নারায়ণঞ্জের পুরাতন আদালত (বিলুপ্ত) ভবনের তৃতীয় তলায় দূদকের (বিলুপ্ত দুর্নীতি দমন ব্যুরো) কার্যালয় থাকলেও দীর্ঘদিন যাবৎ নারায়ণগঞ্জে কোন দপ্তর ছিলো না দূদকের । গুরুত্বপূর্ণ সরকারী এই সংস্থাটির কোন কার্যালয় না থাকায় দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ এই নারায়ণগঞ্জের দূর্ণীতি মারাত্মক আকার ধারণ করে। কোথায় হচ্ছে না দূর্ণীতি ? রাস্ট্রের যে সংস্থা অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে সেই সংস্থাগুলির কর্মকর্তারা কোটি টাকা ঘুষ দিয়ে নারায়ণগঞ্জে পোটিং পেয়েই অপরাধের রামরাজত্ব শুরু করে।
নারায়ণগঞ্জের কয়েকটি থানার চিত্র দেখলেই সহজেই অনুমান করা যায়, জেলার একটি থানার একজন ওসি ধর্ষণ মামলার আসামী, এক ওসি ভূমিদস্যূ, ডিবি পুলিশের একজন ওসির বিরুদ্ধে গোপালগঞ্জের মতো জেলায় ধর্ষনের অভিযোগ তুলে সাংবাদিক সম্মেলন করার পরও এমন কর্মকর্তাদের পোটিং দেয়া হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ এই জেলাতে।
এমন অপরাধীদের বিরুদ্ধে গণমাধ্যমকর্মীরা সংবাদ প্রকাশ করতে গিয়ে চোখ রাঙ্গানীর শিকার হচ্ছে প্রতিনিয়তঃ । গুরুত্বপূর্ণ একজন ওসির বিরুদ্ধে ঘুষ হিসেবে রমজান মাসে এক বস্তা মুড়ি ও যৎসামান্য ঘুষ গ্রহণের সংবাদ প্রকাশ করায় সাংবাদিকদের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলার হুমকিও দেয় কর্মকর্তাদের কেউ কেউ । এমন হাজারো দূর্ণীতির জ্বলন্ত প্রমাণ থাকার পরও দূদক এর কোন দপ্তর ছিলো না নারায়ণগঞ্জে । এমন কোন দপ্তর আছে নারায়ণগঞ্জে যেটি দূর্ণীতিমুক্ত ? এবার দূদকের কার্যালয় স্থাপন হলে দূর্ণীতিবাজদের লাগাম কিছুটা হলেও টেনে ধরা যাবে বলে মন্তব্য নারায়ণগঞ্জবাসীর
জানা যায়, দেশের ১৪ জেলায় বসছে দুর্নীতি দমন ও প্রতিরোধে নিয়োজিত রাষ্ট্রীয় সংস্থা দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) নতুন অফিস। চলমান ২২টি সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের সঙ্গে নতুন করে যুক্ত হচ্ছে এই ১৪ সমন্বিত জেলা অফিস। প্রতিটি অফিসের অধীনে একাধিক জেলা থাকছে। আগামী ১ জানুয়ারি থেকে একটি ও পহেলা জুলাই থেকে ১৩ জেলায় চালু হবে।
কমিশন সম্প্রতি বিষয়টি অনুমোদন দিয়েছে। সাংগঠনিক কাঠামোর পরিসর বাড়ানোর অনুমোদনের তিন বছর পর তা কার্যকর হতে যাচ্ছে। এতে সবমিলে ৩৬ জেলায় এ ধরনের অফিস থাকছে। পর্যায়ক্রমে বসবে বাকি জেলায়। জেলায় জেলায় অফিস দুর্নীতি প্রতিরোধে দুদকের সক্ষমতা আরও বৃদ্ধি পাবে বলে আশা সংশ্লিষ্টদের। তবে জেলা অফিসগুলো যাতে ‘নামসর্বস্ব’ না হয় সে বিষয়ে লক্ষ্য রাখার ব্যাপারে তাগিদ দিয়েছেন তারা।
জানতে চাইলে দুদক কমিশনার ড. মোজাম্মেল হক খান বলেন, দুদক হচ্ছে একটি পাবলিক অফিস। এখানে মানুষকে সুযোগ দিতে হয়। মানুষের অভিযোগগুলো শুনতে হয়। সাধারণ মানুষ যাতে অভিযোগ দিতে পারে এমন একটি পরিবেশও তৈরি করতে হয়। সঙ্গত কারণেই ২২টি জেলা কার্যালয় দিয়ে সারা দেশের ৬৪টি জেলার কার্যক্রম সুচারুভাবে পরিচালনা করা সম্ভব হয় না। সেজন্যই কার্যালয় ও জনবল বাড়ানোর এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তবে প্রক্রিয়াটি কার্যকর করতে অনেকটা দেরি হয়ে গেছে। বর্তমান কমিশন গঠনের পর এ কাজে গতি ফেরে। এরই ধারাবাহিকতায় প্রথমে একটি ও পরে ১৩টি জেলা কার্যালয় স্থাপন ও কার্যক্রম শুরুর অনুমতি দেওয়া হয়। তিনি বলেন, দুইশ কর্মকর্তা নিয়োগের প্রক্রিয়া চলছে। আগামী দুই বছরের মধ্যে প্রয়োজনীয় সংখ্যক জনবল নিয়ে দুদক পূর্ণোদ্যমে মাঠে থাকবে।
দুদকের সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান সাংবাদিকদের বলেন, নতুন করে জেলা কার্যালয় চালুর খবর ইতিবাচক। দুর্নীতির অনুসন্ধান ও তদন্ত যথাসময়ে সম্পন্ন করতে চাইলে পর্যাপ্ত লোকবলের প্রয়োজন। নতুন কার্যালয়গুলোতে দক্ষ জনবল নিয়োগ করতে হবে। দুদকের অফিস থাকায় জেলাগুলোতেও অনিয়ম-দুর্নীতি কিছুটা হলেও কমবে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, নতুন ১৪টি জেলা কার্যালয় স্থাপন ও কার্যক্রম চালুর বিষয়টি অবশ্যই ইতিবাচক। এর প্রয়োজন ছিল। অনেক দেরির পর কাজটি হয়েছে এজন্য আমরা সন্তোষ প্রকাশ করছি। তবে একই সঙ্গে নতুন কার্যালয়গুলো যেন নামসর্বস্ব না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। যোগ্য প্রশিক্ষিত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়োগ দিতে হবে। আর কেন্দ্রীয়ভাবে কমিশনকে বিষয়টিও মনিটরিং করতে হবে।
জেলা কার্যালয় স্থাপনে ব্যুরোর চেয়ে পিছিয়ে কমিশন : বিলুপ্ত দুর্নীতি দমন ব্যুরো ৬৪ জেলায় ৬৬টি কার্যালয়ের মাধ্যমে অফিস পরিচালনা করেছে। ওই সময় জেলা কার্যালয়ের পাশাপাশি রেলওয়ে পূর্বাঞ্চল ও রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চলেও ব্যুরোর ফিল্ড অফিস ছিল। ২০০৪ সালের ২১ নভেম্বর দুর্নীতি দমন ব্যুরো বিলুপ্ত করে কমিশন গঠন করা হয়। এরপর থেকে ৬৬টি কার্যালয়ের পরিবর্তে ২০ জেলায় ২২টি কার্যালয় দিয়ে কমিশন ৬৪টি জেলায় কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে।
দীর্ঘ ১৩ বছর পর ২০১৮ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর দুদকের সাংগঠনিক কাঠামোর পরিসর বাড়ানোর অনুমোদন দেন প্রধানমন্ত্রী। এরপর অর্থ বিভাগ থেকে ওই বছরের ৮ অক্টোবর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের প্রধান হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তাকে চিঠি দিয়ে বিষয়টি জানানো হয়। দুদকের নতুন সাংগঠনিক কাঠামোতে বিদ্যমান ছয়টি বিভাগীয় কার্যালয়ের সঙ্গে আরও দুটি নতুন বিভাগীয় কার্যালয় স্থাপনের অনুমোদন দেওয়া হয়। একই সঙ্গে চলমান ২২টি জেলা কার্যালয়ের সঙ্গে আরও ১৪টি নতুন জেলা কার্যালয় স্থাপনেরও অনুমোদন দেওয়া হয়। তবে দীর্ঘদিনেও এ উদ্যোগের তেমন কোনো অগ্রগতি লক্ষ করা যায়নি। এরই মধ্যে কমিশন পরিবর্তন হয়। নতুন কমিশন গঠনের পর সাংগঠনিক কাঠামোর পরিসর বাড়ানোর উদ্যোগে গতি ফেরে।
যে ১৪ জেলায় দুদকের কার্যালয় চালু হচ্ছে : দুদকের সাংগঠনিক কাঠামোর পরিসর বাড়ানোর ক্ষেত্রে সরকারের অনুমোদনের তিন বছর পর তা কার্যকর হতে চলেছে। গত ৬ অক্টোবর দুদক সচিব স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে কক্সবাজার ও বান্দরবান জেলা নিয়ে কক্সবাজার সমন্বিত জেলা কার্যালয় স্থাপনের ঘোষণা আসে। এরপর গত ১ নভেম্বর দুদক সচিব স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে আরও ১৩টি জেলা কার্যালয় স্থাপন ও চালুর অনুমোদন দেওয়া হয়। এগুলো হলো-নারায়ণগঞ্জ (নারায়ণগঞ্জ ও মুন্সীগঞ্জ), গাজীপুর (গাজীপুর ও নরসিংদী), মাদারীপুর (মাদারীপুর ও শরীয়তপুর), গোপালগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, জামালপুর (জামালপুর ও শেরপুর), নওগাঁ (নওগাঁ ও জয়পুরহাট), কুড়িগ্রাম (কুড়িগ্রাম ও লালমনিরহাট), চাঁদপুর (চাঁদপুর ও লক্ষ্মীপুর), বাগেরহাট (বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা), ঝিনাইদহ (ঝিনাইদহ, মাগুরা ও চুয়াডাঙ্গা) ও পিরোজপুর (পিরোজপুর ও ঝালকাঠি) সমন্বিত জেলা কার্যালয়।
যেসব জেলায় চলছে দুদকের কার্যক্রম : দুদকের প্রধান কার্যালয় ছাড়াও বর্তমানে চালু থাকা ২২টি কার্যালয় হলো-ঢাকা-১ মেট্রোপলিটন (ঢাকা মহানগর), ঢাকা-২ (ঢাকা মহানগরের বাইরে ৫ থানা ও মানিকগঞ্জ), ফরিদপুর (ফরিদপুর ও রাজবাড়ী), ময়মনসিংহ (ময়মনসিংহ ও নেত্রকোনা), টাঙ্গাইল, রাজশাহী (রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নাটোর), পাবনা (পাবনা ও সিরাজগঞ্জ), বগুড়া, রংপুর (রংপুর ও গাইবান্ধা), দিনাজপুর, চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন (চট্টগ্রাম মহানগর), চট্টগ্রাম (চট্টগ্রাম মহানগরের বাইরে উপজেলাসমূহ), রাঙ্গামাটি (রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ি), কুমিল্লা (কুমিল্লা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া), নোয়াখালী (নোয়াখালী ও ফেনী), খুলনা, যশোর (যশোর ও নড়াইল), কুষ্টিয়া (কুষ্টিয়া ও মেহেরপুর), বরিশাল (বরিশাল ও ভোলা), পটুয়াখালী (পটুয়াখালী ও বরগুনা), সিলেট (সিলেট ও সুনামগঞ্জ) ও হবিগঞ্জ (হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজার)।
Discussion about this post