মুসলমানদের মাসব্যাপী ধর্মীয় কর্মসূচী রমজান মাসকে সামনে রেখে অসাধু ব্যবসায়ীরা লাগামহীন অপরাধে জড়িয়ে পরেছে পরিকল্পিতভাবেই। চলছে খাদ্য মজুদের প্রতিযোগিতা। চলছে ভেজালের লোমহর্ষক কান্ড । কোন ব্যবসায়ী কার কার চাইতে কে বেশী মজুদ করে মুণাফা বেশী করতে পারবে সে জন্য চলছে ব্যবসা সমৃদ্ধ অঞ্চল নারায়ণগঞ্জের নিতাইগঞ্জে তুঘলকি কান্ড । দেখার কেউ নাই । এমন তুঘলকি কান্ড ঘটাতে অসাধু ব্যবসায়ীদের সকলেই পূর্ব থেকেই ওই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে আইনশৃংখলা বাহিনীর প্রায় সকল সংস্থার অসাধু কর্মকর্তাদের টেবিলে টেবিলে সাক্ষাৎপর্ব সম্পন্ন করেছে ইতিমধ্যেই। ফলে অবৈধ মজুদ, মুড়ি তৈরী, সেমাই তৈরীতে যতই অনৈতিক কান্ড করুক না কেন, কারো যেন কোন মাথা ব্যাথা নাই।
আইনপ্রয়োগকারী অসাধু কর্মকর্তা আর অসাধু ব্যবসায়ী যেন ‘চোরে চোরে মাসতুতো ভাই’। প্রতি বছরের মতো এবারো চলছে ভেজালোর মহোৎসব । চলছে গ্যাস চুরি । চলছে মজুদ । চলছে খাদ্যে বিষ মেশানোর প্রতিযোগিতা। এই প্রতিযোগিতায় কেন পিছিয়ে থাকবে অসাধু আইনশৃংখা বাহিনীর কর্তারা ।
এমন মন্তব্য করেছেন নিতাইগঞ্জে একজন প্রসিদ্ধ প্রবীন ব্যবসায়ী । যিনি ওই প্রতিযোগিতায় নিজেকে যুক্ত না হয়ে বিরাগভাজনের শিকার হয়েছেন অসাধু চক্রের। যার কারণে কথার ছলে উল্লেখিত অভিযোগ তুললেও তার নাম প্রকাশ না কারর অনুরোধ করেছেন।
চাঁদ দেখা সাপেক্ষে আগামী ২৩ বা ২৪ মার্চ থেকে আরবি মাস রমজান শুরু হবে। বিশ্বের অন্য মুসলমানদের সঙ্গে বাংলাদেশের মুসলমানরাও মাসব্যাপী ধর্মীয় আচার পালন করবেন। যদিও এই মাসের মূল তাৎপর্য হচ্ছে বিলাসিতা পরিহার করে নিজের ভোগ বা চাহিদাকে নিয়ন্ত্রণ করা। তারপরও এ মাসেই ভোগ্যপণ্যের বাজার অস্থির হয়ে ওঠে। বিশেষ করে ভোজ্যতেল, ছোলা, ডাল, মটর, পেঁয়াজ, মসলা, চিনি ও খেজুরের চাহিদা বাড়ে দ্বিগুণের বেশি। একই সাথে মানহীন ও অনুমোদনবিহীন অসংখ্য সেমাই তৈরীর কারখানা, ইফতারের প্রধান খাদ্য তালিকার অন্যতম মুড়ি তৈরী করার ক্ষেত্রে বিষাক্ত হাইড্রোজ, ইউরিয়া সার মিশ্রণ করে জনস্বাস্থ্যের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে আইনশৃংখলা বাহিনীর নাকের ডগায় ।
মুড়ি তৈরীতে একদিকে বিষাক্ত সার ও হােইড্রোজ ব্যবহার এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কোন ধরণের অনুমতি ছাড়াই ভেজাল সেমাই / লাচ্চা সেমাই তৈরী করতে এরই মধ্যে গ্যাস চুরির মহোৎসব চারিয়ে যাচ্ছে পুরোদমে।
উল্লেখিত ঘটনা ছাড়াও মানুষ চাহিদার অতিরিক্ত পণ্য কেনার প্রবণতার সুযোগে নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ব্যবসায়ীদের একটি শ্রেণি যে যার মতো নিত্যপণ্যের দাম বাড়াতে থাকে। আর এ জন্য চাপে থাকেন সরকারের নীতিনির্ধারকরা। ফলে এ বছর পরিস্থিতি মোকাবিলায় আমদানি পণ্যের পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব রাখছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এর সঙ্গে এ বছর যুক্ত হয়েছে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট ও ডলার সংকটে এলসি (ঋণপত্রের) জটিলতা।
এ কারণে রোজার মাস নিয়ে তৈরি হয়েছে আগাম শঙ্কা। আর এই সুযোগে এখন থেকেই দাম বাড়ানো শুরু করেছে একটি অসাধু চক্র। বাজারে বাড়তে শুরু করেছে চাল, ডাল, পেঁয়াজ, রসুন, আটা, ময়দা, সয়াবিন তেল, পাম অয়েল, হলুদ, মরিচ, এলাচ ও দারুচিনির মূল্য।
বাজার-সংশ্লিষ্ট ও বিশ্লেষকরা বলছেন, বাজার কারসাজি চক্রের বিরুদ্ধে আগাম ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি রোজার মূল চেতনাকে ধারণ করে ইবাদত বন্দেগি করলে নিত্যপণ্যের ওপর চাপ পড়বে না। অন্যদিকে পরিস্থিতি বিবেচনায় চাহিদার অতিরিক্ত পণ্য না কেনার আহ্বান জানিয়েছেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি।
পাশাপাশি অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরিস্থিতি মোকাবিলায় মন্ত্রণালয় ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকে দফায় দফায় চলছে বৈঠক।
দেশের শীর্ষস্থানীয় আমদানিকারকদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, জটিলতার মধ্যেও যেসব এলসির পণ্য বন্দরে আসছে, ডলার সংকটের কারণে চালান খালাস করা যাচ্ছে না। পাশাপাশি চাহিদা থাকলেও ব্যাংকিং জটিলতায় এলসি খুলতে পারছেন না মধ্যম সারির ব্যবসায়ীরা। ফলে করোনার সময়ের তুলনায় ভোগ্যপণ্য আমদানি অনেকটা কমেছে। ঋণপত্র বা এলসি খোলার দিক থেকে ২০২১ তুলনায় অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত অপরিশোধিত চিনির এলসি কমেছে ২৮ ভাগ, অপরিশোধিত সয়াবিন তেল ও ছোলার এলসি কমেছে ৪৭ ভাগ এবং খেজুরের এলসি কমেছে ৩০ ভাগ পর্যন্ত। তবে এই সময়ে যেসব এলসি অনুমোদন বা খোলা হয়েছে, তা সময়মতো খালাস করতে পারলে এবং আগামী ১৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে ঘাটতি এলসি ছাড়তে পারলে রমজানে নিত্যপণ্যের কোনো সমস্যা হবে বলে মনে করেন না নিত্যপণ্যের পাইকারি বাজারের ব্যবসায়ীরা।
এ প্রসঙ্গে ঢাকার মৌলভীবাজার ব্যবসায়ী সমিতির কেউ কেউ বলেন, এটা সত্য যে, নিত্যপণ্যের যে পরিমাণ চাহিদা রয়েছে, তার ৪০ ভাগ ঘাটতি রয়েছে। ডলার সংকটের কারণে বন্দরে পণ্য খালাস করা যাচ্ছে না। দেশের যারা বড় কোম্পানি তারাই সমস্যার মধ্যে আছে। তবে সুখবর হলো, দেশের মানুষ অনেকটা সচেতন হয়েছে। আমাদের মোকামে যেভাবে রমজানের আগে বেচাবিক্রি শুরু হতো, তা এবার হয়নি। স্থানীয় পাইকারদের মধ্যেও তেমন আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। সবাই বাজার পর্যবেক্ষণ করছেন। তবে, এটা সত্য—ব্যবসায়ীরা আগ্রহ অনুযায়ী এলসি খুলতে পারেননি। বাংলাদেশ ব্যাংকও সেই তথ্য প্রকাশ করছে না। এতে বোঝা যাচ্ছে, কিছু একটা সমস্যা আছে। অন্যদিকে ব্যবসায়ী হিসেবে আমাদের কাছে যে সংবাদ তাতে ধারণা করা হচ্ছে, ইতোমধ্যে যেসব এলসি হয়ে গেছে, সেসব পণ্যের অর্থ সময়মতো খালাস করতে পারলে সাধারণ মানুষ বুঝতেই পারবে না দেশে কোনো সংকট আছে।
আসন্ন রমজান উপলক্ষে নিত্যপণ্যের জোগান নিশ্চিত করতে এবং দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করছে। এর মধ্যে পরিস্থিতি মোকাবিলায় ডিসেম্বরের মাঝামাঝি বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা ও নীতি বিভাগ থেকে জারি করা বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত ভোজ্যতেল, ছোলা, ডাল, মটর, পেঁয়াজ, মসলা, চিনি ও খেজুর ৯০ দিনের সাপ্লায়ার্স বা বায়ার্স ক্রেডিটের আওতায় আমদানির সুযোগ পাবেন ব্যবসায়ীরা। যা ডলার সংকটের এই সময়ে এলসির অনিশ্চয়তা অনেকটা কমেছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
রোজার প্রস্তুতি ও বাজার পর্যবেক্ষণের বিষয়ে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান গণমাধ্যমকে বলেন, আমাদের দপ্তর সাধ্যের মধ্যে বাজার পর্যবেক্ষণ চালিয়ে যাচ্ছে। এটি অব্যাহত আছে। এই মুহূর্তে সব থেকে যে সমস্যা বেশি, তা হলো এলসি জটিলতা। যেজন্য আমদানি পণ্যের মজুত সম্পর্কে আমরা পুঙ্খানুপুঙ্খ তথ্য রাখছি। আমি মনে করি, বাজারে পণ্য থাকলে সমস্যা হবে না। যেজন্য প্রথমে সেটি নিশ্চিত করতে হবে। এ জন্য পণ্য খালাসে এবং আমদানি জটিলতা দুর করতে হবে।
Discussion about this post