নারায়ণগঞ্জে তল্লা মসজিদের ট্রাজেডিতে মৃত্যুর সংখ্যা ৩৪, এমন ঘটনার ক্ষত কেটে উঠতে না উঠতেই আবার নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীতে সলিলসমাধি ঘটেছে ৩৪ জনের ! নারায়ণগঞ্জ মহানগরীতে মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে দুটি পৃথক ঘটনায় ৩৪ + ৩৪ = ৬৮ জনের নির্মম মৃত্যুর ঘটনায় নিহতদের নিয়ে নানাভাবে বাণিজ্য চালিয়েছে একাধিক চক্র ! এখনো চলছে ওই চক্রের চৌর্যবৃত্তি ! শীতলক্ষ্যা নদীতে নিহত ৩৪ পরিবারের সদস্যদের সাথে ১ লাখ টাকা করে প্রদানের ঘটনায় গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের পর তোলপাড়ের সৃষ্টি হয় নগরজুড়ে ।
এমন ঘটনায় দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার অনুরোধে বলেন, “৩৪ প্রাণহানির ঘটনায় মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে মোটা অংকের ঘুষ গ্রহণের পর এক কর্মকর্তার মা মারা যান । ৩৪ জনের মৃত্যু নিয়ে তামাশা করার সময় মায়ের মৃত্যুতেও ঘুষ গ্রহণ থেকে পিছু হটেন নাই এই কুলাংগার মহাদূর্ণীতিবাজ কর্মকর্তা । এর চাইতে বড় আশ্চর্যের আর কি হতে পারে ?
নারায়ণগঞ্জ থেকে মুন্সীগঞ্জ যাওয়ার পথে সদর উপজেলার সৈয়দপুর এলাকায় শীতলক্ষ্যায় ‘এসকেএল-৩’ নামের কার্গো জাহাজের ধাক্কায় লঞ্চডুবিতে ৩৪ জন নিহত হওয়া স্বজনদের মধ্যে ৩০ জনের পরিবারকে দেয়া হয়েছে ১ লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ। জুডিশিয়াল স্টাম্পে সই নিয়ে তাতে লেখা হয়েছে ‘পরিবারের আর কোন দাবী দাওয়া নেই এমন অনাপত্তির কথা।’ নিহত অপর ৪ জনের পরিবার এই টাকা গ্রহণে অস্বীকৃতি জানিয়ে ক্ষতিপূরণ প্রত্যাখ্যান করেছেন। একই সাথে মামলার তদন্ত কার্যক্রম ও বিচার নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন তারা।
এ মাসের প্রথম সপ্তাহে নিহত ৩৪ জনের পরিবারকে নারায়ণগঞ্জে ডেকে আনা হয় ক্ষতিপূরণ দেয়ার কথা বলে। সেখানে তাদের প্রত্যেকের হাতে তুলে দেয়া হয় ১ লাখ টাকা। এসময় ক্ষতিপূরণ গ্রহণ করা ব্যক্তিদের একটি কাগজে স্বাক্ষর করতে বলা হয়। পরবর্তীতে সেই স্বাক্ষরকৃত কাগজে ভুক্তভোগী পরিবারের লোকজনের আর কোন দাবী দাওয়া নেই এমন তথ্য জানানো হয়। যদিও অধিকাংশ গ্রহীতারাই এই বিষয়টি সম্পর্কে অবগত নন।
২৪ মে ক্ষমতাসীন সাংসদের মালিকানাধীন কার্গো জাহাজ ‘এসকেএল ৩’ ছেড়ে দেয় সদর নৌ থানা পুলিশ। এর আগে ২৩ মে নারায়ণগঞ্জের সিনিয়র জুড়িশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আহমেদ হুমায়ুন কবীরের আদালত জাহাজটি ১ কোটি ৮৫ লাখ টাকা বন্ডে মালিকের কাছে হস্তান্তরের আদেশ দেন। একই সাথে এই মামলায় জামিনে পেয়েছেন জাহাজের চালক সহ ১৪ স্টাফ। তবে নিহত পরিবারের মাঝে ১ লাখ করে ক্ষতিপূরনের টাকা প্রদানে সহায়তা করেছেন খোদ তদন্তকারী কর্মকর্তা এমনটাই অভিযোগ উঠেছে পরিবারের পক্ষ থেকে।
জানা যায়, ‘এমভিএসকেএল-৩’ নামের কার্গো জাহাজটির মালিক হলেন বাগেরহাট-২ আসনের আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য শেখ সারহান নাসের তন্ময়ের মালিকানাধীন শেখ লজিস্টিক কোম্পানি।
ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা জানান, মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা আমাদের ফোন দিয়ে জানান আমাদের নাকি ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে। প্রথমে নারায়ণগঞ্জ জেলা পরিষদ থেকে ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে এমনটাই জানতাম। কিন্তু পরে শুনি এটি জাহাজের মালিক এই টাকা পাঠিয়েছেন। টাকা গ্রহণ করার পর আমাদের কাছ থেকে কাগজে স্বাক্ষর নেয়। সেখানে কি লেখা ছিলো আমাদের জানার সুযোগ হয়নি।
লঞ্চ দুর্ঘটনায় নিহত হওয়াদের মধ্য থেকে ৫টি পরিবারের সদস্যদের সাথে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। এদের মধ্যে নিহত বিথি আক্তারের (১৮) চাচা মিঠু জানান, তাদের পরিবারকে ১ লাখ টাকা অর্থ সহায়তা দেয়ার কথা তিনি জানতে পেরেছেন। এই সহায়তা দেয়া হয়েছে জাহাজ মালিকের পক্ষ থেকে। তিনি নিজে না গেলেও পরিবারের অন্য সদস্যরা সেই টাকা নারায়ণগঞ্জ থেকে নিয়ে এসেছেন।
দুর্ঘটনায় নিহত প্রতিমা দাসীর (৫৩) স্বামী পৃথ্বীম্বয় ঘোষ বলেন, নারায়ণগঞ্জের একটি মসজিদের পাশে খোকন সাহা নামে একজন অ্যাডভোকেটের চেম্বারে আমাদের ১ লাখ টাকা দেয়া হয়েছে। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ইউনুস আমাদের ফোন করে জানান যে আমাদের ক্ষতিপূরন দেয়া হবে। টাকা দেয়ার পর আমাদের কাছ থেকে সাক্ষর রাখা হয় একটি কাগজে। মন ভালো না থাকায় সেখানে কি লেখা ছিলো তা পড়ে দেখিনি।
তবে এ খোকন সাহা কি মহানগর আওয়ামী লীগের সেক্রেটারী কি না সেটা নিশ্চিত করতে পারেনি টাকা নিতে আসা নিহতের স্বজনেরা।
নিহত হাফিজুর রহমানের (২৪) মামা ইদ্রিস আলী বলেন, ‘‘হাফিজুরের বাবা খায়রুল হাওলাদার নারায়ণগঞ্জ গিয়ে ১ লাখ টাকা আনছে শুনছি। আমি একটু দূরে আছি তাই যাইতে পারিনাই সেদিন। শুনলাম নারায়ণগঞ্জ জেলা পরিষদের পক্ষ থিকা নাকি টাকা দিসে। এক পুলিশের লোক ফোন দিয়া কইসে ক্ষতিপূরণের টাকা আনতে। নারায়ণগঞ্জের একটা মসজিদের পাশে এক অ্যাডভোকেটের অফিসে ওই টাকা হাফিজুরের বাপের হাতে দিসে। টাকা নেওয়ার পর কোন সিগনেচার দিসে কিনা ওইটা আমি বলতে পারিনা।’’
নিহত মহারানীর (৩৭) মেয়ে জানান, আমার আম্মাকে যে নিয়ে আসছিলো সে আমাদের একদিন ফোন করে জানায় নারায়ণগঞ্জ গিয়ে ১ লাখ টাকা নিয়ে আসতে। আমরা পরে নারায়ণগঞ্জের একটা মসজিদের পাশে অ্যাডভোকেটের চেম্বার থেকে টাকা নিয়ে আসি। কে ফোন দিসিলো ওইটা আমি জানিনা। আর টাকা নেয়ার সময় তো সিগনেচার দেয়া লাগেই, সেই হিসেবে সিগনেচার দিয়েছি আমরা।
তবে ব্যতিক্রমী অবস্থানে দাঁড়িয়েছেন নিহত বেবী বেগমের ভাই আহসানউল্লাহ। তিনি বলেন আমাদের এক পুলিশ ফোন দিয়ে ১ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ আনতে বলেছিলো। কিন্তু আমাদের জাহাজ মালিকের টাকার প্রয়োজন নেই। আমরা বিচার চেয়েছি তার। তার টাকা নেয়া মানে এক প্রকার আপোষ করে ফেলা। আর একটা মানুষের জীবনের মূল্য টাকা দিয়ে নির্ধারন করা সম্ভবনা। সেজন্য আমরা কেউই সেই টাকা নিতে যাইনি।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সদর নৌ থানার এসআই ইউনুস বলেন, আমি ফোন দিয়ে টাকা আনতে বলবো কেন ? আমি তো মামলার তদন্তকাজ করছি। আমি কাউকে ফোন দেইনি।
এসময় ভুক্তভোগী পরিবারের কথা তুলে ধরা হলে তিনি নৌ থানায় চা পানের দাওয়াত দেন এই প্রতিবেদককে।
সদর নৌ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সহিদুল আলম বলেন, মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার কাউকে ফোন দিয়ে আনার কথা না। তিনি এই কাজ করতেও পারেন না। আমি বিষয়টি দেখছি।
এ ব্যাপারে মহানগর আওয়ামী লীগের সেক্রেটারী অ্যাডভোকেট খোকন সাহার কাছে জানতে চাইলে তিনি বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, আমার কার্যালয়ে বা আমার সামনে এমন কোন টাকা দেয়া হয়নি। তবে আমি জানি মালিকপক্ষ ৩০ জনকে ১ লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরন দিয়েছে। বাকি ৪ জন এই টাকা নিতে রাজি হয়নি।
মামলায় মালিকপক্ষের ক্ষতিপূরণ ও আসামীদের জামিন প্রসঙ্গে নারায়ণগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ আদালতের প্রসিকিউটর (পিপি) মনিরুজ্জামান বুলবুল বলেন, পৌনে ২ কোটি টাকা বন্ডে জাহাজ ছেঁড়ে দেয়া হয়েছে এমন বিষয় আমার জানা নেই। আমি শুধু জানি ভুক্তভোগীদের মধ্যে কয়েকজন বাদে বাকিরা আপোষ করেছে। এখন মামলা তার নিজস্ব গতিতে চলবে। যদি প্রমান হয় ইচ্ছাকৃত ভাবেই এই দুর্ঘটনা ঘটেছে তাহলে দোষি ব্যক্তি সাজা পাবে।
৪ এপ্রিল বিকেল ৬টায় নারায়ণগঞ্জের লঞ্চ টার্মিনাল থেকে অর্ধশতাধিক যাত্রীবাহী ‘এমভি সাবিত আল হাসান’ নামে লঞ্চটি মুন্সিগঞ্জের উদ্দেশ্যে যাওয়ার সময়ে সদর উপজেলার সৈয়দপুর কয়লাঘাট এলাকায় শীতলক্ষ্যা নদীতে পিছন থেকে এসে ‘এমভি-এসকেএল-৩’ নামে একটি কার্গো জাহাজ ধাক্কা দিয়ে লঞ্চটিকে ডুবিয়ে দিয়ে পালিয়ে যায়। একে ৩৪ জনের প্রাণহানি ঘটে। নিহতরা সকলেই মুন্সীগঞ্জের বাসিন্দা। তারা হলেন নিহতরা হলেন, ‘রুনা আক্তার (২৪), সোলেমান ব্যাপারী (৬০), বেবী বেগম (৬০), সুনিতা সাহা (৪০), পখিনা বেগম (৪৫), বিথী (১৮), অরিফ (১), প্রতিমা শর্মা (৫৩), শামসুদ্দিন (৯০), রেহেনা বেগম (৬৫), হাফিজুর রহমান (২৪), তহমিনা (২০), আব্দুল্লাহ (১), নারায়ণ দাস (৬৫), পার্বতী রানী দাস (৪৫), আজমীর (২), শাহআলম মৃধা (৫৫), মহারাণী (৩৭), আনোয়ার হোসেন (৫৫), মাকসুদা বেগম (৩০), সাউদা আক্তার লতা (১৮), আব্দুল খালেক (৭০), জিবু (১৩), খাদিজা বেগম (৫০), মোহাম্মদ নয়ন (২৯), সাদিয়া আক্তার (৭), বিকাশ সাহা (২২), ও মানসুরা (৭ মাস), অনিক সাহা (১২), জাকির হোসেন (৪৫), তানভীর হোসেন হৃদয়, রিজভী (২০), মো. ইউসুফ কাজী, মো. সোহাগ হাওলাদার (২৩)।
পরে বিআইডব্লিউটিএ নারায়ণগঞ্জ নদী বন্দরের সহকারী পরিচালক বাবু লাল বৈদ্য অজ্ঞাত আসামি করে মামলা দায়ের করেন। এ মামলায় মুন্সিগঞ্জের গজারিয়া এলাকার মেঘনা নদী থেকে এমভি-এসকেএল-৩ নামের কার্গো জাহাজ ও জাহাজের মাস্টার, সুকানী সহ ১৪ আটক করে নৌ পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে কোস্ট গার্ড।
সবচাইতে আশ্চর্যের বিষয় এই এমভি-এসকেএল-৩ নামের কার্গো জাহাজটি মাত্র তিনদিনের মধ্যেই পুরো রঙ পরিবর্তন করে নিজেদের আড়াল করার অপচেষ্টা চালায় । জাহাজটির ভিডিও ফুটেজ ও মালিকানা গণমাধ্যমে প্রকাশিত না হলে এই কার্গো জাহাজ আটক তো অনেক দূরের বিষয় কেউ এই জাহাজটি স্পর্শও করতে সাহস করতো না । এমন মন্তব্য দায়িত্বশীল উপরোল্লিখিত ওই কর্মকর্তার ।
Discussion about this post