নারায়ণগঞ্জ শহরের নানা শ্রেণি পেশার মানুষের বিরোধীতা, আপত্তির পরও উদ্বোধন হতে যাচ্ছে প্যারাডাইজ ভবনে মদের বার। নারায়ণগঞ্জ জেলা মাদবদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের ‘বিভাগীয় অনাপত্তি (এনওসি)’ পত্রও পেয়েছে বার কর্তৃপক্ষ। এ নিয়ে সর্বত্রই চলছে ক্ষোভ।
শহরের চাষাড়া ভাষা সৈনিক রোডের প্যারাডাইজ ক্যাসেল নামক ভবনের ৯-১১ নম্বর ফ্লোর নিয়ে তৈরি মদের বার উদ্বোধনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে এর কর্তৃপক্ষ। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন থেকে রেস্টুরেন্ট ব্যবসার কথা বলে ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে এর আড়ালেই বার ব্যবসা চালানোর সব আয়োজন সম্পন্ন করা হয়েছে।
এদিকে নগরবাসীর এত বিরোধীতার পরও রেস্টুরেন্ট ব্যবসার জন্য ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে মদের বার করার হচ্ছে, যা সম্পূর্ণ অনৈতিক আখ্যা দিয়েছেন সচেতন মানুষ। কেননা, ট্রেড লাইসেন্সে ব্যবসার ধরণ দেয়া থাকে। সেই ধরণের মধ্যে রয়েছে ‘রেস্টুরেন্ট’। তাই প্রশ্ন উঠেছে, রেস্টুরেন্টের আড়ালে মদের বার, কী করে হয়? এ ব্যাপারে সিটি করপোরেশনের কী কিছুই করার নেই?
যদিও নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এএফএম এহতেশামূল হক এ প্রসঙ্গে ঘণমাধ্যমকে বলেন, “ট্রেড লাইসেন্সে ব্যবসার ধরণ দেওয়া আছে। সে ধরণ অনুযায়ী ব্যবসা বৈধ । এর বাইরে অন্য কোনো ব্যবসা পরিচালনা করলে সেটি অবৈধ । তবে, মদের বার, এটা দেখার জন্য আলাদা ডিপার্টমেন্ট আছে । তারা দেখবে সে বিষয়টি।”
সূত্র জানায়, বার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের সুপারিশে, এ লাইসেন্স দেয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এ জন্য মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরে (সদর) আবেদন করতে হয়। আবেদনে উল্লেখিত এলাকা বা স্থানসহ জনসাধারণের এ নিয়ে কোনো বিরোধীতা, আপত্তি আছে কিনা, এমন জানতে চেয়ে সদর দফতর থেকে প্রতিবেদন চাওয়া হবে সংশ্লিষ্ট এলাকার মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কাছে। সেটিকে বলা হয়ে থাকে বিভাগীয় আনাপত্তি পত্র (এনওসি)।
অর্থাৎ, আবেদনে উল্লেখিত স্থানে বার প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে, এতে সাধারণ মানুষের সমস্যা হবে না, ইত্যাদি বিষয়ে সংশ্লিষ্ট জেলা থেকে ‘এনওসি’ পাওয়ার পর বারের জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ে সুপারিশ করবে মাদকদ্রব্য অধিদফতর হেডকোয়ার্টার। এই সুপারিশ পর্যালোচনা করে বার প্রতিষ্ঠার লাইসেন্স ইস্যু করা হয়ে থাকে।
সূত্র জানায়, নারায়ণগঞ্জ জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর থেকে ‘বিভাগীয় আনাপত্তি (এনওসি)’ পেয়েছে ব্লু পেয়ারের মালিক গাজী মুক্তার। এই অনাপত্তি পত্র পাওয়ার পরই তিনি প্যারাডাইজ ভবনে বার প্রতিষ্ঠার আনুসাঙ্গিক কার্যপ্রণালী শুরু করেন।
তবে, নারায়ণগঞ্জ শহরের মত ছোট্ট একটা শহরে, যেখানে অসংখ্য মানুষের আপত্তি রয়েছে বার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সেখানে নারায়ণগঞ্জ জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর থেকে কীভাবে এনওসি দেওয়া হলো, এ নিয়ে দেখা দিয়েছে নানা প্রশ্ন।
এ ব্যাপারে জানতে থেকে যোগাযোগ করা হয়েছিলো নারায়ণগঞ্জ জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের সহকারি পরিচালক সামসুল আলমের সাথে। তিনি মুঠোফোনে এই প্রতিবেদককে জানান, “এটি (ব্ল পেয়ার) এখনও তো চালু হয়নি । আর এটি একটি রেস্টুরেন্ট। তাছাড়া আমরা কোনো এনওসি দিইনি । এ প্রসঙ্গে হেড কোয়ার্টারে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলেন। এ বিষয়ে কথা বলার আমাদের কোনো এখতিয়ার নেই ।”
অন্যদিকে ব্লু পেয়ার বারের মালিক গাজী মুক্তার দাবি করেছেন, “তিনি নারায়ণগঞ্জ জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের এনওসি পেয়েছেন। সেই এনওসি হেডকোয়ার্টরের পাঠোনোর পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় লাইসেন্স দিয়েছে।”
জানা গেছে, ভাষা সৈনিক রোডের প্যারাডাইজ ভবনের তিনটি ফ্লোর ৪০ লাখ টাকা অ্যাডভান্সে ভাড়া নিয়ে ‘ব্লু পেয়ার’ নামক একটি সুসজ্জিত বারের ডেকোরেশনের কাজ সম্পন্ন করেন এর মালিক গাজী মুক্তার। তিনি চাঁদপুরের মতলব উত্তর উপজেলার জহিরাবাদ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি । সর্বশেষ তিনি মতলব উত্তর উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থী হতে মাঠে নেমেছিলেন । তবে, শেষতক সেটি আর হয়ে উঠেনি। ঢাকায় তার আরও একটি বার রয়েছে।
সূত্র থেকে আরও জানা যায়, বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে দুটি মদের বারের অনুমোদন পান গাজী মুক্তার । যার একটি ঢাকায় চালু করেন এবং অপরটির জন্য নারায়ণগঞ্জ বেছে নিয়েছেন । এখানকার একজন আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতার লবিং ধরে প্যারাডাইজ ভবনের তিনটি ফ্লোর ভাড়া নেন তিনি ।
আরও জানা গেছে, গাজী মুক্তারকে ইতোপূর্বে বেশ কয়েকবার শহরের একটি ক্লাবে জনৈক আওয়ামী লীগ নেতার সাথে দেখা গেছে। ওই আওয়ামী লীগ নেতার বাড়িও মতলবে । সেই সুবাধে গাজী মুক্তারের সাথে পরিচয়। পাশাপাশি এই মুক্তার নারায়ণগঞ্জস্থ মতলব উত্তর সমিতির একজন উপদেষ্টা । তিনি স্ব পরিবারে বসবাস করেন ঢাকার গুলশানে ।
এছাড়াও দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণায়লয়ের সাবেক মন্ত্রী মায়া চৌধুরীর ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত গাজী মুক্তার। পাশাপাশি তিনি র্যাবের হাতে গ্রেফতার ক্যাসিনো সম্রাট যুবলীগ নেতা সম্রাট ও খালিদের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠজন হিসেবে কথিত রয়েছে ।
জহিরাবাদ ইউনিয়নের নাওভাঙ্গা জয়পুর উচ্চ বিদ্যালয়ে লেখাপড়া অবস্থায় ছাত্রলীগের রাজনীতিতে যুক্ত হন গাজী মুক্তার। ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত জহিরাবাদ ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ১৯৯৮ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত একই সংগঠনের সভাপতির হন। বর্তমানে তিনি জহিরাবাদ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি।
রাতারাতি অঢেল ধন সম্পদের মালিক বনে যাওয়া গাজী মুক্তার মতলব উত্তর উপজেলার জহিরাবাদ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি হলেও তিনি থাকেন গুলশানে। জহিরাবাদের রাজনীতিতে তেমন একটা সময় দিতে পারেন না। তার মূল কাজকর্মই ঢাকা কেন্দ্রিক। সম্রাট, খালিদদের সাথে তার সখ্যতা ছিলো। ধারণা করা হয়ে থাকে, অবৈধ ক্যাসিনো ব্যবসাতেও তার সম্পৃক্ততা রয়েছিলো ।
এ প্রসঙ্গে জহিরাবাদ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি গাজী মুক্তার হোসেনের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি গণমাধ্যমকে জানান, এখানে কোনো অবৈধ কিছু হবে না। বৈধ ভাবেই ব্যবসা করা হবে। সরকারি সকল নিয়ম কানুন মেনেই রেস্টুরেন্ট অ্যান্ড বার চালু করতে যাচ্ছি । আমি একজন ব্যবসায়ী । এখানে কোনো আওয়ামী লীগ নেতার সাথে পূর্ব পরিচত নই । কোনো ক্লাবেও যাইনি । এখানকার কোনো সমিতর সাথেও আমার সম্পৃক্ততা নেই ।
এদিকে বার এর লাইসেন্স প্রসঙ্গে সরকারি বিধিতে স্পষ্ট করেই লেখা আছে, বার পরিচালনার বিষয়ে স্থানীয় ওয়ার্ড কমিশনার/পৌর চেয়ারম্যানের অনাপত্তিপত্র (সংসদ কার্যকর না থাকলে), স্থানীয় সংসদ সদস্যের অনাপত্তিপত্র, জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের মতামত (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে)। এছাড়াও প্রতিষ্ঠানটির আশেপাশে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং ধর্মীয় উপাসনালয় থাকবে না। কিন্তু ব্লু পেয়ার বার এর কাছেই শহরের কেন্দ্রীয় মসজিদ হিসেবে পরিচিত নূর মসজিদ, প্রেসক্লাব এবং আশপাশে বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে । এরপরও কীভাবে এই বার চালুর জন্য জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর আনাপত্তিপত্র দিলেন ?
নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করে নারায়ণগঞ্জ শহরের মদের বারের সাথে সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, সাংবাদিকদেরকে ম্যানেজ করতে সালাম নামের এক বিশেষ পেশার লোক ২৫ লাখ টাকা নিয়েছে । সকল সাংবাদিকদের ম্যানেজের কথা বলে এই সালাম কয়েকদফা প্যারাডাইস ক্যাবলসের মালিক ও বারের ব্যবসার মূল হোতা গাজী মুক্তারের সাথে কয়েকদফা বৈঠকও করেছেন । এখনো কোন কোন সাংবাদিকদের শায়েস্তা করতে সালাম নামের এই সাংবাদিকের সাথে নানা শলা পরামর্শ করে যাচ্ছেন বাড়ির মালিক ও বারের লাইসেন্সধারী মুক্তার । যিনি এক সময় রাজধানীতে হোটেলের বয়ের কাজ করতো । এখন তিনি বিশাল ধন সম্পত্তির মালিক । ,অবৈধ টাকার জোড়ে গাজী মুক্তার নারায়ণগঞ্জের কিছু নেতা ও প্রশাসনের লোকজনকে ম্যানেজ করেছেন । বাকী রয়েছে কিছু সাংবাদিক আর মসজিদ কমিটির লোকজন এবং প্রেস ক্লাবের কয়েকজন নেতা ।
Discussion about this post