২০২২ সালের ৬ অক্টোবর নারায়ণগঞ্জ নিউজ আপডেট প্রকাশ করে, “গণপূর্তের পীর ! নারায়ণগঞ্জে প্রধান খাদেম হেলাল” শীর্ষক সংবাদে উল্লেখ ছিলো, “যে যায় লংকা, সে ই হয়ে যায় রাবণ !” এমন প্রবাদের সাথে মিল রেখে নারায়ণগঞ্জে গণপূর্ত অধিদপ্তরের অপকর্মের আখড়া স্থাপন করে চালিয়ে যাচ্ছে লুটপাটের মহোৎসব ।
এমন সংবাদ পর এবার দৈনিক কালবেলা তুলে এনেছে “গণপূর্তে পীরের বদলি কেরামতি” যা নিম্নে হুবহু তুলে ধরা হলো
দায়িত্ব পালনের দুই বছরেই বদলি, পুনর্বদলির ও পদায়নের রেকর্ড গড়েছেন গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ শামীম আখতার। এ সংক্রান্ত ৪২৭টি ফাইলে সই করেছেন তিনি। এর মধ্য দিয়ে ১ হাজার ৩১ কর্মকর্তা-কর্মচারীর বদলি, পুনর্বদলি ও পদায়ন হয়েছে। এত অল্প সময়ে রেকর্ডসংখ্যক কর্মকর্তা-কর্মচারীর বদলি, পুনর্বদলি ও পদায়ন এর আগে কখনো হয়নি।
উপসহকারী প্রকৌশলী, সহকারী প্রকৌশলী, উপবিভাগীয় প্রকৌশলী, নির্বাহী প্রকৌশলী থেকে শুরু করে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী, বাদ যাননি কেউই। বদলি-পদায়ন স্বাভাবিক বিষয় হলেও গণপূর্তে এ নিয়ে চলছে তুঘলকি কাণ্ড। আক্রোশের শিকার হচ্ছেন অভিজ্ঞ প্রকৌশলীরা, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প। এরই মধ্যে বদলি, পুনর্বদলির ও পদায়ন নিয়ে বিধিমালা তৈরির জন্য গণপূর্ত অধিদপ্তরকে নির্দেশ দিয়েছে মন্ত্রণালয়। অনুসন্ধানে এ তথ্য বেরিয়ে এসেছে।
তবে বদলি, পুনর্বদলি ও পদায়ন নিয়ে রেকর্ড সৃষ্টির অভিযোগ অস্বীকার করেন প্রধান প্রকৌশলী শামীম আখতার। বলেন, এর কোনোটি বাস্তবতা, কোনোটি মানবিক আর কোনোটি তদবিরের কারণে হয়েছে।
তথ্য বলছে, বদলি-পদায়নের ফাইলে সই করে বাধার মুখেও পড়েছেন শামীম আখতার। ২০২১ সালের আগস্ট থেকে চলতি বছরের ১৯ জানুয়ারি পর্যন্ত ২৪টি ফাইলে সই করে শেষ পর্যন্ত তা স্থগিত করতে বাধ্যও হয়েছেন। বদলি, পুনর্বদলি ও পদায়নের নজির সৃষ্টি করায় গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় নাখোশ তার ওপর। আদেশ জারির মাধ্যমে বদলি-পদায়নের ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছে মন্ত্রণালয়। গত ২০ ডিসেম্বর গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের প্রশাসন অধিশাখা-১-এর যুগ্ম সচিব শেখ নূর মোহাম্মাদের সই করা চিঠিতে বলা হয়, ‘সম্প্রতি গণপূর্ত অধিদপ্তরের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের হয়রানিমূলক বদলিসংক্রান্ত অভিযোগের বিষয়টি বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে এবং বিষয়টি মন্ত্রণালয়ের নজরে এসেছে। সমন্বয়হীনভাবে এ ধরনের বদলি করায় গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে। এ অবস্থায় মন্ত্রণালয় থেকে পুনরাদেশ না দেওয়া পর্যন্ত গণপূর্ত অধিদপ্তরের তার নিয়ন্ত্রণাধীন সব ধরনের বদলি বা পদায়নসংক্রান্ত কার্যক্রম বন্ধ রাখার জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালযয়ের সচিব কাজী ওয়াছি উদ্দিন জানান, গত বছরের ২২ সেপ্টেম্বর সচিব হিসেবে যোগ দিয়েছেন। তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর গণপূর্ত অধিদপ্তরে খুব বেশি বদলি-পদায়ন হয়নি। সবশেষ বদলি-পদায়নের আদেশ তার নির্দেশেই ঠেকিয়ে দেওয়া হয়েছে জানিয়ে ওয়াছি উদ্দিন বলেন, বিধিমালা তৈরি করতে বলেছি। বিধিমালা তৈরি না হওয়া পর্যন্ত বদলি বন্ধ থাকবে।
নজিরবিহীন বদলি, পুনর্বদলি ও পদায়ন
অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০২০ সালের ১৪ ডিসেম্বর গণপূর্তে প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে যোগ দিয়ে ওই মাসেই ৭২ জনের বদলি, পুনর্বদলি ও পদায়ন করেন শামীম আখতার। ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে ৩১ জন, ফেব্রুয়ারিতে ২৩, মার্চে ৭৮, এপ্রিলে ১, মে মাসে ৬, জুনে ৪৬, জুলাইয়ে ৮, আগস্টে ৩৮, সেপ্টেম্বরে ৩৫, অক্টোবরে ৭১ জন এবং নভেম্বরে ২১৪ জনের বদলি এবং ডিসেম্বরে ৪৭ জনকে বদলি, পুনর্বদলি ও পদায়ন করেন তিনি। তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের জানুয়ারি মাসে ২৭ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৫৮ জন, মার্চে ৩৯ জন, মে মাসে ২৬ জন, জুনে ২০, জুলাই মাসে ১৫, আগস্টে ৪, সেপ্টেম্বরে ৩৫ জন, অক্টোবরে ৩৫ জন, নভেম্বরে ৪৩ জন এবং ডিসেম্বরে ৫৯ জনের বদলি, পুনর্বদলি ও পদায়ন হয়। তথ্য বলছে, প্রথম শ্রেণির (ক্যাডার-নন ক্যাডার) ৯৪২ কর্মকর্তাসহ গণপূর্তর মোট জনবল ১৩ হাজার ৮৩৪ জন। ১৪ জন অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (সিভিল), ২ জন অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (ইলেকট্রো মেকানিক্যাল), ৪৬ জন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ছাড়া প্রত্যেকেই বদলি- পুনর্বদলির আতঙ্কে আছেন। অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী ও তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীর বদলি, পুনর্বদলি ও পদায়নের এখতিয়ার মন্ত্রণালয়ের।
বদলি-পদায়নে প্রধান প্রকৌশলীর সহযোগী চার প্রকৌশলী
অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী, নির্বাহী প্রকৌশলী, উপবিভাগীয় প্রকৌশলী, সহকারী প্রকৌশলী, উপসহকারী প্রকৌশলীসহ গণপূর্তের ১৬ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বদলি, পুনর্বদলি ও পদায়নে প্রধান প্রকৌশলীসহ পাঁচজনের সিন্ডিকেটের কথাই শেষ কথা। সিন্ডিকেটের অন্য সদস্যরা হলেন অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (সংস্থাপন ও সমন্বয়) মো. শহীদুল আলম, ঢাকা গণপূর্ত জোনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মোসলেহ উদ্দীন আহাম্মদ, গণর্পূত ঢাকা মেট্রোপলিটন জোনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. নাছিম খান ও গণপূর্ত মিরপুর ডিভিশনের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সাইফুজ জামান।
শামীম আখতার, পেশার বাইরে পীর হিসেবে পরিচিতি যার
শামীম আখতারের গ্রামের বাড়ি রাজশাহীর বাঘা উপজেলায়। পড়াশোনা করেছেন রাজশাহী ক্যাডেট কলেজ ও বুয়েটে (বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়)। বিসিএস (পাবলিক ওয়ার্কস) ক্যাডারে ১৫তম (১৯৯৫) ব্যাচের কর্মকর্তা তিনি। ১৯৯৮ সালে উপবিভাগীয় প্রকৌশলী, ২০০৮ সালে নির্বাহী প্রকৌশলী, ২০১৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ও ২০১৮ সালে অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে পদোন্নতি পান। ২০১৮ সালের ৮ মে হাউজিং অ্যান্ড বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউটে (এইচবিআরআই) পরিচালক হিসেবে যোগ দেন। পরে একই প্রতিষ্ঠানে পদোন্নতি পেয়ে মহাপরিচালক হন। ২০২০ সালের ১৪ ডিসেম্বর গণপূর্ত অধিদপ্তরে প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে যোগ দেন।
প্রকৌশলী পেশার বাইরে পীর হিসেবেও পরিচিতি আছে তার। নারায়ণগঞ্জের ভূঁইগড়ের হাকিমাবাদ খানকা-ই-মোজাদ্দেদিয়ার পীর তিনি। পীর সাহেব হজরত মোহাম্মদ শামীম আখতার (মাদ্দাজিল্লুহুল আলিয়াহ) নামে মুরিদদের কাছে পরিচিতি তার।
হাকিমাবাদ খানকা-ই-মোজাদ্দেদিয়ার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন মোহাম্মদ মামুনুর রশীদ। তার মুরিদ ছিলেন শামীম আখতার। মামুনুর রশীদের একমাত্র মেয়ে আরজুমান্দ বানুর সঙ্গে বিয়ে হয়েছে তার। ২০১৬ সালের মামুনুর রশীদের মৃত্যু হয়। হাকিমাবাদ খানকা-ই-মোজাদ্দেদিয়ার উত্তরাধিকার হিসেবে পীর হন প্রকৌশলী শামীম আখতার। হাকিমাবাদ খানকা-ই-মোজাদ্দেদিয়ার সম্পদ আছে কম্বোডিয়ায়। সেখানে অর্গানিক খামারের মালিক হাকিমাবাদ খানকা। নেপথ্যে আছেন শামীম আখতার। প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরও বিষয়টি অবগত আছে।
গত ১৯ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় প্রকৌশলী শামীম আখতারের অনিয়ম, দুর্নীতির বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে গৃহায়ন ও গণপূর্ত সচিবের কাছে একটি চিঠি পাঠায়। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পরিচালক-৩ আবদুল্লাহ আল খায়রুমের সই করা ওই চিঠির শিরোনাম হলো—‘গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী এবং এইচবিআরআইর (হাউজিং অ্যান্ড বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউট) সাবেক মহাপরিচালক লেবাসধারী ভন্ডপীর মো. শামীম আখতারের দুর্নীতি প্রসঙ্গে।’ চিঠিতে বলা হয়, এ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তদন্তপূর্বক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে গৃহীত ব্যবস্থা সম্পর্কে অবহিত করতে হবে।’
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে পাঠানো চিঠির সঙ্গে ১০ পাতার অভিযোগ সংযুক্ত আছে। অভিযোগে বলা হয়, ‘গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ শামীম আখতার। তার আরেকটি পরিচয়ও রয়েছে। তিনি নারায়ণগঞ্জের ভূঁইগড়ের হাকিমাবাদ খানকা-ই-মোজাদ্দেদিয়ার ‘পীর সাহেব’। কম্বোডিয়াসহ বাংলাদেশের কয়েকটি স্থানেও রয়েছে এ খানকার শাখা। পীরের মুরিদরা গণপূর্ত অধিদপ্তরের তালিকাভুক্ত ঠিকাদার। বাস্তবায়ন করছেন মোটা অঙ্কের উন্নয়নকাজ। নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে গণপূর্ত অধিদপ্তরসহ গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন সংস্থা থেকে সুযোগ-সুবিধাও আদায় করে নিচ্ছেন।’
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে শামীম আখতারের অনিয়ম-দুর্নীতির তদন্তে ৩ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠন করে মন্ত্রণালয়। ২ জানুয়ারি গঠন করা ওই কমিটির আহ্বায়ক হন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ড. মো. আশফাকুল ইসলাম বাবুল। অন্য দুই সদস্য হলেন যুগ্ম সচিব মুহাম্মদ সোহেল হাসান ও যুগ্ম সচিব মো. জহিরুল ইসলাম খান। ১৫ কর্মদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেবে তদন্ত কমিটি।
তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন জমা হয়েছে কিনা জানতে চাইলে সচিব কাজী ওয়াছি উদ্দিন বলেন, তদন্ত কমিটির কাজ এখনো শেষ হয়নি। আর এ বিষয়ে জানতে চাইলে শামীম আখতার জানান, তদন্ত কমিটির মুখোমুখি হয়েছি। তারা কিছু নির্দেশনা দিয়েছে। সেভাবেই কাজ চলছে। তদন্ত চলছে বলে এর বেশি কিছু বলা সম্ভব না।
এইচবিআরআইর তদন্ত প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে
২০১৮ সালের ৮ মে হাউজিং অ্যান্ড বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউটে (এইচবিআরআই) পরিচালক হিসেবে যোগ দেন শামীম আখতার। পরে একই প্রতিষ্ঠানে পদোন্নতি পেয়ে মহাপরিচালক হন। ২০২০ সালের ১৪ ডিসেম্বর গণপূর্তের প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে যোগ দেওয়ার আগ পর্যন্ত এইচবিআরআইর মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। সেখানে দায়িত্ব পালনের সময় পছন্দের ঠিকাদারদের সুবিধা দেওয়াসহ আর্থিক ও প্রশাসনিক অনিয়মের সুনির্দিষ্ট ১১টি অভিযোগ নিয়ে শামীম আখতারের বিরুদ্ধে এইচবিআরআই মন্ত্রণালয়ে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। সম্প্রতি জমা দেওয়া এই তদন্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা হচ্ছে বলে জানিয়েছে মন্ত্রণালয়। এইবিআরআইর তদন্ত প্রতিবেদনে কিংডম বিল্ডার্স, কিংডম হাউজিং, কিংডম কনস্ট্রাকশনের মালিক নুসরত হোসেন, অর্থি এন্টারপ্রাইজের মালিক হলেন আল আমীন, ক্যামিকন গ্রুপের মালিক মোহাম্মদ ইয়ামিন এবং জামান বিল্ডার্স নামে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে শামীম আখতারের অবৈধ লেনদেনের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, নুসরাত, আল আমিন ও ইয়ামিন হচ্ছেন শামীম আখতারের মুরিদ। এইচবিআরআইর মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় শামীম আখতার আইন ও নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে প্রায় ২০ কোটি টাকার কাজ দিয়েছেন। এইচবিআরআইর তদন্ত প্রতিবেদনের বিষয়ে কথা বলেননি শামীম আখতার।
Discussion about this post