ মিলগুলো চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে।
সংশ্নিষ্টরা বলছেন, এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়বে কক্সবাজারের কয়েক লাখ লবণ শ্রমিক আর নারায়ণগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে থাকা লবণ মিল ও মিলের শ্রমিকদের ওপর।
চিকিৎসকরা বলছেন, শিল্প লবণের কারণে মানবদেহে কিডনী ও লিভার ড্যামেজসহ নানা ধরনের জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে । এ লবণকে মাদকের চেয়েও ক্ষতিকর বিষ বলে মন্তব্য করেছেন লবণ ব্যবসায়ীরা।
নারায়ণগঞ্জ লবণ আড়ৎদার সমিতির সাধারণ সম্পাদক সাইদুর হক লিপন জানান, চিটাগাংয়ের একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেটের মাধ্যমে প্রতিদিনই ৩০ থেকে ৩৫টি ট্রাকভর্তি ইন্ডাস্ট্রিয়াল লবণ নারায়ণগঞ্জে আসছে । পরে নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন কারখানায় ও গোডাউনে বস্তা খুলে বিভিন্ন খাবার লবণের ব্র্যান্ডের নামে ছোট ছোট প্যাকেটে ভরে ফেলা হয়। এসব লবণ দেশের বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করা হয়।
লবণ ব্যবসায়ীরা বলছেন, ইন্ডাস্ট্রিয়াল লবণ দেখতে রিফাইন করা খাবার লবণের মতোই সাদা। তাই এটি আমাদনী করার পরপর বস্তা খুলেই ছোট ছোট প্যাকেটে ভরে বাজারজাত করা যায়। রিফাইন করতে হয়না। ফলে রিফাইন করা বাবদ টাকা বেঁচে যায়। ফলে এটি খুচরা বাজারে খাবার লবণের চাইতে কেজি প্রতি দশ থেকে বারো টাকা কমে বিক্রি করা যায়। এসকল লবণ সাধারণত জামালপুর, দিনাজপুর, রংপুরসহ বিভিন্ন মফস্বল এলাকাগুলোতে সরবরাহ করা হয়ে থাকে।
জানা গেছে, এই লবণ মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর। দেশি লবণ চাষ করার পর এটির রঙ থাকে লালচে। লবণ মিলে এটি রিফাইন করার পর রঙ সাদা হয়। ইন্ডাস্ট্রিয়াল লবণ বা গ্লোবাল সল্টের সুবিধা হচ্ছে এটি দেখতে রিফাইন করা খাবার লবণের মতোই সাদা। রিফাইন করতে হয় না বলে এটাতে খরচ বেঁচে যায়।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) হিসাব অনুযায়ী, দেশে ভোজ্য লবণের চাহিদা ১৬ থেকে ১৭ লাখ টন, শিল্প লবণের চাহিদা ৩ লাখ ৮৩ হাজার টন। কিন্তু গত অর্থবছর দেশে শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে ১৪ লাখ ৪০ হাজার ৭৫৮ টন লবণ আমদানি হয়েছে। এতা লবন কোথায় যাচ্ছে ? যার সকল তথ্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর জানা থাকলেও কেউ কোন টু শব্দও করে না নিয়মিত অনৈতিক লেনদেনের কারণে ।
অর্থাৎ গত অর্থ বছরে প্রায় ৪ গুন বেশী ইন্ডাস্ট্রিয়াল সল্ট আমদানি করা হয়েছে । এর মধ্যে সোডিয়াম ক্লোরাইড ৮ লাখ ৯০ হাজার ১৮০ টন, হোয়াইট সোডিয়াম সালফেট ৫ লাখ ২৪ হাজার ৮৪ টন ও সোডিয়াম সালফেটস ২৬ হাজার ৫৩০ টন আমদানি হয়েছে ।
বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শিল্প লবণের আমদানি আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে । চাহিদার দ্বিগুণের বেশি আমদানি হওয়া শিল্প লবণ খোলাবাজারে ভোজ্য লবণ হিসেবে বিক্রি হচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজার দর অপেক্ষা স্থানীয় বাজারে অপরিশোধিত লবণের মূল্য বেশি হওয়ায় আন্তর্জাতিক বাজার থেকে সোডিয়াম সালফেটের নামে সোডিয়াম ক্লোরাইড আমদানি হচ্ছে । এতে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে ।
মিয়ানমার থেকে অপরিশোধিত লবণের অনানুষ্ঠানিক বাণিজ্য উৎসাহিত হচ্ছে। স্থানীয় অসাধু ব্যবসায়ীগণ সোডিয়াম ক্লোরাইডের সঙ্গে সোডিয়াম সালফেট মিশিয়ে বাজারজাত করার ফলে মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে ।
ট্যারিফ কমিশন বলছে, কস্টিক সোডার কাঁচামাল হিসেবে আমদানি করা সোডিয়াম সালফেট দেখতে খাওয়ার লবণের মতোই । অসাধু ব্যবসায়ীরা প্রয়োজনের চেয়ে বেশি পরিমাণ সোডিয়াম সালফেট আমদানি করে তার সঙ্গে সাবান, ডিটারজেন্ট পাউডার ও গার্মেন্ট শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে আমদানি করা সোডিয়াম ক্লোরাইড মিশিয়ে বাজারে বিক্রি করছে।
জানা গেছে, নারায়ণগঞ্জের নিতাইগঞ্জ ও আশেপাশের এলাকায় গড়ে ওঠা বেশীরভাগ লবণের মিলগুলোতে রিফাইন বা পরিশোধনের আধুনিক মেশিনারিজ নেই বললেই চলে। তারা দীর্ঘদিন ধরেই সনাতন পদ্ধতিতে লবণ পরিশোধন করে আসছে। কিন্তু বর্তমানে কমপক্ষে এক ডজন লবণ মিল ইন্ডাষ্ট্রিয়াল সল্ট বা শিল্প লবণকে দেশীয় লবণ বলে বাজারজাত করছে।
নারায়ণগঞ্জের সিভিল সার্জন ডা মোহাম্মদ ইমতিয়াজ বলেন, ইন্ডাস্ট্রিয়াল লবণ খেলে মানবদেহে কিডনী, লিভারসহ নানা অঙ্গে জটিল রোগ হতে পারে।
নারায়ণগঞ্জ লবণ আড়ৎদার সমিতির সভাপতি মামুন জানান, এই গ্লোবাল লবণ মাদকের চেয়েও ভয়ঙ্কর। মাদক মানুষকে তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে ধাবিত করে। কিন্তু এই লবণ বেশীদিন খেলে মানুষ জটিল সব রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে ।
নারায়ণগঞ্জ লবণ আড়তদার সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক মোহাম্মদ মোতালিব মিয়া স্বপন জানান, দেশে লবণের ঘাটতি হলে সরকার ঘাটতির পরিমাণ নির্ধারণ করে মিলগুলোকে আমদানির অনুমতি দেয়। গত বছর দেশে পর্যাপ্ত লবণ উৎপাদন হয়েছে। তাই কোনো লবণ আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়নি। তবে দেশের বিভিন্ন শিল্পকারখানার জন্য বিশেষ করে ডাইং কারখানার জন্য লবণ আমদানির অনুমতি রয়েছে। নারায়ণগঞ্জের কয়েকটি লবণ মিল মালিকের একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট শিল্পকারখানায় ব্যবহৃত সেই লবণকেই খাবার লবণ হিসেবে বাজারজাত করছে ।
বাংলাদেশ লবণ মিল মালিক সমিতির সাবেক সভাপতি পরিতোষ কান্তি সাহা নারায়ণগঞ্জ নিউজ আপডেট কে জানান , খাবার লবণ হচ্ছে সোডিয়াম ক্লোরাইড । এটি সম্পূর্ণ পানি দিয়ে পরিশোধন করা হয় । যা মানুষের শরীরের জন্য ক্ষতিকর নয়। কিন্তু চীন থেকে শিল্পকারখানার জন্য যে লবণ আনা হচ্ছে, তা হচ্ছে সোডিয়াম সালফেট । এটা এসিড দিয়ে পরিশোধন করা যা মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর। শিল্পকারখানায় ব্যবহার করার মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে আনা হলেও এগুলো খাবার লবণ হিসেবে বাজারজাত করা হচ্ছে ।
পরিতোষ সাহা জানান, দেশে খাবার ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল অপরিশেধিত লবণের চাহিদা ৩০ লাখ মেট্রিক টন। তবে মিল মালিকদের হিসাব অনুযায়ী ১৬ লাখ মেট্রিক টন আমদানী করতে হয়। বিদেশ থেকে ইন্ডাস্ট্রিয়াল লবনের নামেই আমদানী করা হয়। মূলত: সালফেট স্বাস্থ্যর জন্য ক্ষতিকর । কিন্তু সালফেটের নামেই ডিক্লারেশন দিয়ে বিদেশ থেকে আমদানী করা হয় সোডিয়াম ক্লোরাইড । এতে করে সরকার বছরে প্রায় ৭০০ কোটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে । এ বিষয়টি নিয়ে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সাথে কথাও হচ্ছে ।
ইন্ডাস্ট্রিয়াল সল্ট বাজারে প্যাকেটজাত করে বিক্রির অভিযোগের সত্যতা স্বীকার করে জেলা প্রশাসনের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করে বলেন, ভ্রাম্যমাণ আদালতে ইতিমধ্যে বেশ কয়েকজনকে জেল জরিমানা করা হয়েছে। এর সঙ্গে জড়িতদের আইনের আওতায় আনা উচিৎ। মূলত: শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন কয়েকজন কর্মকর্তা এই দূর্ণীতির সাথে জড়িত । বিশেষ করে জেলা বিসিক এর আয়োডিন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা এই বিসয়ে সবচাইতে বেশী দূর্ণীতির সাথে যুক্ত । তাকে কঠোরভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করলেই বেড়িয়ে আসেব ধলের বিড়াল ।
উল্লেখ কোরবানীর ঈদকে সামনে রেখে রাজস্ব ফাঁকির সাথে যুক্ত চিহ্নিত এই লবন সিন্ডিকেট আরো বেশী মারাত্মক আকার ধারণ করেছে কাঁচা চামড়ায় লবন ব্যবহারের কারণে । ১২ আগষ্ট থেকে এই ইন্ডাষ্ট্রিয়াল লবন আরো অধিক দামে বিক্রি করে হাতিয়ে নিয়েছে বিশাল অর্থ । যা দেখার জন্য কোন সংস্থা ই কাজ করে নাই নিয়মিত মাসোয়ারা গ্রহণের কারণে । বিগত সময়ে এমন অপরাধীদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালিত হলেও দীর্ঘদিনে অপরাধীদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়ার নজীর নেই বলে জানিয়েছেন দেশীয় লবন ব্যবসায়ীরা ।
Discussion about this post