আজমীর ওসমান । নারায়ণগঞ্জের একটি আলোচিত সমালোচিত নাম । প্রয়াত সংসদ সদস্য যাকে নিয়ে এখনো নেতাকর্মীরা নিরবে নিভৃতে কাঁদেন, তাদের অনেকেই এড়িয়ে চলেন আজমীর ওসমানকে। তার রয়েছে বিশাল হোন্ডা বাহিনী। রয়েছে আলোচনা আবার আজমীর ওসমানকে ঘিরে রয়েছে ব্যাপক সমালোচনা। নগরীর অনেকেই ভীতি নিয়ে এই প্রয়াত সাংসদপুত্র আজমীর ওসমানকে ‘হাজি সাহেব‘ বলে ডাকেন । আর এই অস্ত্রের লাইসেন্সের আবেদন করায় এরই মধ্যে সমালোচনার ঝড় উঠেছে সর্বত্র ।
কয়েকটি গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের পর এরই মধ্যে একজন পাঠক কঠোর সামালোচনা করে বলেছেন, “একজন খুনি লাইসেন্স পাওয়া তো পরে থাক কোন সাহসে আবেদন করে ? দেশে ক্ষমতা যাদের সব আইন তাদের । কোন বিচার নেই । অথচ ৩০ হাজার টাকা খেলাপি ঋন এর জন্য জেলে যাওয়া লাগে ।“
একটি বন্দুক, একটি পিস্তলের লাইসেন্সের জন্য আজমেরী ওসমানের আবেদনের বিষয়টি তদন্ত করে প্রতিবেদনও জমা দিয়েছে ফতুল্লা মডেল থানা–পুলিশ।
নারায়ণগঞ্জ-৫ (শহর-বন্দর) আসনের প্রয়াত সংসদ সদস্য নাসিম ওসমানের ছেলে আজমেরী ওসমান একটি বন্দুক ও একটি পিস্তলের লাইসেন্সের জন্য জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে আবেদন করেছেন। গত মাসে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে আবেদনটি করলে সেটি তদন্তের জন্য সম্প্রতি জেলা পুলিশ সুপারের বিশেষ শাখায় পাঠানো হয়।
পুলিশ সুপারের কার্যালয় থেকে সেটি তদন্তের জন্য থানা–পুলিশের কাছে পাঠালে গত সোমবার ফতুল্লা মডেল থানা–পুলিশ অস্ত্রের লাইসেন্স দেওয়ার বিষয়টি তদন্ত শেষে প্রতিবেদন দাখিল করেছে।
আজমেরী ওসমান নারায়ণগঞ্জ-৪ (ফতুল্লা-সিদ্ধিরগঞ্জ) আসনের আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য শামীম ওসমান ও নারায়ণগঞ্জ–৫ (শহর-বন্দর) আসনের জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য সেলিম ওসমানের ভাতিজা।
আজমেরী ওসমানের অস্ত্রের লাইসেন্সের আবেদনের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ফতুল্লা মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রিজাউল হক। তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, দুটি অস্ত্রের লাইসেন্সের আবেদন তদন্ত শেষে সোমবার ক-সার্কেল অফিসে প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে। অস্ত্রের লাইসেন্স দেওয়ার বিষয়টি পুলিশ সুপার সিদ্ধান্ত নেবেন।
পুলিশ সুপার (এসপি) গোলাম মোস্তফা রাসেল বলেন, আজমেরী ওসমানের অস্ত্রের লাইসেন্সের আবেদনটি তদন্তের জন্য থানা–পুলিশের কাছে পাঠানো হয়েছে। থানা–পুলিশ এখনো তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়নি। তাঁরা তদন্ত প্রতিবেদন পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
২০১৩ সালের ৬ মার্চ নারায়ণগঞ্জের মেধাবী ছাত্র তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী হত্যার ঘটনায় ওই বছরের ১২ নভেম্বর আজমেরী ওসমানের সহযোগী সুলতান শওকত ভ্রমর আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিতে জানান, আজমেরী ওসমানের নেতৃত্বে ত্বকীকে অপহরণের পর তাঁর টর্চার সেলে ১১ জন মিলে হত্যা করা হয়েছে। পরে আজমেরী ওসমানের গাড়িতে করেই ত্বকীর লাশ শীতলক্ষ্যার একটি শাখাখালে ফেলে দেওয়া হয়।
ত্বকী হত্যা মামলার তদন্তকারী সংস্থা র্যাব-১১ হত্যাকাণ্ডের এক বছর পর ২০১৪ সালের ৫ মার্চ খুনিদের শনাক্ত, হত্যার রহস্য উদ্ঘাটন ও অভিযোগপত্র প্রস্তুতের বিষয়টি জানিয়ে সংবাদ সম্মেলন করে। র্যাবের তৎকালীন অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল জিয়াউল আহসান সংবাদ সম্মেলনে জানান, আজমেরী ওসমানের নেতৃত্বে ১১ জন মিলে ত্বকীকে অপহরণের পর হত্যা করা হয়েছে। দ্রুতই আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করা হবে। কিন্তু অদ্যাবধি অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়নি।
সন্ত্রাস নির্মূল ত্বকী মঞ্চের আহ্বায়ক ত্বকীর বাবা রফিউর রাব্বি বলেন, ত্বকীর ঘাতক হিসেবে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিতে খুনি হিসেবে যাঁর নাম আসে, শহরে যিনি চার-পাঁচটি টর্চার সেল চালাতেন, যিনি টর্চার সেলে চাঁদার জন্য শহরের অসংখ্য ব্যবসায়ীকে এনে নৃশংসভাবে নির্যাতন করতেন এবং আশিক, চঞ্চল, ভুলু ও মিঠু হত্যাকারী হিসেবে যাঁর নাম সর্বত্র প্রচারিত, সেই আজমেরী ওসমান অস্ত্রের লাইসেন্স পেলে দেশে যে বার্তা যাবে, তা হচ্ছে দেশটা এখন খুনি-জল্লাদদের হাতে জিম্মি।
ত্বকী হত্যা ছাড়াও আজমেরী ওসমান ও তাঁর সহযোগীদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, চাঁদাবাজিসহ নানা অভিযোগ রয়েছে। তাঁর হুন্ডা বাহিনী (মোটরসাইকেল বাহিনী) শহর দাপিয়ে বেড়ায়। এই বাহিনীর বিরুদ্ধে জমি দখল, পোশাক কারখানায় চাঁদাবাজিসহ ভয়ভীতি দেখানোসহ নানা অপকর্মের অভিযোগ রয়েছে।
সর্বশেষ গত ১৬ মার্চ আজমেরী ওসমানের অর্ধশতাধিক ক্যাডার মোটরসাইকেল ও গাড়ির বহর নিয়ে বন্দর উপজেলার ফরাজিকান্দা এলাকায় ৬৬ শতাংশ জমি দখলের চেষ্টা চালান।
এ সময় বাধা দিলে আজমেরী ওসমানের ক্যাডারদের ছোড়া গুলিতে জমির মালিক মঈনুল পারভেজ ও তাঁর স্ত্রী গুলিবিদ্ধসহ ১৫ জন আহত হন। এই ঘটনায় ক্ষুব্ধ এলাকাবাসী ধাওয়া দিলে আজমেরী ওসমানের সহযোগীদের ফেলে যাওয়া দুটি মোটর সাইকেলে আগুন ধরিয়ে দেন এবং কয়েকটি মোটরসাইকেল ভাঙচুর করেন। ওই ঘটনার ২০ দিন পর চিকিৎসাধীন অবস্থায় গুলিবিদ্ধ মঈনুল হক পারভেজ মারা যান।
এর আগে ত্বকী হত্যাকাণ্ড নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করায় ২০২২ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি শহরের প্রেসিডেন্ট রোড এলাকায় নারায়ণগঞ্জের স্থানীয় দৈনিক সময়ের নারায়ণগঞ্জ পত্রিকা অফিসে মোটর সাইকেল বহর নিয়ে হামলা হয়। ওই ঘটনায় পত্রিকার সম্পাদক জাবেদ আহমেদ ঘটনার পর পর আজমেরী ওসমানের ১৯ সহযোগীসহ ৫৯ জনের বিরুদ্ধে নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানায় মামলা করেন।
সন্ত্রাসীদের অস্ত্রের লাইসেন্স দেয়ার ক্ষেত্রে জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনের সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত বলে মন্তব্য করেছেন জেলা আইনজীবী সমিতির সিনিয়র আইনজীবী সাখাওয়াৎ হোসেন খান।
তিনি বলেন, ‘কাউকে অস্ত্রের লাইসেন্স দেয়ার ব্যাপারে সরকারকে আবেদনকারীর সব দিক যাচাই বাছাই করতে হবে। অস্ত্রের অপব্যবহার হবে কিনা সেটাও বিবেচনা করতে হবে। কারণ যার তার হাতে অস্ত্রের লাইসেন্স গেলে সেটার অপব্যবহার হতে পারে। দেশ ও জনগণ হুমকির সম্মুখীন হতে পারে। আমি মনে করি রাজনৈতিক পরিচয়ের কাউকে অস্ত্রের লাইসেন্স দেয়া উচিত না। এছাড়া একাধিক ফৌজদারি মামলার অভিযুক্ত ব্যক্তিকে অস্ত্রের লাইসেন্স দেয়াও আইনসম্মত না।’
ক্যাডার সন্ত্রাসীদের অস্ত্রের লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রশাসন-পুলিশের সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত বলে মন্তব্য করেছেন জেলা বারের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আওলাদ হোসেন। তিনি বলেন, দুর্ধর্ষ ক্যাডার বা সন্ত্রাসীদের অস্ত্রের লাইসেন্স কখনোই দেওয়া উচিত নয়। আইনের কোনো ধারায় তাঁরা পেলেও সেটা দেওয়া উচিত হবে না। কারণ, তাঁরা নানা অপকর্ম করে বেড়ান।
আজমেরী ওসমান অস্ত্রের লাইসেন্সের জন্য আবেদন করেছেন, তা সুনির্দিষ্টভাবে জানতেন না বলে উল্লেখ করেছেন জেলা প্রশাসক মঞ্জুরুল হাফিজ। তিনি বলেন, ‘কেউ আবেদন করলেই যে অস্ত্রের লাইসেন্স পেয়ে যাবেন, বিষয়টি এমন নয়। পুলিশ তদন্ত করে প্রতিবেদন দেবে, পরবর্তী সময়ে আমরা সেটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠাব। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় লাইসেন্স দিতে পারে, আবার না–ও দিতে পারে।’
Discussion about this post