আজ সেই ৭ মে । আজ থেকে ঠিক পঞ্চাশ বছর পূর্বে স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে নারায়ণগঞ্জের রাজাকার চক্রের সাথে মিলিত হয়ে টাংগাইলের কুখ্যাত রাজাকার মাহবুবুর রহমান বাংলার দানবীর রনদা প্রসাদ সাহা ও তার পুত্র ভবানী প্রসাদ সাহাকে তুলে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে ।
রণদা প্রসাদ সাহা (আর পি সাহা) নারায়ণগঞ্জ ছাড়াও পাকিস্তান ও বাংলাদেশ সৃষ্টির আগেই জন মানুষের সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করায় তাকে (আরপি সাহাকে) রায় বাহাদুর খেতাবে ভূষিত করেছিলো বৃটিশ সরকার ।
এমন মহান দানবীর ও তার পুত্রকে এক সাথে তুলে নিয়ে ১৯৭১ সালের ৭ মে নির্মমভাবে হত্যা করে রাজাকার চক্র।
আজ সেই শোকের দিন প্রয়াত দানবীর আর পি সাহার পরিবারসহ নারায়ণগঞ্জবাসীর জন্য
জানা যায়, মুক্তিযদ্ধের সময় দানবীর রণদা প্রসাদ সাহা (আর পি সাহা) ও তার ছেলে হত্যাকাণ্ডসহ তিনটি গণহত্যার অভিযোগে টাঙ্গাইলের মির্জাপুরের মাহবুবুর রহমানকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
২০১৯ সালের ২৭ জুন বৃহস্পতিবার আসামির উপস্থিতিতে চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. শাহিনুর ইসলামের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এ রায় দেন ।
আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন প্রসিকিউটর রানা দাশ গুপ্ত।
আসামি মাহবুবুর রহমানের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী গাজী এম এইচ তামিম।
রায়ের সময় রণদা প্রসাদ সাহার পুত্রবধূ স্ত্রী শ্রীমতি সাহা ও নাতি রাজীব সাহাসহ কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের বেশ কয়েকজন আদালতে উপস্থিত ছিলেন।
রায়ের পর এক আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয় ।অপরদিকে ঘাতকদের স্বজন্দের অনেকেই আদালতে উপস্থিত থাকলেও তাদের মাথা ছিলো লজ্জায় নত ।
তৎকালীন সময়ে রায় ঘোষণার পরে প্রসিকিউটর রানা দাশগুপ্ত সাংবাদিকদের বলেছিলেন, তিনটি অভিযোগ গঠন করে এ মামলার বিচার শুরু হয়েছিলো। প্রসিকিউশন সন্দোহাতীতভাবে তিনটি অভিযোগই প্রমাণ করতে পেরেছে, এমন অভিমত ব্যক্ত করে আদালত তিনটি অভিযোগেই আসামি মাহবুবুর রহমানকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন।
এদিকে রায়ের পরে সন্তোষ প্রকাশ করে শ্রীমতি সাহা বলেন, আমাদের দেশের ওপর, আমাদের পরিবারের ওপর এত অন্যায় এত অবিচার হয়েছিল, আজকে এই রায়ের মাধ্যমে তা স্বীকার করে নেওয়া হলো। অত্যাচারের বিচার পেয়েছি, স্বাধীনতার ৪৮ বছর পর হলেও উত্তর পেয়েছে আগামী প্রজন্ম। আর পি সাহার মত মহান একজন ব্যক্তিকে হত্যা করা হয়েছে। আমরা এ রায়ের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই। এবং সবার কাছে আশীর্বাদ চাই।
একই ভাবে নাতি রাজিব সাহা বলেছিলেন, এতদিন নিঃস্ব অবস্থায় ছিলাম। জানতে পারছিলাম না, বুঝতে পারছিলাম যে কী হবে, কোথায় যাবো। আজকে বিশাল একটি অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি হল।
২০১৮ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ট্রাইব্যুনাল মাহবুবুর রহমানের বিরুদ্ধে অভিযোগ আমলে নেন। পরে ২৮ মার্চ অভিযোগ গঠন করেন ট্রাইব্যুনাল।
২০১৭ সালের ২ নভেম্বর তদন্ত সংস্থার কার্যালয়ে মামলার প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। ওইদিন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার প্রধান সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান খান বলেন, আসামি মাহবুবুর রহমান ১৯৭১ সালের ৭ মে মধ্যরাতে নারায়ণগঞ্জের স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ২০-২৫ জন সদস্যকে নিয়ে রণদা প্রসাদ সাহার বাসায় অভিযান চালায়।
‘আসামি এক সময় জামায়াতের সমর্থক ছিলেন। কিন্তু নির্দলীয়ভাবে তিন তিনবার ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও প্রতিবারই পরাজিত হয়েছেন। ’
মামলাটির তদন্ত শুরু হয়েছিল ২০১৬ সালের ১৮ এপ্রিল। তদন্ত সম্পন্ন করতে দেড় বছরেরও বেশি সময় লেগেছে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় আসামি টাঙ্গাইলের মির্জাপুরের ভারতেশ্বরী হোমসের আশপাশের এলাকা, নারায়ণগঞ্জের খানপুরের কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট ও তার আশপাশে এবং টাঙ্গাইল সার্কিট হাউজ এলাকায় অপরাধ সংঘটিত করেন।
তদন্তে মাহবুবুর রহমানের বিরুদ্ধে অপহরণ, হত্যা, অগ্নিসংযোগ ও গণহত্যার প্রমাণ উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, তদন্তকালে ৬০ জনের সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে এবং মোট ১০০ পাতার নথিপত্র সংগ্রহ করা হয়। মামলাটি তদন্ত করেন সংস্থার তদন্ত কর্মকর্তা আতাউর রহমান।
মানব সেবায় অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ স্বাধীনতার পর সরকার আর পি সাহাকে মরণোত্তর স্বাধীনতা পদক দেয়। মানব হিতৈষী কাজের জন্য ব্রিটিশ সরকার রায় বাহাদুর খেতাব দিয়েছিল আর পি সাহাকে। তার বাবার বাড়ি ছিল টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে। সেখানে তিনি একাধিক শিক্ষা ও দাতব্য প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন।
এক সময় নারায়ণগঞ্জে পাটের ব্যবসায় নামেন রণদা প্রসাদ সাহা; থাকতেন নারায়ণগঞ্জের খানপুরে । সে বাড়ি থেকেই তাকে, ৫০ বছর পূর্বে স্বাধীনতা যুদ্ধা চলাকালীন সময়ে রনদা প্রসাদ সাহা ও তার ছেলেসহ অন্যদের ধরে নিয়ে যান মাহবুবুর রহমান ও তার সহযোগীরা । মাহবুবুর রহমানের বিচার হলেও নারায়ণগঞ্জের চিহ্নিত রাজাকারদের পরিবারের সদস্যরা এখনো রয়েছে শাসক দলের নেতাদের শেল্টারে । ওই রাজাকারের সন্তানেরা নারায়ণগঞ্জের রাজনৈতিক – সামাজিক ও প্রশাসনিক ভাকে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে বীরদর্পে ছড়ি ঘুরাচ্ছে।
উদাহরণ হিসেবে নারায়ণগঞ্জ শহরের অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, ১৪ ফেব্রুয়ারী নারায়ণগঞ্জে কুমুদিনী ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব মেডিকেল সায়েন্সেস অ্যান্ড ক্যান্সার রিসার্চের ভিত্তি স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেই অনুষ্ঠানেও নারায়ণগঞ্জের চিহ্নিত রাজাকারের বাচ্চারা শাসক দলের নেতাদের সাথে প্রধানমন্ত্রীর এই অনুষ্ঠানে মঞ্চের প্রথম সারিতে অবস্থান নিতে দেখা গেছে । কুমুদিনীর এমন অনুষ্ঠানে এমন চিহ্নিত রাজাকারের সন্তানেরা কি করে ঠাই পেয়েছে তা কি কেউ খোজ করেছে ? কার শেল্টারে চিহ্নিত রাজাকারের বাচ্চারা ওই অনুষ্ঠানে উপস্থিত হওয়ার সাহস পেয়েছে ?
রণদা প্রসাদ সাহা (আরপি সাহা) ও রার পুত্র ভবানী প্রসাদ সাহার হত্যাকারী চক্রের দোষরদের উত্তরাধিকাররা প্রধানমন্ত্রীর এমন অনুষ্ঠানে উপস্থিতির কোন সংবাদ কেউ এতো দিনেও প্রকাশ করার সাহস না করায় সহজে অনুমান করা যায় ওই খুনি চক্র এখনো কতটা সক্রিয় । এমন মন্তব্য শহরের অনেকের ।
Discussion about this post