রূপগঞ্জের আতংকখ্যাত ডন বজলু অসংখ্য হত্যাকান্ডর ঘটনা ঘটিয়ে বহাল তবিয়্যতেই ছিলো দীর্ঘদিন । তার টিকিটিও স্পর্শ করতে পারতো না কেউ । বজলুর নির্মমতার শিকার কুট্টি ও হাসান ছাড়াও আলোচিত হত্যাকান্ডগুলোর মধ্যে রয়েছে- চান মিয়া, ফিরোজ সরকার, ফারুক মিয়া, পুলিশের এএসআই হানিফ মিয়া, ফালান মিয়া, আবদুর রহমান, খোরশেদ মিয়া, মনির হোসেন, আসলাম হোসেন, আনোয়ার, সজল ও সামসু ও বৃষ্টিকে শ্বাসরোধ করে হত্যাকান্ড চালায় । এমন হত্যাকান্ড ছাড়াও সকল ধরণের অপরাধ সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রক করতো এই ডন বজলু । আর এই ডন বজলু নিজেই চলতো গাণমান নিয়ে ! আর পুলিশ তো ছিলো এই বজলুর বগলদাবায়।
আর সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর বিষয় হচ্ছে এই বজলু টোকাই থেকে বিশাল অপরাধের হোতা বানাতে শাসক দলের একজন প্রভাবশালী নেতা তার ভূমিদস্যুতা ও অপরাধের সাম্রাজ্য টিকিয়ে রাখতে সকল ধরণের অপরাধের টিকেট ধরিয়ে দেয় এই বজলুর হাতে । আর তাতেই এই কয়েক বছরে বজলু হয়ে উঠে ডন বজলু তে
নারায়ণগঞ্জের চনপাড়া একালার কায়েতপাড়া ইউনিয়নের সেই কুখ্যাত প্যানেল চেয়ারম্যান-১ বজলুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
পুলিশের এলিট ফোর্স র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) ওপর হামলার অভিযোগে বজলুকে আটক করে ।
শুক্রবার (১৮ নভেম্বর) বিকেল ৪টার দিকে তাকে চনপাড়া এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে র্যাব-১ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আব্দুল্লাহ আল মোমেন সাংবাদিকদের এমন তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
তিনি জানান, গত ২৮ সেপ্টেম্বর র্যাবের ওপর হামলার অভিযোগে চনপাড়া একালার কায়েতপাড়া ইউনিয়নের প্যানেল চেয়ারম্যান-১ বজলুর রহমানকে গ্রেফতার করেছে র্যাব-১।
র্যাব জানায়, গত ১০ নভেম্বর রাতে র্যাবের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ সিটি শাহীন নিহত হয়। সিটি শাহীনের সব অপকর্মের সেল্টারদাতা ছিলেন বজলু চেয়ারম্যান। এছাড়া র্যাবের ওপর হামলার নেতৃত্ব দেন বজলু।
সম্প্রতি চনপাড়া সরেজমিনে গলমাধ্যমে একাধিক প্রতিবেদক জানতে পারেন— নিহত সিটি শাহীনের একটি বড় অপরাধ বাহিনী রয়েছে এলাকায়। তিনি ওয়ার্ড স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এবং চনপাড়া মাদক নির্মূল কমিটির সদস্য সচিব ছিলেন। তার অত্যাচারে অতিষ্ঠ এলাকাবাসী। হামলা-নির্যাতনের ভয়ে শাহীন ও তার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কথা বলার সাহস নেই কারও। প্রায় পঞ্চাশাধিক নারী, পুরুষ ও তরুণের সঙ্গে কথা হয় সাংবাদিকদের।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অধিকাংশরাই জানান, চনপাড়ায় হয় না এমন কোনো কিছু নেই। চনপাড়ায় রাতকে দিন আবার দিনকে রাত বানিয়ে দেওয়া যায়। এখানে এমন কিছু মানুষ আছেন যাদের নিয়ন্ত্রণে পুরো বস্তিবাসী। বস্তিতে কোনো অনুষ্ঠান করতে গেলেও লাগে প্রভাবশালীদের অনুমতি। তাদের কথা না শুনলে চলে নির্যাতন ও চাঁদাবাজি।
স্থানীয়রা জানায়— বজলু চেয়ারম্যানের ভয়ে চনপাড়ায় কারো মুখ খোলার সাহস নেই। বজলুসহ তার চার ভাই নিয়ন্ত্রণ করে পুরো চনপাড়া বস্তি। সঙ্গে রয়েছে কিছু অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী। এসব অপরাধীরা দিনে-দুপুরে মাদক কারবারি, মারধর ও খুনসহ নানা অপরাধে জড়িত।
বস্তির লোকজন বজলু ও তার লোকদের বিষয়ে ভয়েও মুখ খোলে না। কথিত আছে— বজলুর কথা ছাড়া সেখানে পাতাও নড়ে না। তার নামে ভয় দেখিয়ে ঘুম পাড়ানো হয় বস্তির শিশুদের। বুয়েট ছাত্র ফারদিন নূর পরশ খুনের জেরে আলোচনায় এসেছে চনপাড়া বস্তির নাম।
বজলুর নামে কেবল রূপগঞ্জ থানাতেই হত্যা, অস্ত্র, মাদকের মামলা মিলিয়ে ১২টি মামলা রয়েছে। অস্ত্র ও খুনের মামলায় এক সময়ের জেলখাটা বজলু এখন নাম লিখিয়েছিলেন সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তির খাতায়।
হামলা-নির্যাতন-টর্চার সেল :
স্থানীয় লোকজন অভিযোগ করেছেন, গত দুই মাসে অন্তত ১৩ জনকে তুলে নিয়ে জিম্মি করে অর্থ আদায় করেছেন বজলু। টাকা না দিলে মাদক মামলায় জড়ানো হবে এমন হুমকি দিয়ে টাকা আদায় করেছেন তিনি। একেকজনের কাছ থেকে ২০ হাজার থেকে শুরু করে ১ লাখ টাকা পর্যন্ত আদায় করা হয়েছে।
হারুন অর রশীদ মিয়াজী নামে স্থানীয় এক বাসিন্দা জানান, চনপাড়ার গাজী বিশ্ববিদ্যালয় এবং সেতুবন্ধন এলাকায় বজলুর দুটি টর্চার সেল আছে। তার দেহরক্ষীরা জোর করে মানুষকে তুলে নিয়ে টর্চার সেলে নির্যাতনের মাধ্যমে মুক্তিপণ আদায় করে। সাম্প্রতিক সময়ে ২০ জনকে তুলে নিয়ে অর্থ আদায় করা হয়। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন- রতন, দ্বীন ইসলাম, আক্তার, কবির, আলমগীর (১), আলমগীর (২), ইউসুফ হাওলাদার, মো. রফিক, মোহাম্মদ আলী, ইদ্রিস, মাসুম প্রমুখ।
হারুন অর রশীদ মিয়াজী বলেন, ‘কয়েক দিন আগে আমার বাড়িতেও হামলা করেছেন বজলু। ইদ্রিসের কাছ থেকে বজলু অনেকবার টাকা নিয়েছেন। পুলিশের ভয় দেখিয়ে সপ্তাহখানেক আগে সাড়ে ৩ লাখ টাকা চাঁদা নিয়েছেন তিনি। তিন মাস আগে টর্চার সেলে নিয়ে রফিককে হাতুড়িপেটা করেছেন বজলু। তার শরীরে হাতুড়িপেটার ৭৮টি দাগ রয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘কেউ বজলুর কথা না শুনলে তাকে ইয়াবা দিয়ে পুলিশের হাত হস্তান্তরের পর আদালতে চালান দেওয়া হয়। কয়েক দিন আগে শাকিল হোসেন নামে এক শিক্ষার্থীকে ১ হাজার ৩০০ পিস ইয়াবা ও ২০ গ্রাম হেরোইন দিয়ে পুলিশে দিয়েছেন বজলু। অথচ ছয় মাস পর ইঞ্জিনিয়ারিং ফাইনাল পরীক্ষা ওই শিক্ষার্থীর। কিন্তু বজলুর রোষানলে পড়ে তিনি সেমিস্টার পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেননি।’
স্থানীয় আরেক বাসিন্দা বাচ্চু মিয়া। তবে বর্তমানে ওই এলাকায় থাকেন না। তিনি অভিযোগ করেন, ‘বছর দুয়েক আগে আমার ১৯ বছর বয়সী মেয়ে বৃষ্টিকে শ্বাস রোধ করে হত্যা করা হয়। মাদক ব্যবসায়ী ইউসুফের নির্দেশে এ হত্যার ঘটনা ঘটে। ঘটনার পরপরই সিদ্দিককে হাতেনাতে ধরে বজলুর কাছে দিই। কিন্তু বজলু তাকে ছেড়ে দেন। পুলিশ তদন্ত করে আবু বক্কর সিদ্দিক ও নাছিমা নামে দুজনকে আসামি করে চার্জশিট দিয়েছে। কিন্তু আসামিরা বজলু মেম্বারের লোক হওয়ায় তাদের ভয়ে কেউ আদালতে সাক্ষ্য দিতে যাচ্ছেন না।’
স্থানীয় আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘জয়নাল ও সিটি শাহীন গ্রুপের দ্বন্দ্বের বলি হয়ে মাস তিনেক আগে আমার ১৭ বছর বয়সী ভাগনে সজল প্রাণ হারায়। মাথায় ইট দিয়ে থেঁতলে নির্মমভাবে তাকে হত্যা করা হয়। আমার ভাগনে মারা যাওয়ার আগের দিনও ৯ নম্বর রোডের আরিফকে কুপিয়ে গুরুতর জখম করা হয়। ভাগ্যগুণে বেঁচে যায় সে।’
কায়েতপাড়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহসভাপতি শামসুল আলম বলেন, ‘আমরা আসলে প্রকৃত কথা বলতে পারি না। শুধু চনপাড়া নয়, পুরো কায়েতপাড়া ইউনিয়ন নিয়ন্ত্রণ করা হয় চনপাড়া পুনর্বাসন কেন্দ্র থেকে। দেশের সব অঞ্চলের অপরাধীরা সেখানে আশ্রয় নেয়। এসবের নিয়ন্ত্রক বজলু।’
Discussion about this post